সেন্ট কিটসে প্রিন্সেস ডায়ানার খোঁজ

সেন্ট কিটসে মেয়ে আলায়নার সঙ্গে ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান। ছবি: সংগৃহীত
সেন্ট কিটসে মেয়ে আলায়নার সঙ্গে ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান। ছবি: সংগৃহীত

ডানামেলা উড়োজাহাজটা তখনো সেন্ট কিটসের আকাশে ভাসছে। গায়ানা থেকে সেন্ট কিটসের এই যাত্রাপথে মাশরাফি বিন মুর্তজার উচ্ছ্বাস ছিল দেখার মতো। এই উচ্ছ্বাস প্রকৃতিকে ভালোবাসার; ক্যারিবীয় দ্বীপগুলোর মধ্যে সেন্ট কিটসই যে বেশি পছন্দ অধিনায়কের।

সেন্ট কিটস দ্বীপটা কেমন? কয়েক দিন ঘুরেফিরে সবচেয়ে সহজ উপমাটি মনে হচ্ছিল, ‘ছবির মতো সুন্দর!’ প্রকৃতি কতটা সুন্দর হতে পারে, এই দ্বীপে না এলে বোঝা যাবে না। দ্বীপটা বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের কাছে আরও উপভোগ্য হয়ে উঠেছে, কারণ এবার ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজ জয় এখানেই। চোখজুড়ানো প্রকৃতির সঙ্গে এখানকার মানুষের সম্পর্ক ভীষণ সৌহার্দ্যপূর্ণ। প্রকৃতি আর মানুষের মিতালিতে সেন্ট কিটস যেন ভূস্বর্গ!

ধারাভাষ্যকার আতহার আলী খান সেই ভূস্বর্গ দেখে এতটাই মুগ্ধ, সেদিন আপন মনে বলতে থাকলেন, ‘মনে হয়ে এই সৌন্দর্য দেখতে দেখতে জীবনটা পার করে দিই। কেন যে মানুষ স্বার্থের দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে। অহেতুক হানাহানি, মারামারি করে। আরে ভাই, এখানে এসে একবার দেখুন, পৃথিবীটা কত সুন্দর! এই সুন্দরে ডুব দিলে মনে কোনো অসুন্দর জায়গা পাবে না।’

সেন্ট কিটস খুবই ভালো লাগে সাকিব আল হাসানেরও। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলতে তো আসেনই। ক্যারিবীয় প্রিমিয়ার লিগ (সিপিএল) খেলতেও এখানে বছরে বেশ কয়েকবার পা পড়ে বিশ্বসেরা অলরাউন্ডারের। এবার পরিবারকে নিয়ে তিনি বেশ উপভোগ করছেন অদ্ভুত সুন্দর দ্বীপটা। গত ২৯ জুলাই যেমন স্ত্রী উম্মে আহমেদ আর কন্যা আলায়নাকে নিয়ে চলে গেলেন পারখায়েট রিসোর্টে। আটলান্টিক মহাসাগরের তীরে বসে দেখলেন শতাব্দীর দীর্ঘতম পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণ। সাকিব পরিবারের সঙ্গে ছিলেন আতহার আলীও।

যে বাড়িতে পা পড়েছিল প্রিন্সেস ডায়ানার
যে বাড়িতে পা পড়েছিল প্রিন্সেস ডায়ানার

দলের জন্য নির্ধারিত হোটেলটা যে সড়কে, সেই ফ্রিগেট বে ধরে যেতে হয় সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৫০ মিটার ওপরে সাউথ বে পেনিনসুলায়। এ জায়গাটায় পা রাখলে বিস্ময়ে হাঁ হয়ে যেতে হয়! সাউথ বে পেনিনসুলা হচ্ছে আটলান্টিক ও ক্যারিবীয় সাগরের মিলনস্থল। বাঁয়ে আটলান্টিক, ডানে ক্যারিবীয় সাগর। সমুদ্র আর মহাসমুদ্র একসঙ্গে দেখার কী যে রোমাঞ্চ, সীমিত শব্দে বোঝানো কঠিন।

সমুদ্রের সৌন্দর্যের সঙ্গে সময়টা আরও উপভোগ্য করে তোলে শিপরেক কিংবা র‍্যাগে বিচ। ভালো লাগে সেন্ট কিটসের একেবারে মাঝখানে অবস্থিত সেন্ট জর্জেস অ্যাংলিকান গির্জা কিংবা পোর্ট জানতের বৈচিত্র্যও। সেন্ট কিটসে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশি তৌহিদুল ইসলামের কাছে জানলাম, ‘শিপ ডেতে পর্যটকদের ভিড়ে পোর্ট জানতের ধারেকাছে ঠিকমতো দাঁড়ানোই কঠিন। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা—এসব দেশে থেকে ছেড়ে আসা প্রমোদতরিগুলো আরও কয়েকটা ক্যারিবীয় দ্বীপ হয়ে নোঙর করে এ বন্দরে। যে সময়টাতে বন্দরে অবস্থান করে জাহাজগুলো, পোর্ট জানতে হয়ে ওঠে প্রাণচঞ্চল, শান্ত দ্বীপের সবচেয়ে ব্যস্ততম স্থান। 

