আলো ফুটবেই

এস এম আলমগীর হোসেনের ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি থেকে বই সংগ্রহ করছে আগ্রহী পাঠকেরা।  ছবি: সাদ্দাম হোসেন
এস এম আলমগীর হোসেনের ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি থেকে বই সংগ্রহ করছে আগ্রহী পাঠকেরা। ছবি: সাদ্দাম হোসেন

সারি সারি বাঁশঝাড়ের বুক চিরে সাপের মতো আঁকাবাঁকা সরু রাস্তা। সে রাস্তা ধরে ভ্যান নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন একজন চালক। পরনে জিনসের প্যান্ট, গায়ে রঙিন টি-শার্ট, তার ওপর জ্যাকেট চাপানো। পরিপাটি এই মানুষ যে ভ্যান চালাচ্ছেন, সেটিও একটু অন্য রকম। ভ্যানের ওপর দিকটায় কাচ দিয়ে ঘিরে ও টিনের ছাউনি দিয়ে ঘরের মতো বানানো। সেই কাচের ঘরের গায়ে জ্বলজ্বলে একটি সূর্যের মধ্যে লেখা ‘আলো ফুটবেই’।

এই ভ্যানটির চালকের নাম এস এম আলমগীর হোসেন। খুলনার রূপসা উপজেলার ৩ নম্বর নৈহাটি ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের নির্বাচিত ইউপি সদস্য। গ্রামের মানুষকে বই পড়ানোর মাধ্যমে আরও সচেতন করার জন্য ভ্যানটিকে তিনি বানিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ পাঠাগার। চালান তিনি নিজেই। তাঁর এই ভ্যানে থরে থরে সাজানো নানা রকম বই। সঙ্গে বাঁধানো খাতা, দিস্তা কাগজ, কলম, চকলেটের বয়াম। এগুলোর পাশাপাশি আছে নাগরিক সনদ, জন্মনিবন্ধনসহ নানা রকম আবেদন ফরম। এই নাগরিক সেবা শুধু তাঁর নিজের ওয়ার্ডের মানুষ ছাড়াও আশপাশের কয়েকটি ওয়ার্ডের কিছু মানুষ পায়।

১৯৯৯ সালে নৈহাটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন এস এম আলমগীর হোসেন। খুলনা সরকারি বিএল কলেজ থেকে ইসলামের ইতিহাসে স্নাতক হন ২০১০ সালে। এরপর স্নাতকোত্তর আর পড়া হয়নি। তিন ভাইবোনের সবার বড় আলমগীরের বয়স এখন ৩৩ বছর। সম্প্রতি বিয়ে করেছেন। জনগণের সেবার পাশাপাশি অনুষ্ঠান ব্যবস্থাপনা এবং মাটির টালির ব্যবসা করেন। এসবের আয় থেকেই নানা রকম সেবামূলক কাজের খরচ করেন।

শুরুর ভাবনা
ইউপি সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় এলাকার মাদক ব্যবসা পুরোপুরি নির্মূল করে ফেলেন আলমগীর। তিনি বলেন, ‘গ্রামের ৯০ শতাংশ মানুষ অসচেতন। বর্তমান প্রজন্মের বেশির ভাগই স্মার্টফোনে অলস সময় কাটায়। তাদের বই পড়ানোর ক্ষেত্রে উৎসাহিত করতে পারলে কাজে আসবে। কিন্তু যদি বই পড়ার জন্য ডাকি তবে কেউ আসবে না। তাই তাদের কাছে বই নিয়ে যাই।’

এই ভাবনা থেকেই নিজ উদ্যোগে ভ্যান তৈরি করেন আলমগীর। গত বছরের ২৬ এপ্রিল ৩০টি বই দিয়ে শুরু এই ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরির। বই পড়ে অর্জিত জ্ঞান সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারলে আলো ফুটবেই। তাই এর নাম দেওয়া হয়েছে আলো ফুটবেই।

