২০২১ ভালো হবে, কিন্তু কেমন ভালো!

আমরা একটা নতুন পৃথিবী চাই, তা আমরা পাব না, কিন্তু তার স্বপ্ন যেন না মরে। তার জন্য একক এবং সম্মিলিত প্রয়াস যেন থেমে না যায়।

অলংকরণ: এস এম রাকিবুর রহমান

২০২০ মানুষদের জন্য খারাপ গেছে। বলা হচ্ছে, এটা ছিল পৃথিবীর মন্দতম বছর। এত খারাপ বছর এই পৃথিবীতে আর কখনো আসেনি। করোনা নামের ভাইরাসটি সারা পৃথিবীকে থমকে দিয়েছে, ভয়াবহতম দুঃস্বপ্নের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। প্রায় ১৫ লাখ মানুষ কোভিডে আক্রান্ত হয়ে বিদায় নিয়েছেন। মানুষ অবিশ্বাস করছে মানুষকে, প্রেমিক প্রেমিকাকে, মা তার সন্তানকে। যে-ই কাছে আসছে, মনে হচ্ছে সে-ই সম্ভাব্য আততায়ী। মানুষ কাছে আসা ভুলে যাচ্ছে, ভুলে যাচ্ছে স্পর্শের মায়া, আলিঙ্গনের উষ্ণতা, চুম্বনের জাদু। মানুষ ভুলে যাচ্ছে সম্মিলন, একত্র হওয়া, মেলা, মিলন, উৎসব। নিউইয়র্কের ঘরে ঘরে লাশ পড়ে ছিল, স্পেনে-ইতালিতে বৃদ্ধের অক্সিজেনের নল খুলে দেওয়া হয়েছে যুবকের নাসিকায়। বাংলাদেশে বৃদ্ধা মাকে জঙ্গলে ফেলে রেখে পালিয়ে গিয়েছিল সন্তানেরা। ভারতে কয়েক শ মাইল পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরেছে এক যুবক।

এত খারাপের মধ্যেও আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেল। কারণ, কোনো গাড়ি নেই, উড়োজাহাজ নেই, কার্বন দূষণ নেই। তেঁতুলিয়া থেকে দেখা গেল পরিষ্কার কাঞ্চনজঙ্ঘা। বয়স্করা বন্দী হলো ঘরে। ছেলেমেয়েদের সঙ্গে কার্পেটে বসে পাজল খেলছে ফুটবলার বাবা, নাতিরা করপোরেট চেয়ারম্যান দাদুর ঘাড়ে-পিঠে চড়ে ঘোড়া ঘোড়া খেলছে। স্বামী-স্ত্রী বহু জমানো কথার বিনিময় করলেন। আবার গার্হস্থ্য নির্যাতন বাড়ল, বিবাহবিচ্ছেদের সংখ্যা স্থাপন করল নতুন রেকর্ড।

রংপুরের শিক্ষক মিনার বসুনিয়ার এই কবিতাটি মুখে মুখে ফিরতে লাগল:

তিনি তো তোমাদের একার ঈশ্বর নন।

তিনি হয়তো ডলফিনের আবেদন

মনজুর করেছেন—

তিনি হয়তো সাগরের মোনাজাত

কবুল করেছেন—

তিনি হয়তো বনের প্রার্থনা

মন দিয়ে শুনেছেন—

তিনি হয়তো পাহাড়ের দাবিগুলো

যৌক্তিক ভেবেছেন—

তারাও হয়তো টিকে থাকার জন্য

দুহাত বাড়িয়েছিল!

হয়তো তারাও বাঁচতে চেয়ে কেঁদেছিল

রাতের পর রাত—

নইলে আজ আকাশ কেন হবে এত নীল!

নইলে পাখিরা কেন আজ মুখরিত হবে

দুরন্ত কোলাহলে

তিনি তো মানুষের একার ঈশ্বর নন, আর

পৃথিবীও নয় তোমাদের একার

২০২১ সাল ভালো হবে মানুষদের জন্য। ঢাকা শহরে আগস্ট মাস পর্যন্ত ৪৫ ভাগ মানুষের কোভিড হয়ে গিয়েছিল, ডিসেম্বর নাগাদ আরও ৪৫ ভাগের হয়ে যাওয়ার কথা। এরপর শীত চলে যাবে, বসন্ত আসবে, করোনার সংক্রমণ থেমে যাবে, মৃত্যু নেমে আসবে অন্তত সিঙ্গেল ডিজিটে, এটা তো আমরা আশা করতেই পারি। আর এসে যাবে করোনাপ্রতিরোধী টিকা। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের লাখ লাখ মানুষ করোনার ভ্যাকসিন পেয়েও গেছেন। আমরাও পাব।

পৃথিবী আবার সচল হবে, ফিরে পাবে গতিবেগ। আকাশ ছেয়ে যাবে বিমানে। বাচ্চাদের শিক্ষকেরা বলবেন, মোবাইল ফোন আনা নিষেধ। ছাত্র বলবে, আপনারা বলেন, স্কুলে মোবাইল ফোন আনা মানা, তাহলে আমাদের পুরো স্কুলটাকেই কেন মোবাইল ফোনের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন?