নীল জলে ভাসি
নীল জলে ভাসি


ইগলে চড়ে নেভিসে
সেন্ট কিটসকে যদি ছবির মতো সুন্দর বলা হয়, নেভিস কী? ৩০ জুলাই সমুদ্রবিহারে বেরিয়ে এ প্রশ্নটাই বারবার মনে হলো। বলে রাখা ভালো, ক্যারিবীয় দ্বীপে এসে যদি সমুদ্রাভিযানে না বের হন, তাহলে ওয়েস্ট ইন্ডিজে আসাটাই বৃথা! সকাল সাড়ে ৯টায় সেন্ট কিটসের পোর্ট জানতে মেরিনা থেকে ‘ইগল’ নামের নৌযানে শুরু হলো সমুদ্রবিহার। গন্তব্য সেন্ট কিটসের আরেকটি দ্বীপ ৯৩ বর্গকিলোমিটারের নেভিসে।

মাঝে ‘শিটেন বে’তে যাত্রাবিরতি। ইগলের ক্রুদের রসাল কথা ভীষণ উপভোগ্য করে তুলল সমুদ্র-দর্শন। শিটেন বেতে যখন স্নরকেলিং শেষ, এক ক্রু জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার নাকেমুখে পানি ঢোকেনি তো?’ কেন এ প্রশ্ন, জানতে চাইলে অবাক হওয়ার ভঙ্গি করলেন, ‘আরে বের নাম যে “শিট”, ভুলে গেলে!’

ক্রুর রসিকতায় হাসিটা আরও বাড়ল শিটেন বের স্বচ্ছ জলরাশি দেখে। এই পানিতে ‘শিট’ কেন, একটা সুতা ভাসলেও তো দেখা যাবে! স্বচ্ছ জলে রঙিন মাছগুলো যেভাবে খেলে বেড়াচ্ছিল, মনে হলো বিরাট এক অ্যাকুরিয়ামে চলে এসেছি! 

মেঘ ছুঁয়েছে দূর দ্বিপটাকে
মেঘ ছুঁয়েছে দূর দ্বিপটাকে


প্রিন্সেস ডায়ানার খোঁজে
ঘণ্টা দু-এক যাত্রা শেষ ইগল যখন নেভিসের তীরে নোঙর করল, আশ্চর্য চোখে দ্বীপটা সবাই দেখছিল। বালুকাবেলায় খানিকটা সময় কাটিয়ে দুপুরের খাবার খেতে খেতে বাংলাদেশ থেকে আসা তিন সাংবাদিক আর ইলেকট্রনিক পণ্য তৈরির প্রতিষ্ঠান ‘মিনিস্টার’-এর চেয়ারম্যান রাজ্জাক খানকে হঠাৎ দারুণ এক প্রস্তাব করলেন সম্প্রচার দলের ব্যবস্থাপক তানভীর আহমেদ, ‘চলুন ডায়ানার রিসোর্ট দেখে আসি।’

প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তো আছেই, নেভিস বিখ্যাত হয়ে আছে প্রিন্সেস ডায়ানার কারণেও। ১৯৯৩ সালের জানুয়ারিতে বড়দিনের ছুটিতে দুই ছেলে উইলিয়াম আর হ্যারিকে নিয়ে সপ্তাহখানেক অবকাশ কাটাতে এসেছিলেন এই দ্বীপে। ডায়ানা উঠেছিলেন মন্টেলিয়ার প্ল্যান্টেশন ইনে। সেই থেকে এই রিসোর্ট বিখ্যাত হয়ে গেছে। পর্যটকেরা নেভিসে এলে এই রিসোর্টে একবার ঢুঁ মারবেনই।

সাউথ বে পেনিনসুলা—বাঁয়ে আটলান্টিক, ডানে ক্যারিবীয় সাগর। ছবি: লেখক
সাউথ বে পেনিনসুলা—বাঁয়ে আটলান্টিক, ডানে ক্যারিবীয় সাগর। ছবি: লেখক

২০ মিনিটের যাত্রা শেষে পাহাড়ের গা বেয়ে উঠতে হয় রিসোর্টে। ঠিক জাঁকালো নয়, তবে সবখানে আভিজাত্যের ছোঁয়া। ছোট্ট নিরিবিলি রিসোর্টটা দেখে মনে হবে এটা কোনো অবকাশকেন্দ্র নয়, ডায়ানারই তৈরি রাজবাড়ি!

ডায়ানার স্মৃতিবিজড়িত মন্টেলিয়ার প্ল্যান্টেশন ইন দেখে আবারও ফিরে আসা সেন্ট কিটসে। মনে যে প্রশ্নটা জেগেছিল, সেন্ট কিটসকে যদি ছবির মতো সুন্দর বলা হয়, নেভিস কী? উত্তরটা হচ্ছে, সেন্ট কিটস যদি ছবির মতো সুন্দর হয়, নেভিস হচ্ছে ছবির চেয়ে সুন্দর!