সপ্তাহের বেশির ভাগ দিন নিজেই ভ্যান নিয়ে বেরিয়ে পড়েন এই জনপ্রতিনিধি। বললেন, ‘যতটুকু সময় পাই তা এর পেছনে ব্যয় করি। মঙ্গল ও বৃহস্পতিবার পরিষদে সভা থাকে। গ্রাম আদালতের কারণে জনপ্রতিনিধিদের সালিসের কাজ করা লাগছে না। তাই এখন কাজ অনেকটা সহজ হয়েছে। একেক দিন একেক পাড়ায় যাই। ভ্যানটি থাকে ইউপি ভবনে।’ দিনের নানা কাজ সেরে বিকেল চারটার পর থেকে আলমগীর বই দেওয়ার কাজ শুরু করেন। চলে প্রায় সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত। এখন তাঁর ভ্যানে বইয়ের সংখ্যা ১৬০।

ভ্যান নিয়ে ছুটেছেন আলমগীর হোসেন
ভ্যান নিয়ে ছুটেছেন আলমগীর হোসেন

ভ্যানে চলমান এই লাইব্রেরির একেকটা বই এক সপ্তাহের জন্য দেওয়া হয়। শুরুর দিকে একটি খাতায় পাঠকের মোবাইল ফোন নম্বর লিখে তাঁকে বই দেওয়া হতো। এখন সদস্য কার্ড দেওয়া হচ্ছে। বর্তমানে সদস্য ৩৫০ জনের বেশি। তবে আগামী মার্চে আরও দুটি ভ্যান ও নতুন বই কেনার পরিকল্পনা করেছেন বলে জানালেন আলমগীর।

নৈহাটি ইউনিয়ন পরিষদসংলগ্ন চায়ের দোকানে কথা হয় মো. মোকসেদ শেখের (৫০) সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আলমগীর মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। বিপদে-আপদে সব সময় পাশে পাওয়া যায়। নতুন ধরনের কাজ ওর মাথা থেকে আসে।’

কিছুদিন আগে এক বিকেলে এই বই ও সেবা ফরম বিতরণের সময় দেখা হলো। আলমগীর নিজেই ভ্যান চালাচ্ছেন। চলার পথে এলাকার নানা বয়সী মানুষ তাঁর সঙ্গে কুশল বিনিময় করছেন। ভ্যানটি নৈহাটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মোড়ে যেতেই জনা বিশেক মানুষ ভ্যানটি ঘিরে ধরেন। এঁদের মধ্যে বেশির ভাগই শিক্ষার্থী। কেউ নতুন সদস্য ফরম নিচ্ছেন, কেউ আগের নেওয়া বই ফেরত দিয়ে নতুন বই নিচ্ছেন। কেউ এসেছেন পরামর্শ নিতে।

খুলনার সুন্দরবন সরকারি আদর্শ কলেজের স্নাতক শ্রেণির শিক্ষার্থী মো. রেজাউল করিম বলেন, ‘সপ্তাহে দুবারও বই নিয়ে পড়ি। নতুন নতুন বই পড়তে পারি। আগে এটা সম্ভব ছিল না। সব সময় তো সব বই কিনে পড়া সম্ভব হয় না। বিভিন্ন নাগরিক সেবাও মেলে এই ভ্যানে। এককথায় অসাধারণ।’

সেদিন এসেছিল ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী হ্যাপী হাসান। হ্যাপী বলল, ‘সদস্য হলাম। নতুন নতুন বই পড়া যাবে। ভালো লাগছে।’

কিছুক্ষণ পর ভ্যানটি যায় নৈহাটি দক্ষিণপাড়া এলাকায়। যাওয়ার পথে ভ্যান দাঁড় করিয়ে একটা বই চাইলেন ৬০ বছর বয়সী মো. আবদুর শুকুর খালেক। তিনি বললেন, ‘বয়স হয়েছে। তবে বই থেকে যদি নতুন কোনো জ্ঞান পাওয়া যায়, তবে সেটা অনেক ভালো। তাই বই পড়তে চাই।’ নৈহাটি দক্ষিণপাড়ার গৃহিণী আফরোজা আক্তার বলেন, ‘তিন-চারটা বই পড়েছি। এখন পড়তে ভালোই লাগে। আমাদের গ্রামে ২০ হাজার মানুষের বাস। আলমগীর বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলছেন।’

এস এম আলমগীরের স্বপ্ন অবশ্য আরও বড় কিছু করা। তিনি স্বপ্ন দেখেন নৈহাটি একটা আধুনিক গ্রাম হবে। গ্রামের মানুষ পাবে আধুনিক সকল সুযোগ-সুবিধা। মননের আলো আর আধুনিকতার মিশেলে তাঁর গ্রামের মানুষগুলোও হবে অনন্য।