'নিজের দুটি চরণ ঢাকো, তবে'

পাঠক বুঝতে পারছেন রবীন্দ্রনাথ থেকে নেওয়া এ শিরোনাম। শিরোনামের ব্যাখ্যায় পরে আসা যাবে। আগে মূল বিষয়বস্তু আলোচনায় আসুক। তা হচ্ছে সম্প্রতি পাঁচ পর্বে অনুষ্ঠিত উপজেলা পরিষদ নির্বাচন। ভোট নেওয়া শেষ হলে বেতার-টিভি আর সংবাদপত্রের অনেক প্রতিবেদন আমরা দেখলাম। কিছু আবার সচিত্র। বিভিন্ন সংবাদপত্রের শিরোনামগুলোই নির্বাচন পর্বটির গুণগত দিক তুলে ধরেছে। নির্বাচন কমিশনের প্রতি সবচেয়ে সদয় শিরোনাম দেখা গেল, ‘শেষটাও ভালো হলো না’। এ ছাড়া রয়েছে ‘রাতেই কেন্দ্র দখল করে ভোট’, ‘ভোটার তাড়াল পুলিশ’, ‘শুরুর আগেই ভোট শেষ’, ‘শান্তিপূর্ণ ভোট ডাকাতি’, ‘ভোট ডাকাতি ও সহিংসতা: মূল দায় ইসির নেপথ্যে সরকার’, ‘রাতেই কেন্দ্র দখল করে সিল: কারচুপিতে কর্মকর্তাও’ ইত্যাদি। ভোটের সমাপনী পর্বের পর প্রধান নির্বাচন কমিশনারের অনুপস্থিতিতে তাঁর দায়িত্ব পালনকারী নির্বাচন কমিশনার ‘সার্বিকভাবে ভালো ভোট হয়েছে’ বলে দাবি করেন। এ মূল্যায়নটির যৌক্তিকতা তিনিই জানেন।
এর পরদিন তাঁর একজন সহকর্মী গণমাধ্যমে বলেন, ‘মাঠপর্যায়ে কর্মকর্তারা নির্দেশ মেনে কাজ করেননি। এ কারণে কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমাদের যে নির্বাচন হয়েছে, তা খুব সুষ্ঠু হয়েছে, তাতে আমরা সেটিসফাইড—এ কথা বলা যাবে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘এ কথা বলতে দ্বিধা নেই যে আমরা যাঁদের দিয়ে কাজ করিয়েছি, তাঁরা সঠিকভাবে কাজ করেননি।’ একপর্যায়ে তিনি এ-ও বলেন যে ‘যাঁদের দিয়ে কাজ করাব, তাঁরা স্থানীয় প্রশাসন অথবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য না হলেই ভালো হতো।’
সংবাদমাধ্যমে পঞ্চম দফা নির্বাচনের যে চিত্র এসেছে, তৃতীয় ও চতুর্থ দফা কিছুটা তার কাছাকাছিই ছিল। শেষ দফায় ষোলোকলা পূর্ণ হয়েছে। প্রথম আর দ্বিতীয় দফায় অনিয়ম ছিল। তবে তুলনামূলকভাবে অনেক কম। সেসব অনিয়মের বিরুদ্ধে সময়োচিত দৃঢ় কোনো পদক্ষেপ ইসি নেয়নি বলে ব্যাপকভাবে অভিযোগ রয়েছে। ফলে পরবর্তী দফার নির্বাচনগুলোর বেহাল অবস্থা। অবশ্য সরকারি দল নির্বাচন পরবর্তীকালে ‘সুষ্ঠু নির্বাচন’-এর জন্য কমিশনকে অভিনন্দন জানিয়েছে। অন্যদিকে, পঞ্চম দফা নির্বাচনের পর নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারী ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপ মন্তব্য করেছে, ৫৩ শতাংশ ভোট জালিয়াতি হয়েছে। ৫০ শতাংশ ভোটকেন্দ্রে হয়েছে সহিংসতা, ভয়ভীতি দেখানো হয়েছে ৭৬ শতাংশ ভোটারকে। ২০ শতাংশ ভোটারকে ভোট দিতে বাধা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ৫৯ শতাংশ এজেন্টকে কেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়ার বিষয়ও তারা উল্লেখ করেছে।