আবার কালো ধোঁয়ায় ছেয়ে যাবে আকাশ-বাতাস। কক্সবাজার সৈকত থেকে দূর সমুদ্রে চলে যাবে ডলফিন।

কিন্তু মানুষ কি কিছু শিখবে এই মহাবিপর্যয় থেকে? কয়েক লাখ বছর ধরে মানুষ মানুষ হয়েছে; কিন্তু মানুষের মধ্য থেকে হিংসা, ঈর্ষা, লোভ, শঠতা, স্বার্থপরতা, হিংস্রতা, জাতিবিদ্বেষ, সাম্প্রদায়িকতা, স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি, ক্ষমতার মোহ বিন্দুমাত্র কমেছে? মানুষ আসলে মানুষ হয়নি। বা বলা যায়, অস্তিত্বের সংগ্রাম, যোগ্যতমের টিকে থাকার সেই মৌলিক সূত্র দিয়েই মানুষ চালিত হচ্ছে, স্বার্থপরতা আর চারদিকের সবকিছুকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভেবে সবকিছুকেই তছনছ ছারখার করে দেওয়ার নামই মনুষ্যত্ব।

যদি বলি, ২০২০ খুব খারাপ গেছে, তাহলে বলতেই হবে, ২০২১ খুব ভালো যাবে। কিন্তু এই ভালোত্ব মানে আবারও অস্ত্রের প্রতিযোগিতা, আবারও ধর্মের নামে যুদ্ধ, আবারও করপোরেট পুঁজির একচেটিয়া বিস্তার, তার পাগলা ঘোড়ার খুরের নিচে ছিন্নভিন্ন ৬০০ কোটি মানুষের জীবন। কবি-লেখকেরা বলেছেন, এর নাম যদি হয় নরমাল, তাহলে আমরা আগের নরমাল চাই না। চাই একটা নতুন স্বাভাবিকতা, যেখানে বৈষম্য কমে যাবে, মানুষে মানুষে ভেদ কমবে, দূরত্ব কমবে, পৃথিবীটা মানবিক হয়ে উঠবে।

মানুষের লক্ষ বছরের ইতিহাসে প্রমাণ নেই যে মানুষ ব্যক্তিস্বার্থ, পরিবারস্বার্থ, গোষ্ঠীস্বার্থ, জাতিস্বার্থের ওপরে উঠতে পেরেছে। যে একজন দুজন হয়েছেন, তাঁরা ছিলেন ব্যতিক্রম, তাঁরা মানুষ নন, তাঁরা মহাপুরুষ। পৃথিবী আর মহাপুরুষদের জন্ম দেবে না।

২০২১ যদি ২০১৯-এর মতো হয়, তাহলেই বলতে হবে, আবার স্বাভাবিক হয়ে এসেছে সবকিছু। যেখানে স্বাভাবিকতার আরেক নাম বৈষম্যের জাঁতাকলে পিষ্ট যবের দানার মতো ছিবড়ে হয়ে যাবে শতকোটি জীবন—মানবজীবন।

আমরা একটা নতুন পৃথিবী চাই, তা আমরা পাব না, কিন্তু তার স্বপ্ন যেন না মরে। তার জন্য একক এবং সম্মিলিত প্রয়াস যেন থেমে না যায়। ২০২১-এর ভোরে বারান্দায় দুটো চড়ুই সেই কথা আমাকে বলে গেছে।

বলে গেছে:

মানুষ তুমি বড় বেশি স্বার্থপর।

মানুষ তুমি বড় বেশি একা।

মানুষ তুমি বড় বেশি হিংস্র।

তোমার চারদিকে সবকিছুকে কেন তুমি

প্রতিযোগী করে তুললে,

সহযোগী নয়।

তোমার সবকিছুকে কেন তুমি

শত্রু বানিয়ে ফেললে, বন্ধু নয়।

তোমার সবকিছুকে কেন তুমি

টার্গেট বানিয়ে ফেললে, আশ্রয় নয়।

এখন তুমি তোমার নিজের

ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধ করছ,

ছায়া লক্ষ্য করে ছুড়ছে তির,

অথচ ছায়া মানে ছিল মায়া।

মানুষ তুমি কি জানো, একটা চড়ুই পাখির জীবন তোমার চেয়ে এক শ গুণ সুন্দর!


● আনিসুল হক: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক