গবাদি এবং গো-বাদী সমাচার

ঈদ এলেই লম্বা ছুটি। আর ছুটি পেলেই শিকড়মুখী হয় শহরবাসী। শিকড় মানে গ্রাম অথবা ঢাকা থেকে দূরান্তে অবস্থিত মফস্বল শহর। যেখানে প্রায় সবার আদি এবং মূল গ্রহ রয়েছে। ঘনিষ্ঠজনেরা রয়েছে বা থাকে কিংবা বিভিন্ন জায়গা থেকে ঈদ উপলক্ষে এসে জড়ো হয় ছুটি কাটাতে, আনন্দে কাটাতে। অনেকে এটাকে শিকড়মুখী বলে। কেউ কেউ গৃহমুখী বলে থাকে। 

তো শিকড় বলি অথবা গ্রামের বাড়ি বলি, ঈদ এলেই প্রাণান্ত প্রচেষ্টায় নিজ নিজ গ্রামের দিকে ছোটার মজ্জাগত অভ্যাস রয়েছে আমাদের। সে এক কাণ্ড বটে। সবারই আপন ডেরায় ফেরার ইচ্ছেটা একসঙ্গে জাগরূক হয়। একই সময় ভাবনায় ভর করে।
ট্রেন, বাস, ট্রাক, লঞ্চ ইত্যাদি সেই ইচ্ছেটা মেটায়। এসবের যেটা যার ভাগ্যে জোটে, যেমন করে হোক ঠাঁই করে নিয়ে দূর-দূরান্তে পাড়ি দেয়। আত্মীয়, স্বজন, বন্ধুবান্ধবদের কাছে যাবার টানটা অতএব ঈদের আগেই মনে অপ্রতিরোধ্য হয়ে দানা বাঁধে, এতটাই যে বিপদ-আপদকে তুচ্ছ জ্ঞান করে এই ঈদ যাত্রাটি ঘটেই। ট্রেনে টিকিট নেই তো বিনা-টিকিটের ছাদ রয়েছে, দরজায় বাদুড় ঝোলা হওয়ার হাতল ও সিঁড়ি রয়েছে সহায়ক। ভাগ্য ভালো হলে বেঁচে বর্তে পৌঁছায় গন্তব্যে। লঞ্চ ভিড় ভাড়ে টাবুটুবু-ডুবুডুবু হলেও পরোয়া নেই। রিস্কি এই সব ভ্রমণের কোনো অভিজ্ঞতা নেই আমার। অতএব এর আনন্দ নিরানন্দ কোনোটাই জানা হয়নি, ভোগ-উপভোগের অভিজ্ঞতাও হয়নি। তবে এই হুল্লোড়ি-যাত্রা দেখে সব সময়ই ভাবি যে, এটাকে গিনেজ বুকে স্থান দেওয়া উচিত। একটি দেশের জাতীয় বিপদগামী অভ্যেস আখ্যা দিয়ে।
তো এই সম্ভাব্য দুর্ঘটনাকে তোয়াক্কা না করে ভ্রমণের যে ঘটনা তা রাজধানী ঢাকা থেকে বেরিয়ে যাবার বেলায়ই ঘটে বেশি। অনেকের ধারণা শিকড়ের প্রতি টান, কেউ আবার বলেন ঢাকায় জাম-গ্যাঞ্জাম, ধোঁয়া ধুলা, মিটিং-মিছিলের হুলুস্থুল ইত্যাদি বহুবিধ মেলা-ঝামেলা থেকে বাঁচতেই এই মরণ-বাঁচন দুঃসাহসী অভিযান প্রচেষ্টা।
আমি এ ব্যাপারে একটু স্বার্থপর। আসলে ঈদের এই হুড়পাড়ে শামিল হই না অন্য কারণে। একটি হলো সাহসী নই। তবে সব চাইতে বড় স্বার্থের দিক হলো নিরিবিলি নির্ভেজাল নির্জীব, ঢাকাতে ছুটির ক’দিন উপভোগ করা। শহর ছেড়ে যাওয়া হাজার হাজার মানুষকে মনে মনে কত যে ধন্যবাদ জানাই তার হিসেব নেই।
