অনুপ কুমারের সুন্দর হস্তাক্ষরের স্বপ্ন

অনুপ কুমার দাস
অনুপ কুমার দাস

ঝোলা ব্যাগটা তখনো তাঁর কাঁধে। সেই ব্যাগ থেকেই একে একে বের করলেন দাগটানা খাতা, কলম আর কয়েকটি বিভিন্ন আকৃতির কলমের নিব। জাদুকর যেমন নিপুণ কৌশলে বাক্স থেকে এটা-ওটা বের করেন, অনেকটা তেমন করে। একসময় ছোট বৈঠক টেবিলটার মাঝখানটা তাঁর ব্যাগ খালি করে ভরে উঠল। চোখের পুরু ফ্রেমের চশমাটি ঠিক করে নিয়ে বললেন, ‘মানুষের হাতের লেখাটাই যদি সুন্দর না হয়, কীভাবে হবে বলুন! তাই সুন্দর হাতের লেখা নিয়েই আমি কাজ করি।’

সুন্দর হস্তাক্ষরের এই মানুষের নাম অনুপ কুমার দাস। থাকেন নারায়ণগঞ্জ শহরে। কিছুদিন আগে গড়ে তুলেছেন হাতের লেখা শেখানোর এক স্কুল। সেখানে ৫ থেকে ৭০ বছর বয়সী মানুষ তাঁর শিক্ষার্থী। সত্তর বছর বয়সী! বিস্ময়ের জবাবে বলেন, ‘হাতের লেখা সুন্দর করার কোনো বয়স নেই, ইচ্ছেটাই আসল।’

বাসা নারায়ণগঞ্জে হলেও সপ্তাহের দু-তিন দিন তিনি রাজধানীতে আসেন। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যান, সুন্দর হাতের লেখার বার্তা পৌঁছে দেন। বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অভিনন্দনপত্র ও সনদ লেখার সুযোগ পেলে স্বাচ্ছন্দ্যে করে দেন। এ কাজের দায়িত্ব তাঁকে কেউ দেয়নি, নিজেই নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন। তবে দায়িত্ব কাঁধে নেওয়ার তাগিদটা অনেক আগের। ১৯৭৮ সালে নারায়ণগঞ্জ তোলারাম কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে তখন তিনি ভারতের কলকাতায়। ‘কলকাতায় কেন?’

প্রশ্নটা করতে হয়নি। নিজে থেকেই বলে যান, ‘কলকাতার নেতাজি নগর কলেজে আমি ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক পড়েছি। স্নাতক পড়ার সময়ই নেতাজি ক্যালিগ্রাফি নামে একটি প্রতিষ্ঠানে হাতের লেখার ওপর ছয় মাসের কোর্স করেছিলাম। হাতের লেখা নিয়ে আমার ভাবনাটাই বদলে যায়।’

ভারতে উচ্চশিক্ষার শেষে কিছুদিন নানা পেশায় কাজ করেছেন। ১৯৯৮ সালে দেশে ফেরেন। সেই থেকে এখনো নারায়ণগঞ্জ শহরের ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়ান। এটাই তাঁর পেশা। এই কাজের সঙ্গে হাতের লেখা শেখানোর কাজটিও সমানতালে চালিয়ে যান।

জীবনকথা বলতে বলতেই হাতে লেখা একটি বাঁধাই খাতা মেলে ধরলেন অনুপ কুমার দাস। প্রথম পাতায় মোটা হরফে লেখা ‘কীভাবে হাতের লেখা সুন্দর করতে হয়’। খাতাটির প্রতিটি পাতায় হাতের লেখা সুন্দর করার নানা কৌশল লিখেছেন তিনি। বলছিলেন, ‘চর্চা করলে সবার হাতের লেখাই সুন্দর করা সম্ভব। এটা এমন কোনো বিষয় নয়।’ কীভাবে লিখলে অক্ষরগুলো সুন্দর করা যায়, বাংলা কয়েকটি বর্ণ লিখে নিজেই দেখালেন। এই কৌশলকে তিনি বললেন ‘সূত্র’। এই সূত্রের কয়েকটি বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে অনুপ কুমার দাস নিজেই তৈরি করেছেন, কয়েকটি পুঁথিগত। তিনি চান হাতের লেখার কৌশলগুলো সবার কাছে পৌঁছে দিতে। ‘দেখুন, সব প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বই ফ্রি দেয়, কেন হাতের লেখা শেখানোর একটি বই দেওয়া হবে না? মানুষ কেন যেন হাতের লেখাটাকে গুরুত্ব দিতে চায় না।’

তাঁর সঙ্গে কথা বাড়ে। তাঁর স্বপ্ন ছুঁয়ে যায় আমাদেরও। ঠিকই তো, সুন্দর হতের লেখা ছাড়া চলা যায়! আরও খানিকটা পর একটা পরিবর্তন আপনা-আপনি মনে উঁকি দিল। যখন মুখের কথাগুলোকেও মনে হচ্ছিল গুটি গুটি অক্ষরে প্রাণ পাচ্ছে। এটাই বোধ হয় অনুপ কুমার দাসের প্রাপ্তি।