তাদের মন্তব্য অনুসারে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নির্লিপ্ততা ছিল উল্লেখযোগ্য। ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপের প্রতিবেদনের সঙ্গে কিছুটা মিল রয়েছে উপরোল্লিখিত জনৈক নির্বাচন কমিশনারের হতাশাব্যঞ্জক মন্তব্যগুলোর। গ্রুপটির পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে এমনটা অবশ্য উল্লেখ নেই যে ভোট গ্রহণ কাজে নিয়োজিত কোনো কোনো ব্যক্তি নিজেরা ব্যালট পেপারে সিল মেরে বাক্স ভর্তি করেছেন। এ ধরনের খবর এসেছে অনেক। একটি বাংলা দৈনিকে ছবিসহ প্রতিবেদনে দেখা যায়, লক্ষ্মীপুরে সরকার ও জামায়াত-সমর্থক যথাক্রমে চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থীদের ব্যালট পেপারে সিল মারছেন দুজন নির্বাচন কর্মকর্তা। বাস্তবতা কল্পকাহিনিকেও ছেড়ে যায়, এমনটা আমরা বারবার দেখে আসছি। তাই বিষয়টিতে আদৌ বিস্মিত বা হকচকিত হয়নি অনেকে।
এরপর আলোচনায় থাকে সে নির্বাচন কমিশনারের ‘যাঁদের দিয়ে নির্বাচন করাব, তাঁরা স্থানীয় প্রশাসনে আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য না হলেই ভালো হয়’ বক্তব্যটি। তাঁর অভিযোগ, তাঁরা নির্দেশ মানেননি। অভিযোগ অনেকাংশে সত্য বলেই মনে হয়। তবে বিষয়টির সূচনা প্রথম পর্ব থেকেই। তখন এমন কাজের জন্য কারও বিরুদ্ধে কোনো দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে জানা যায় না। তাই ক্রমবর্ধমান হলো এ প্রবণতা। পাঁচ সদস্যের নির্বাচন কমিশনের প্রধান দ্বিতীয় পর্বের শেষেই ‘ক্লান্তিজনিত কারণে দেড় মাস বিশ্রামের উদ্দেশ্যে’ দেশ ছাড়লেন। এতে আকাশ ভেঙে পড়েনি, এটা সত্য, তবে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় মুহূর্তে কমিশন নেতৃত্বহীন হলো। তিনি থাকলেও ভিন্ন কিছু ঘটত, এমন প্রত্যাশা অনেকেই করে না। যৌথ নেতৃত্বও ঈপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারলে কোনো কথা থাকত না। কিন্তু তারা পৌঁছাতে পারেনি। আবার চেষ্টা করেছে বলেও মনে হয় না। গণমাধ্যম প্রায় একই সুরে এই নির্বাচনটির শেষ তিন পর্বের অব্যবস্থাপনা, সহিংসতা, কেন্দ্র দখল ও ব্যালট পেপারে সিল মারার অভিযোগ নিয়ে সোচ্চার। এর বেশ কিছু অনিয়ম জানা গেল পর্যবেক্ষকদের মন্তব্যে। তদুপরি মন্তব্যটি জোর পেল একজন নির্বাচন কমিশনারের নির্বাচন-পরবর্তী মূল্যায়নে। তৃতীয় পর্বের পরেই এমন মতামত জোরদার হচ্ছিল যে নির্বাচন ব্যবস্থাপনার ওপর কমিশন নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে। এমন মন্তব্য আসার পরও কমিশন নির্বাচন-প্রক্রিয়ার ওপর নিয়ন্ত্রণ জোরদার করতে তৎপর ছিল কি না, তা দুর্বোধ্য। তবে পারেনি যে এটা দিবালোকের মতো স্পষ্ট।
সদ্যসমাপ্ত নির্বাচনটি নিয়ে তর্কবিতর্ক হয়তো অনেক করা যাবে। তবে এটি যে দেশের নির্বাচনব্যবস্থাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলেছে, তা সত্য। ১৯৯১ সালে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় প্রত্যাবর্তনের পর মাগুরা উপনির্বাচন ছাড়া কোনো অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে এমনটি হয়নি। এমনকি বর্তমান সরকারের সময়কালে গত পাঁচ বছরে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন নির্বাচন এ ধরনের বিতর্ক সৃষ্টি করেনি। কিন্তু এবারের নির্বাচনটি কমিশনের সদিচ্ছা কিংবা সক্ষমতার অভাব প্রকটভাবে সামনে নিয়ে এল। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। সমন্বয়হীনতা ও মাঠপর্যায়ে তাদের আওতায় নিয়োজিত মাঠকর্মীদের ওপর কড়া নজরদারির অভাব ছিল। আরও ছিল অনিয়মের অভিযোগ সম্পর্কে ধীরে চলার নীতি। আর সক্ষমতার অভাবই বা থাকবে কেন? সংবিধান ও আইন তাদের প্রভূত ক্ষমতা দিয়েছে। সরকারের কোনো অঙ্গ বা কোনো বিশেষ কর্মকর্তা কমিশনের নির্দেশনা না মানলে সূচনাতেই ত্বরিত ব্যবস্থা নেওয়া যৌক্তিক ছিল। সংবিধান তাঁদের কর্মকালকে সুরক্ষিত করেছে। তাহলে অক্ষমতাটা কোথায় বা কেন, তা কিন্তু বোধগম্য নয়।