জন-মানব শূন্য, জাম-জ্বালাহীন শহরটিকে পেয়ে মনে হতে থাকে-‘আহা কী আনন্দ আকাশে-বাতাসে’ গানটি গাই।’
তো, ঈদে শিকড়-বাকর খোঁজার আমার কোন প্রয়োজন হয় না। গ্রাম-গঞ্জে কেউ আর তেমন নেই যে লাইফ রিস্ক নিয়ে হলেও দেখা করতে যেতে হবে। তবে মাঝে মধ্যে কাজ উপলক্ষে ঢাকার বাইরে থাকলে ঈদের দু-এক দিন আগে ঢাকার দিকে গৃহমুখী হতে হয়। সেই ভ্রমণও যে খুব নির্বিঘ্ন-নিষ্কণ্টক হয় তা নয়। অনেকটাই সহনশীল। যদিও বাসগুলো ঢাকায় আমাদের নামিয়ে দিয়ে যাত্রীতে টইটম্বুর করে আবার রওনা দেওয়ার তাড়ায় প্রায় উড়োজাহাজের গতিতে চলার নিয়ম।
বছর দুয়েক আগে কোরবানি ঈদের কাছাকাছি সময়ে রাজশাহী টু ঢাকা ট্যুর করতে হয়েছিল। সেই ভ্রমণ শেষ পর্যন্ত রাজশাহী থেকে ঢাকা ব্যাপারটা থাকেনি। হয়ে গিয়েছিল রাজশাহী টু আমিনবাজার। তাতে অবশ্য যাত্রীদের চেয়ে বাসচালক এবং কর্মচারীদের মন ভেঙে শতখান হয়েছিল ঢাকায় অপেক্ষমাণ যাত্রীদের নিয়ে রাজশাহীতে ফেরার ট্রিপটায় দেরি হয়ে যাবে বলে।
আমার দুশ্চিন্তা অবশ্য অন্য। বাস তো নট নড়ন হয়ে অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য ভরসন্ধ্যায় থেমে গেল। যাত্রীরা বিপদ বুঝে যে যার মতো তল্পিতল্পা বগলদাবা করে হেঁটে ব্রিজ পার হয়ে গাবতলীর গরুর হাটের ভিড় ঠেলে গন্তব্যের দিকে চলে গেল। আমার তা করা সম্ভব নয়। একে হাঁটার অভ্যাস নেই, তা আবার গরুর হাটের ভিড়, আধো অন্ধকার ঠেলে যাওয়া।
আসলে গরুর হাটের অভিজ্ঞতা আমার খুব সুখকর নয়। সেটি ভেবে আমার দুশ্চিন্তা গভীর থেকে গভীরতর হতে থাকে। শেষে প্রতিজ্ঞা করি হাঁটা-টাটা নয়, গরু আর মানুষ ঠেলে হাঁটা-সে আমার নয়; বরং বসে থাকব বাসে। একবার না একবার, এক ঘণ্টা হোক বা দশ, আজ হোক বা কাল, বাসটিকে নড়তেই হবে, চলতেই হবে, কাউন্টারে পৌঁছাতেই হবে। অতএব আমার নড়ার প্রয়োজন নেই। চোখের সামনে বিশাল একটি ষাঁড় এবং মাঝারি অথচ নাদুসনুদুস ধরনের ওজনদার দুটি গরুর চেহারা ভাসতে থাকে। এরাই আমার গরুর হাট-ভীতিটা মনে গেঁথে দিয়েছিল, যা আজও অটুট আছে। ভয়ভীতির ব্যাপারটা অবশ্য এ রকমই। যে ভূতে ভয় পায় তো সারা জীবনই তা-ই নিয়ে থাকে। যাদের সর্পভীতি আছে তারাও তা-ই। তবে সবচেয়ে জনপ্রিয় ভয় যা পুরুষকুলে সম্প্রসারিত, তার নাম স্ত্রী-ভীতি।
