সাহসের জাদুকর

শাহীন রেজা রাসেল। ছবি: সংগৃহীত
শাহীন রেজা রাসেল। ছবি: সংগৃহীত

কৈশোর থেকে নির্মম এক সত্যের সঙ্গে তাঁর পথচলা। তাই বছরখানেক আগে চিকিৎসক যখন বললেন, ‘চিকিৎসাশাস্ত্র অনুযায়ী আপনার রোগটি এখনো দূরারোগ্য।’ শাহীন রেজা রাসেল হয়তো দীর্ঘশ্বাস ছেড়েছিলেন, কিন্তু বাস্তবতাকেও হাসিমুখে মেনে নিয়েছিলেন। সে সময়ও তিনি চিন্তা করছিলেন—কত কাজ, কত স্বপ্ন। অফুরন্ত প্রাণশক্তিতে ভরপুর শাহীন রেজা রাসেল ভাবছিলেন, স্বল্প সময়ের মধ্যেই সব সম্পন্ন করতে হবে। সেদিন কথাগুলো বলার সময় তাঁর মধ্যে দুঃখবোধের লেশমাত্র ফুটে উঠল না। তাঁকে যাঁরা চেনেন, তাঁরা জানেন, সদা হাস্যোজ্জ্বল এই মানুষ তো এমনই।

কথায় কথায় আমরা ফিরে যাই ১৮ বছর আগে। রাসেল তখন নবম শ্রেণিপড়ুয়া দুরন্ত কিশোর। সেই বয়সে কঠিন এক সত্যের মুখোমুখি হলেন তিনি। জানতে পারলেন, তাঁর শরীরে বাসা বাঁধছে ভয়ংকর এক স্নায়বিক রোগ। চিকিৎসাশাস্ত্রে বেকারস মাসকুলার ডিসট্রফি নামের এই রোগের কারণে ধীরে ধীরে পঙ্গু হয়ে যাবেন তিনি। শরীরের সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিকল হতে থাকবে। ভারতের কলকাতার বেলভিউ ক্লিনিকের চিকিৎসক অভিজিৎ চ্যাটার্জি কিশোর
শাহীন রেজার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘যদিও তুমি এখনো অনেক ছোট। তবু সত্যটা তোমাকে বলতেই হবে। তোমার শরীরের সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ
আস্তে আস্তে অকার্যকর হয়ে যাবে। প্রথমে আক্রান্ত হয়েছে তোমার পা, এখনো কোনো উপসর্গ দেখা না দিলেও আস্তে আস্তে তোমার পায়ের শক্তি কমে যাবে, তুমি ১০ বছর পর সম্পূর্ণ পঙ্গু হয়ে যাবে—এরপর শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়াবে এটা। ঘটনাটা খুব ধীরে ধীরে ঘটবে। পৃথিবীর কোথাও এর কোনো চিকিৎসা নেই। মানসিকভাবে তোমাকে প্রচণ্ড শক্ত হতে হবে।’

বিশ্বপরিবেশ দিবসের আয়োজনে
বিশ্বপরিবেশ দিবসের আয়োজনে

শাহীন রেজার পৃথিবীটা দুলে উঠল মুহূর্তে। দেশে ফিরে এলেন একরাশ শূন্যতা নিয়ে। শূন্যতা নয়, যেন মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে। বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে চলা কুমার নদের মতো সময় বয়ে চলে। একা একা হেঁটে বেড়ান নদীর তীর ধরে। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় বন্ধুদের নিয়ে গড়ে তোলা ‘বার্ড ক্লাব’-এর পাখিপ্রেমী সেই কিশোর একা একা কথা বলেন পাখির সঙ্গে। এবার আর বন্ধুদের সঙ্গ ভালো লাগে না। মনে মনে সিদ্ধান্ত নেন চূড়ান্ত কোনো কিছুর। মফস্বল শহরের এক দুরন্ত কিশোরের কাছে নিজের জীবনকে মিথ্যে মনে হলো। তার ক্রমাগত মনে হতে থাকল, কী লাভ আর বেঁচে থেকে? ঠিক সেই সময়ে তার মা তার হাতে তুলে দেন ডেল কার্নেগি রচনাসমগ্র, স্টিফেন হকিংয়ের জীবনী। ধীরে ধীরে নিজেকে ফিরে পেতে শুরু করেন রাসেল।

নির্বিকার সাবলীলতায় জীবনের নির্মম বাস্তবতার গল্প বলতে থাকেন শাহীন রেজা, ‘আমি আমার ভেতরে একধরনের শক্তি পেলাম। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম যেকোনো অবস্থায় জীবনকে উদ্‌যাপন করার। নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখলাম। আমি চিন্তা করলাম, মনের জোর দিয়ে আমি আমার পঙ্গুত্বকে যত দিন পারি ঠেকিয়ে রাখব। আমি ঘুরে দাঁড়াব, আমি হতাশ হব না কোনোভাবেই।’

ডিইউইএসের প্রতিটি আয়োজনে থাকে রাসেলের সরব উপস্থিতি
ডিইউইএসের প্রতিটি আয়োজনে থাকে রাসেলের সরব উপস্থিতি