স্থানীয় প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার নিষ্ক্রিয়তার জন্য তাদের বাদ দিয়ে নির্বাচন করার কথা বললেন একজন কমিশনার। প্রচলিত প্রেক্ষাপটে এটা অনেকটাই অবাস্তব। পাশাপাশি অপ্রয়োজনীয়ও বটে। এ প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাই একের পর এক সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দিয়েছে জাতিকে। প্রয়োজন তাদের সঠিক পথে পরিচালনার সদিচ্ছা ও সক্ষমতা। একটি মতামত আসছে যে রিটার্নিং অফিসার হিসেবে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের বাদ দিয়ে কমিশন কর্মকর্তাদের বসালে এমনটি ঘটবে না। কিছু ক্ষেত্রে তো কমিশনের কর্মকর্তারা রিটার্নিং কর্মকর্তা ছিলেন। সেখানে কি ভিন্ন কিছু ঘটেছে? রিটার্নিং কর্মকর্তা না রাখলেও স্থানীয় প্রশাসনকে নির্বাচনে সংশ্লিষ্ট রাখতেই হবে। রাখতে হবে স্থানীয় আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকেও। তদুপরি দুর্বোধ্য ঠেকে, গোটা কমিশন যখন গুরুতর আস্থার সংকটে ভোগে, তখন তাদেরই কর্মকর্তারা কীভাবে আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করবেন, এটা ভেবে। এসব মন্তব্য লক্ষ্যে পৌঁছানোর পথে অনাবশ্যক সংশয় সৃষ্টি করে। অকারণ পরীক্ষা-নিরীক্ষা পরিস্থিতি আরও জটিল করতে পারে। যেসব কর্মকর্তা বা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্য কমিশনের নির্দেশনা মানেননি, তাঁদের বিরুদ্ধে দ্রুত দৃষ্টান্তমূলক আইনি ব্যবস্থা নিন। উল্লেখ্য, কমিশনকে সহায়তা করতে সরকারের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা আছে। সে অবস্থান সরকার যাতে মেনে নেয়, তার জন্য আবশ্যক কমিশনের দৃঢ়তা।
রবীন্দ্রনাথ বহুমাত্রিক কল্পলোকে বিচরণ করতেন। এরই ভাব ফুটে উঠত তাঁর বিভিন্ন লেখনীতে। তেমনই হালকা চালের একটি কবিতা ‘জুতা আবিষ্কার’। খেয়ালি রাজা ভাবলেন, তাঁর পায়ে ধুলা লাগা অনাসৃষ্টি। অমাত্যদের নির্দেশ দিলেন ব্যবস্থা নিতে। সমাধানের প্রচেষ্টায় সমবেত হলেন অনেক পণ্ডিত। একের পর এক নিষ্ফল হাস্যকর প্রয়াস চলল। একপর্যায়ে ধরিত্রীকে চর্ম আবরণে ঢেকে দেওয়ার প্রস্তাবও এসেছিল। পরিশেষে সমাধান দিলেন চামার কুলপতি বৃদ্ধ। তিনি বললেন:
‘নিজের দুটি চরণ ঢাকো, তবে/ ধরণী আর ঢাকিতে নাহি হবে।’
আমাদের নির্বাচনব্যবস্থার সংবিধান ও আইনি বিধান আর প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোও পরীক্ষিত ও কার্যকর। শুধু প্রয়োজন এগুলোর সুষ্ঠু প্রয়োগ। এর দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। নিজেদের ক্ষমতাটুকু কার্যকর ও দৃশ্যমানভাবে প্রয়োগ করলেই সমাধান মিলবে। অন্য কোনোভাবে নয়।

আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
[email protected]