যাই হোক, আমার ভীতি শুধু হাটে নয়, গবাদিপশুতেও। ব্যাপারটা একটু খুলেই বলি বরং।
সে অনেককাল আগের কথা। তবে ইংরেজি রূপকথার গল্প যে ওয়ানস আপন আ টাইম দিয়ে শুরু হয়, অতটা অনির্দিষ্টতার ব্যাপার নয়। বছর দশেক আগের কথা। ঠিক কোরবানি ঈদের কদিন আগের ঘটনা। যেদিকেই যাই দেখি গরু-ছাগল নিয়ে কথা। যেন সবার চোখের সামনে ওসবের চেহারা ভাসছে। অফিসে-রেস্তোরাঁয়, পথেঘাটে কারও সঙ্গে কারও দেখা হলেই গো-সমাচার নিয়ে পড়ে। কিছু নমুনা মুখস্থ রেখেছি। যেমন: ‘কী ভাই, হাটের খবর কী? গরু আসতাছে তো?’ ‘আসছে কিছু কিছু, ভালো তো চোখে পড়ল না। কেমন জানি ট্যামা খাওয়া। কিছু আছে ওষুধ খাওয়া গুদগুদা মোটা।’
এ রকমই কথোপকথন রেস্তোরাঁয় চা খেতে গিয়ে শুনলাম। একজন পাশের টেবিলে বেশ অন্যমনস্ক হয়ে চা খাচ্ছে। মনে হচ্ছিল নিশ্চয়ই খুব দুশ্চিন্তায় আছে। দেশে লোকজনদের তো দুশ্চিন্তার শেষ থাকে না। একেকবার একেকটায় অ্যাটাক করে। সেই রকমেরই কোনো কিছু দ্বারা হেভিলি অ্যাটাকড মনে হলো। কারণ তার এক বন্ধু এসে তার টেবিলে বসল। দুশ্চিন্তাগ্রস্ত লোকটি খেয়ালও করল না। অবশেষে বন্ধুটি কথা বলল, ‘কিরে! মনে হয় মুড খারাপ?’ প্রশ্নকারীর দিকে না তাকিয়েই উত্তর দিল প্রায় আনমনে, ‘কোন মুড?’
‘ব্যাপারটা কী? কী ভাবতাছস? ভাবির লগে কাইজা’!
‘না-না চাইরটা গরু আনছিলাম বেচনের লাইগা। পাড়ার পোলাপান চান্দা চাইতাছে মেলা টাকা।’
‘তাতে চিন্তা করার কী আছে? দিয়া দে। যা দিবি ওইডা দামে ধইরা লবি।’
তো ঈদমুখে হঠাৎ আমার দাঁত ব্যথা শুরু। গিন্নি বললেন, ‘আগে না পরে না, ঈদের আগে এই ব্যথা। ডাক্তারের চেম্বারে তো কোরবানির আগে ভিড় হবে খুব। তা-ও যাও, দেখিয়ে আসো।’ কিন্তু ‘দন্তবেদনা’ বলে কথা। একবার শুরু হলে দন্ত চিকিৎসালয় পর্যন্ত তাড়া করে ছাড়ে। গিন্নি বলুক না-বলুক, যেতেই হবে।
তো ডাক্তারের কাছে গিয়ে দেখি গিন্নির কথাই সত্যি। সবাইকে দেখে আমার ধারণা হলো, কোরবানি উপলক্ষে দাঁতগুলো সার্ভিসিং করতে এসেছে সবাই। এই সময় এক বন্ধু ঢুকল, ওয়েটিংরুমে। আমাকে দেখেই মহাখুশি হয়ে বলল, ‘কী ব্যাপার? তোমারও দাঁতে ব্যথা।’
ব্যথার চোটে মেজাজ ঠিক রাখা মুশকিল। বললাম, ‘ক্যান, আমার দাঁতে ব্যথা-বেদনা হইতে নাই?’ হেসে বন্ধু বলল, ‘অনেকেই মাংসের জন্যে নড়বড়ে দাঁত মেরামত কইরা নিতাছে তো, তাই...’
