জীবনানন্দ দাশ ও বরিশালের লাল গির্জা

বরিশাল অক্সফোর্ড মিশনের শতবছরের পুরোনো লাল গির্জা
বরিশাল অক্সফোর্ড মিশনের শতবছরের পুরোনো লাল গির্জা

কথিত আছে, কবি জীবনানন্দ দাশের সঙ্গে তাঁর প্রথম প্রেমিকা মুনিয়ার দেখা মেলে বরিশালের অক্সফোর্ড মিশনের গির্জায়। মুনিয়ার মা এই গির্জায় সেবিকার কাজ করতেন। শুধু কি তাই? বরিশালের এই পুরোনো গির্জাটির সঙ্গে জীবনানন্দের সম্পর্কও ছিল নিবিড়। ছাত্রাবস্থায় অক্সফোর্ড মিশনের ছাত্রাবাসে থাকতেন তিনি। ফলে এখানকার ফাদার ও মাদারদের সঙ্গেও ছিল তাঁর ঘনিষ্ঠতা। আচ্ছা, হঠাৎ গির্জা নিয়ে এত কথা কেন? কারণ আছে। গির্জাটি যে ১০০ বছরের পুরোনো। আর এর সঙ্গে যে জড়িয়ে আছে জীবনানন্দ দাশের নাম। জীবনানন্দের বাড়ি থেকে দু-কদম এগোলেই গির্জাটির সীমানা। তবে এ গির্জার আছে একটি কেতাবি নাম—এপিফানি উপাসনালয়। কিন্তু বরিশালবাসী আজও এটিকে চেনেন অক্সফোর্ড মিশনের ‘লাল গির্জা’ হিসেবেই।

১৯০৪ সালে তৈরি হওয়া গির্জাটির নির্মাণশৈলীতে রয়েছে নানা বৈচিত্র্য ও শিল্পসৌকর্য। ধানসিঁড়ি নদী থেকে একটু পূর্ব দিকে এগোলেই চোখে পড়বে পামগাছ ঘেরা অক্সফোর্ড মিশন। গাছের ফাঁক দিয়ে তাকালেই দেখা যাবে টেরাকোটা রঙের সুউচ্চ আর্চওয়ে চার্চ।

প্রতিষ্ঠার অনেক আগে থেকে ফাদার স্ট্রং এবং তখনকার (সিস্টার) মাদার এডাহ এ গির্জার নকশা কী হবে তা নিয়ে ভাবছিলেন। একপর্যায়ে মূল নকশা করেন ফাদার স্টং, এবং নকশাটি আঁকায় ফুটিয়ে তোলেন মাদার এডাহ। তাঁদের দুজনের এই চিন্তা বাস্তবে রূপ দেন ইংল্যান্ডের স্থপতি ফিলিপ থিকনেস। ওই সময় বরিশাল নগরের প্রাণকেন্দ্রে গড়ে উঠতে শুরু করে এশিয়ার ব্যতিক্রমী এই গির্জা। এর পাশেই রয়েছে একটি বেল টাওয়ার। মূল গির্জার আদলেই গড়ে তোলা বেল টাওয়ারটিতে দিনে চারবার প্রার্থনার পাঁচ মিনিট আগে ঘণ্টাধ্বনি বাজানো হয়। ঘণ্টাধ্বনির শব্দ শুনে ভক্তরা এখানে আসেন প্রার্থনার জন্য। জানা যায়, সে সময় বেল টাওয়ারের বেল স্থাপনের খরচ বহন করেন ফাদার স্ট্রং। তিনি ছিলেন বিখ্যাত ক্রীড়াবিদ। বিভিন্ন খেলায় পাওয়া তাঁর সম্মানী পুরস্কারের অর্থ দিয়ে তিনি স্থাপন করেন ওই বেল।

লাল গির্জার আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, এটি এমনভাবে নির্মাণ করা হয়েছে, যেন কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগেও এর স্থাপত্যশৈলী বিনষ্ট না হয়। ১৯৬০ ও ১৯৭০ সালের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে বরিশাল অঞ্চলে ১০ লাখ মানুষ মারা যায়। ওই সময় ধ্বংস হয়ে যায় বরিশালের অসংখ্য ভবন। গির্জাটি অক্ষত দাঁড়িয়ে ছিল তখনো।

মজার ব্যাপার হলো, এর সব নির্মাণসামগ্রীই বাংলাদেশের। শুধু ভেতরে চারটি বেদির মার্বেলপাথর আনা হয়েছিল ভারতের কলকাতা থেকে। এ ছাড়া বড় ক্রুশটি আনা হয় প্যালেস্টাইনের বেথলেহেম থেকে। এটি নির্মিত হয়েছিল দেশীয় মাটি দিয়ে তৈরি আস্তনে পোড়া লাল শক্ত ইট দিয়ে। এর সঙ্গে রড, বালু, সিমেন্ট, কাঠ এবং নির্মাণশ্রমিক সবই বাংলাদেশের। আজও এর আদি ও অকৃত্রিম রূপের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি।

বরিশালের প্রাণকেন্দ্র জীবনানন্দ দাশ সড়কে অবস্থিত শতবর্ষী এই গির্জাটির সঙ্গে জীবনানন্দের কতটা সখ্য ছিল, তাঁর প্রথম প্রেমিকা মুনিয়ার সঙ্গে আদৌ কি দেখা হয়েছিল এখানে? এসব প্রশ্নের সামনে এ উপাসনালয়টি আজও দাঁড়িয়ে আছে, দাঁড়িয়ে আছে ‘লাল গির্জা’ হিসেবে।