একটুখানি নারায়ণ দেবনাথ

.
.

নারায়ণ দেবনাথের পৈতৃক নিবাস ছিল বাংলাদেশের মুন্সিগঞ্জের বিক্রমপুরে। জন্ম ভারতের হাওড়া জেলার শিবপুরে, ১৯২৫ সালে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে ভর্তি হন ইন্ডিয়ান আর্ট কলেজের পেইন্টিং বিভাগে। যুদ্ধের ডামাডোলে শেষ পর্যন্ত পড়াশোনা শেষ করতে পারেননি। কিন্তু তত দিনে অপার উৎসাহে রপ্ত করেছেন আঁকাআঁকির যাবতীয় কলাকৌশল আর দর্শন। বিশ্বযুদ্ধ শেষে রপ্ত করা আঁকিবুঁকির পসরা নিয়ে ভাগ্যের খোঁজে নেমে পড়েন ইন্ডাস্ট্রিতে। কিন্তু খুঁজে পেতে মনের মতো কাজ দূরে থাক, কোনো রকমে খেয়ে-পরে টিকে থাকার মতো আঁকাআঁকির কাজ পেতেও বেশ বেগ পেতে হয় তাঁকে। ওদিকে পণ করেছেন, শিল্পীজীবনই কাটাবেন আমরণ। অবশেষে প্রসাধনসামগ্রীর লোগো, মাস্টহেড আর সিনেমা কোম্পানির বিভিন্ন লিফলেটের কাজ জুটতে লাগল টুকটাক করে। কাজের মান দেখে বাজারে নাম ছড়িয়ে পড়তে মোটেই দেরি হয় না তাঁর। তারপরও মন ভরছিল না।
এর মধ্যে ত্রিবেণীর বাংলা অনুবাদে ছাপা হয়েছে তাঁর একটা অলংকরণ। মনেপ্রাণে চাইতেন যেন সে ধরনের কিছুই করা যায় তারপর থেকে। ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ হাতে এসে যায় শুকতারা পত্রিকা। অত সুন্দর একটা পত্রিকাতেই যেন তাঁর কাজ করার কথা। বছর দুয়েক পরে মিলে যায় সুযোগ। কলেজ স্ট্রিটের বইপাড়ায় ঘুরতে গিয়ে জানলেন, শুকতারা বের করে দেব সাহিত্য কুটির নামে একটি প্রকাশনা সংস্থা। সেটার কর্ণধার সুবোধ মজুমদারের সঙ্গে পরিচয়ও হয়ে গেল সেই প্রকাশনার প্রুফ রিডারের সহায়তায়। সে সময় সুপ্রতিষ্ঠিত এই হাউসটির প্রকাশক সুবোধ মজুমদার রত্নœ চিনতে ভুল করেননি। প্রথম দেখাতে তাঁকে ধরিয়ে দেন তিনটি অলংকরণের কাজ। আর কাজ জমা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই হাতে পান পারিশ্রমিক। নারায়ণ দেবনাথ সেই দিনই জেনে গেলেন, বাকি জীবনে তিনি আসলে কী করতে চান। তখন তাঁর বয়স মাত্র ২৫।

.
.

দেব সাহিত্য কুটিরের সুবোধ বাবুর ছোট ভাই ক্ষিরোদ বাবু একদিন নারায়ণ দেবনাথকে বললেন, বাংলায় প্রায় অনুপস্থিত যে গ্যাগ ধরনের মজার কমিকস, সেটা তিনি করতে চান কি না। ব্যাপারটা ভালো লেগে যায় তাঁর। মাথায় তো সেই ছোটবেলার শিবপুরের রকে বসে দেখা পাড়াতো কিশোরদের দুষ্টুমিগুলো ছিলই। সেগুলো মিলিয়ে-ঝিলিয়ে ১৯৬২ সালে শুকতারা পত্রিকায় এঁকে ফেলেন ‘হাঁদা ভোঁদার জয়’ নামে ‘হাঁদা ভোঁদা’র প্রথম কমিকস। সে সময় কে জানত, সেই ছিল বাংলা কমিকসের এক নতুন ইতিহাসের শুরু!
তারপর একে একে ‘বাঁটুল িদ গ্রেট’ আর ‘নন্টে ফন্টে’ও বের হতে লাগল। ব্যাপক জনপ্রিয়তার দাবিতে সেগুলো আর থেমেও থাকেনি কখনো। সেই যে ‘হাঁদা ভোঁদা’র জয়যাত্রা শুরু হলো, তা পরে এসে পরিণত হয়েছে নারায়ণ দেবনাথের জয়যাত্রায় এবং শেষে এসে ঠেকেছে বাংলা কমিকসের জয়যাত্রা হিসেবে। একহাতে এমন করে একটা ভাষার কমিকসকে একটানা একটা অন্য মাত্রায় নিয়ে যাওয়া ও ভিত গড়ে দেওয়া দুর্লভ। দীর্ঘ জীবন একাগ্রচিত্তে এমন করে একটা বিষয়ে নিজেকে নিবেদন নিতান্তই যোগীর কাজ। এই কমিকস-যোগী যদিও নিজেকে কার্টুনিস্ট বা কমিকস আর্টিস্ট বলার চেয়ে শিশুসাহিত্যিক বলতেই বেশি পছন্দ করেন। আর তা হবেই-বা না কেন? তিনি কী লিখছেন না? বরং লেখার পর সেই গল্প এঁকেও দিচ্ছেন। এ তো ডবল সাহিত্য, লেখায় ও রেখায় সাহিত্যের চর্চা। তারই স্বীকৃতিস্বরূপ একে একে মিলেছে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার, বিদ্যাসাগর পুরস্কার আর পশ্চিমবঙ্গের সব থেকে বড় সম্মান বঙ্গবিভূষণ—সোজা কথা জীবদ্দশায় যে কটা স্বীকৃতি পাওয়ার, অবশেষে এসে মিলেছে সবই। কিন্তু এই নির্লিপ্ত ধ্যানী মানুষটার তা নিয়ে অতি উচ্ছ্বাস নেই। যেমন এর আগে না-পাওয়া নিয়েও ছিল না তেমন কোনো অভিযোগ। মানুষকে হাজার হাজার পৃষ্ঠা আনন্দ বিলিয়েই যেন তাঁর নির্বাণ।