শুরু হলো তাঁর ঘুরে দাঁড়ানোর সংগ্রাম। পড়াশোনা শুরু করলেন আবার। সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে আরও গভীরভাবে নিজেকে জড়িয়ে ফেললেন। এ সময় দারুণভাবে পেয়ে বসে ভ্রমণের শখ। পঙ্গু হয়ে যাওয়ার আগেই সমগ্র বাংলাদেশ ঘুরে দেখার এক অদম্য নেশায় ছুটে বেড়াতে লাগলেন এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। ২০০৫ সালে ভর্তি হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক-সংস্কৃতির বিস্তৃত পরিধি তাঁর সংগ্রাম আর স্বপ্নের পালে যেন জোর হাওয়া দেয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর নিজ জেলা মাগুরা থেকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসা তরুণদের নিয়ে গড়ে তোলেন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও শিক্ষামূলক সংগঠন ‘প্রজ্বলন’। ২০০৬ সালে গড়ে তোলেন ভ্রমণ দল ‘যাযাবর’। ২০০৯ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ‘তীরন্দাজ নাট্যদল’। ২০১১ সালে প্রতিষ্ঠা করেন বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক প্রথম পরিবেশবাদী সংগঠন ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবেশ সংসদ’।

শুধু মনের শক্তিকে পুঁজি করে চিকিৎসকের ভবিষ্যদ্বাণীর সঙ্গে লড়াই করে গেছেন বিরামহীন। রাসেল বলেন, ‘১০ বছর পর হুইলচেয়ারে বসার ভবিষ্যদ্বাণীর সঙ্গে লড়াই করে ১৬ বছর পর্যন্ত ঠেলে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছি। ২০১৬ সালের জুলাই মাস থেকে আমি হুইলচেয়ার ব্যবহার করছি। ভেঙে পড়িনি। মনোবল আজও অটুট আছে।’

রাসেলের গড়া তীরন্দাজ নাট্যদলের এক আয়োজনে এসেছিলেন নাট্যব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদ
রাসেলের গড়া তীরন্দাজ নাট্যদলের এক আয়োজনে এসেছিলেন নাট্যব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদ

শাহীন রেজা বর্তমানে সহকারী পরিচালক পদে কর্মরত আছেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশের ৫৬টি জেলা ঘুরে বেড়িয়েছেন। পুরো বাংলাদেশই শুধু নয়, পুরো পৃথিবীর যতটা সম্ভব ঘুরে বেড়াতে চান তিনি। জানালেন কতগুলো স্বপ্নের কথা। সময় কমে আসছে। এই অল্প সময়ের মধ্যেই পূরণ করে যেতে চান সেসব স্বপ্ন। ২০১৬ সালে মহান বিজয় দিবস উদ্‌যাপন উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিভিত্তিক সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর উদ্যোগে আয়োজিত ‘রক্তরাঙ্গা বিজয়’-এ প্রদর্শিত হয় তাঁর লিখিত ও নির্দেশিত নাটক তিরিশ লক্ষ গাছ। তিরিশ লাখ শহীদের জন্য তিরিশ লাখ গাছ রোপণের থিম নিয়ে নাটকটি লিখেছিলেন তিনি।

পঙ্গু, প্রতিবন্ধী—শব্দগুলো নিয়ে প্রবল আপত্তি তাঁর। তিনি বলেন, ‘আমার মতো কারও শারীরিক সীমাবদ্ধতা থাকলে তাঁকে বলা যেতে পারে “বিশেষভাবে সক্ষম” কিংবা “সুবর্ণ নাগরিক” (গোল্ডেন সিটিজেন)। কারণ, তাঁরা সংগ্রামটা অন্যদের চেয়ে বেশি করেন।’ বিভিন্নভাবে সক্ষম ব্যক্তিদের অধিকার আদায়ে কাজ করার ব্রত নিয়ে ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠা করেছেন সেন্টার ফর এনসিউরিং রাইটস অব ডিফারেন্টলি অ্যাবল—সিরডা। আরেকটি বিশেষ স্বপ্ন আছে তাঁর। একটি জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করার। যার নাম হবে ‘মিউজিয়াম অব ব্রেভ’। বাংলায়, সাহসের জাদুঘর। যাঁরা নানা রকম শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও সংগ্রাম করে সাহসী ভূমিকা রেখে পৃথিবীর বুকে সফল হয়েছেন, মানুষের কল্যাণে কাজ করেছেন, তাঁদের জীবনী, তাঁদের কাজ, তাঁদের ব্যবহৃত জিনিসপত্র প্রদর্শিত হবে সেখানে। মানুষ সেই জাদুঘর পরিদর্শন করে তাদের জীবনের হতাশা ভুলে যাবে, অনুপ্রাণিত হবে।

সাহসের সঙ্গেই শাহীন রেজা প্রতিনিয়ত বসবাস। সাহসের জাদুঘর নিয়ে তাঁর যে স্বপ্ন, আমরা চাই সাহসের জাদুকরের স্বপ্নটা পূর্ণতা পাক। তাঁর সাহসের জাদুঘরই অনুপ্রেরণা জোগাক, নতুন করে স্বপ্ন দেখার উৎস হোক—অগণিত মানুষের।