'কলেজ ছুটি হলে একটুও দেরি করত না মিম'

মা রোখসানা বেগমের সঙ্গে মেয়ে দিয়া খানম মিম। ছবি: সংগৃহীত
মা রোখসানা বেগমের সঙ্গে মেয়ে দিয়া খানম মিম। ছবি: সংগৃহীত

এই বুঝি ছুটির ঘণ্টা বাজল। হাসিখুশি মেয়েটা হয়তো সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামছে। কলেজের সবুজ ঘাসের আঙিনা পেরিয়ে প্রতিদিনের মতো এসে দাঁড়িয়েছে মূল ফটকে। ছুটির কোলাহলের মধ্যে বন্ধুদের কাছে বিদায় নিয়ে গুটিগুটি পায়ে হেঁটে গেল আরেকটু সামনে, একেবারে প্রধান সড়কের ধারে যাত্রীছাউনিতে। চোখ বন্ধ করলেই মেয়ের বাসায় ফেরার এই চিত্রটা দেখতে পান বাসচাপায় নিহত শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের শিক্ষার্থী দিয়া খানম মিমের মা রোখসানা বেগম।

রোখসানা বেগমের চোখ দুটো ফুলে আছে। দিয়ার কথা উঠতেই শোকে মুহ্যমান মা যেন আর স্তব্ধ হয়ে গেলেন। অনেকটা বাক্‌শূন্য হয়ে এক দৃষ্টিতে দেয়ালের দিকে তাকালেন। তারপর অস্ফুট স্বরে রোখসানা বেগম বলে চললেন, ‘আমি তো ওর সবকিছু অনুভব করতে পারি। খুব বন্ধুবৎসল ছিল মেয়েটা। কলেজজীবনটাকে উপভোগ করছিল সে। কিন্তু কলেজ ছুটি হলে একটুও দেরি করত না, বাড়ির বাস ধরে চলে আসত বাসায়।’

গত ১ জুলাই একাদশ শ্রেণির ক্লাস শুরুর পর টানা কয়েক দিন মেয়েকে কলেজে পৌঁছে দিয়েছেন রোখসানা বেগম। কলেজ ছুটি হওয়া অবধি অপেক্ষা করেছেন। তারপর মা-মেয়ে একসঙ্গে ফিরেছেন বাসায়। এভাবে কিছুদিন যাতায়াতের পর দিয়া নিজেই মাকে বলেছিল, ‘মা, তোমাকে আর কষ্ট করে আমাকে কলেজে আনা-নেওয়া করতে হবে না। আমি তো একাই পারব, বড় হয়েছি না।’

রোখসানা বেগম মেয়ের কথা শুনে হেসেছিলেন। যে মেয়ে খেলনা দেখলে এখনো ছেলেমানুষি করে, নিজের হাতখরচ বাঁচিয়ে এখনো তো প্রিয় কোনো খেলনা কিনে আনে। তিনি তো জানেন, তাঁর মেয়ে কতটা বড়! এই তো সেদিনও নাকি ম্যাজিক বল কিনে এনেছিল দিয়া। খুদে রংবেরঙের বলগুলো পানিতে রাখলেই বড় হতে থাকে। রঙিন বল। ঠিক যেন মিমের রঙিন স্বপ্নগুলোর মতো।

দিয়া খানম মিম
দিয়া খানম মিম



সেদিন মেয়ের মুখে সাহসী কথা শুনে আর কলেজে পৌঁছে দিতে যাননি রোখসানা বেগম। তবে বাসে তুলে দিয়ে আসতেন প্রতিদিন। যেমন তুলে দিয়েছিলেন ২৯ জুলাই সকালেও। মহাখালী ফ্লাইওভারের নিচে সেই বাসে উঠেই মেয়ে রোখসানা বেগমকে বলেছিল, ‘আল্লাহ হাফেজ মা, সাবধানে যাও।’ বিলাপ করার মতো রোখসানা বেগম বলতে থাকেন, ‘বিশ্বাস করেন, আমার মন বলছিল মিমের সঙ্গে যাই, কেন এমন করছিল তা এখন বুঝতে পারছি।’ সেদিন মিম যে বাসে উঠেছিল, সে বাসের পিছে পিছে আরও খানিকটা পথ গিয়েছিলেন রোখসানা বেগম। তারপর মন খারাপ করে বাসায় ফিরেছেন। সংসারের দৈনন্দিন কাজ সেরেছেন। রান্না করেছেন। তারপর দুপুরের খাবার নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন দিয়ার জন্য। ‘সেদিন ক্লাস আগেই শেষ হবে জানতাম। তাই বাসা থেকে টিফিন নেয়নি। বন্ধুদের সঙ্গে শিঙাড়া খাবে বলেছিল। আমি খাবার নিয়ে বসে ছিলাম।’ কিন্তু মায়ের সেই অপেক্ষা যে এত দীর্ঘ হবে তা কে জানত?

রাজধানীর মহাখালীর আইসিডিডিআরবি হাসপাতালের পাশ দিয়ে একটা সরু পথ চলে গেছে সামনের দিকে। এই পথ ধরে খানিকটা এগিয়ে গেলেই মহাখালী দক্ষিণপাড়া এলাকা। জানা ছিল, দক্ষিণপাড়ার বড় মসজিদঘেঁষা গলিটাতেই দিয়াদের বাসা। মসজিদের সামনে একজন স্কুলছাত্রকে জিজ্ঞেস করতেই বাকি পথটুকু চিনিয়ে দিল। সকাল সাড়ে ১০টায় যখন দিয়াদের বাসায় হাজির হয়েছি, স্বজনেরা তোড়জোড় করছিল দিয়ার মা-বাবা-ভাইবোনদের তৈরি করে দিতে। বাইরে শিক্ষা ভবন থেকে আসা একটি গাড়ি অপেক্ষা করছে। ২ আগস্ট সকালে এই গাড়িতেই তারা গিয়েছিল শিক্ষা ভবনে। সেখান থেকে তাঁদের নিয়ে যাওয়া হয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে।

এই ফাঁকেই সেদিন কথা হচ্ছিল দিয়ার মায়ের সঙ্গে। দুই কামরার বাসাজুড়ে দিয়ার স্মৃতি মিশে আছে। বলছিলেন, ‘মেয়ে দুটো আমার সঙ্গে বন্ধুর মতো মিশত। কলেজে কী হয়, সব এসে আমাকে বলত। দিয়ার স্বপ্ন ছিল ব্যাংকার হওয়ার। আমার মেয়েটা...।’ কাঁদতে থাকেন রোখসানা বেগম। পাশের স্বজনেরা এসে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু সন্তানহারা মাকে কী বলে সান্ত্বনা দেবেন তাঁরা। মৃদু স্বরে কথা বলা রোখসানা বেগমের ভেতরের ক্ষোভটা ঠিক তখনই যেন বেরিয়ে এল, ‘আমি দিয়ার হত্যাকারীর বিচার চাই, আমার মেয়ের হত্যাকারীদের ফাঁসি চাই।’

একজন সন্তানহারা মাকে কোন শব্দে সান্ত্বনা দিতে হয়, আমাদেরও তা অজানা। দিয়ার মায়ের শোকাতুর ক্ষোভটা আমাদের মনে ছুঁয়ে যায়। বিষাদভরা মন নিয়ে বেরিয়ে আসি। বাইরে তখন অঝোরে বৃষ্টি ঝরছে। মনে হলো, এও কি বিষাদের বারিধারা?