বন্ধু পাশেই বসে পড়ে গরুর কথায় এল। ‘গরু কিনছো? ক্যান কইতাছি, আসলে কয়দিনে দেখলাম সবার মুখে গবাদি নিয়া কথা! আন্দোলনবাদী, নীতিবাদী, প্রগতিবাদী, সমাজবাদী, ধর্মবাদী থেকে শুরু করে সবাই ঈদের এই কয়দিন “গো-বাদী” তায় মন দিছে। হা হা হা। গরুর কথা মাথায় নিয়ে চলছে ফিরছে।’ দাঁতের ব্যথায় ভয়ানক কাতর আমিও হাসার চেষ্টা করলাম। যাই হোক, যে কথা শুরু করেছিলাম, সেই যে ভয়ভীতি ওই ঘটনাটা বলি এবার। গরুর হাটে আগে কখনো একা যাইনি। তো কী মনে করে সেবার একা যাওয়ার অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্যে গাবতলী গিয়েছিলাম।
কোরবানি ঈদের গরু, ক্রেতা-বিক্রেতাদের আচরণ, পছন্দ-অপছন্দ, ইচ্ছা-অনিচ্ছা, দাম-দামাদামির আর্ট-এসব স্টাডি করার জন্যই ছিল সেই যাওয়া। কিন্তু গিয়ে আবিষ্কার করেছিলাম যে সবার অভিব্যক্তি একই ধাঁচের। বিক্রেতার নির্লিপ্ত চাহনি, ক্রেতার নির্বিকার ঘোরাঘুরি, একটার পর একটা গরুর শরীর টিপে টিপে, পছন্দ হলে দাম জিজ্ঞাসা, না পোষালে সটান হাঁটা ধরা, অন্য গরুগুলোর দিকে। বিক্রেতা দাম না কমানোর ইচ্ছায় নির্লিপ্ত অনড়, এ রকমের সব আচার-আচরণ চোখে পড়ছিল।
কয়েকজনকে দেখলাম, বড় বড় আর বিশাল বিশাল দামের গরু দেখতে দেখতে শেষে যাওয়ার আগে ছোট্ট পিচ্চি একটা ম্যানেজ করে বাড়ির পথে রওনা দিতে। বড় কেনার আশা ভঙ্গে মনটা খারাপ করেই সেই যাওয়া। একজনকে সান্ত্বনা দিতে শুনলাম ‘ছোট কিন্তু কালো গরু তো, ভালোই পাইছেন।’
এসবই তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ শেষে মেইন রোডে এলাম। লোকে-লোকারণ্য, গরুতে গো-অরণ্য অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসায় বেশ স্বস্তি অনুভব করছি যখন, তখনই নজরে পড়ল পথের ভিড়ভাড়ের সব মানুষ যে যেদিকে পারে, ছুটছে তুমুল বেগে। প্রাণপণে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছোটা যাকে বলে।
ব্যাপারটা কী, বোঝার জন্য দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ দেখি ইয়া দশাসই একটি ষাঁড় শিং সই করে তেড়ে আসছে বেদম গতিতে। তার পিছে পিছে ছুটছে চার-পাঁচজন লোক। ষাঁড়টি এমনি যেনতেন স্বভাবের নয়, রীতিমতো বিশাল চূড়াধারী বদরাগী ষাঁড়।
আমার ধারণা হচ্ছিল, যে বা যারা ছুটছে তারাই তার টার্গেট। আমি তো নেহাতই গো-বেচারা টাইপের। আমাকে টার্গেট করার কোনো কারণ থাকবে না তার ভাবনায়। তা ছাড়া কোথায় যেন পড়েছিলাম, হঠাৎ জীবজন্তুর সামনে পড়লে স্থির দাঁড়িয়ে তার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকলে কিছু করে না। তবে সেই সঙ্গে ওই লেখায় সাপ সম্বন্ধে এই বুদ্ধি না খাটার কথাও বলা ছিল। লেখা ছিল, সামনে সাপ দেখলে নড়াচড়া এবং ছোটাছুটি বাঞ্ছনীয়।
যাই হোক, আমি তো আসলে প্রায় হতবিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে আছি আর পুরো দৃশ্যটা দেখে মনে হচ্ছিল স্পেনের ষাঁড় তাড়া করার মতো একটা কিছু দেখছি। টিভিতে দেখা ডকুমেন্টারির দৃশ্যটা যেন লাইভ দেখতে পাচ্ছি।
আমার চিন্তাকে বিঘ্নিত করে অকস্মাৎ একটি ঘটনা ঘটল। কেউ একজন আচমকা জাপটে ধরে টান দিল। নিজেও ঢুকল। তাকিয়ে দেখি একটি হিতৈষী যুবকের এই কাণ্ড। বলল, ‘আর একটু হইলেই তো গেছিলেন। পাগল নাকি?!’ দেখলাম ফোঁস ফোঁস করতে করতে ষাঁড়টি সামনে দৌড়ে চলে গেল।
ঘটনার এটাই শেষ নয়। চারদিক স্বাভাবিক হতেই বেরিয়ে এলাম। পথে আবার লোক চলাচল শুরু। নিশ্চিন্তে হাঁটছি। যুবকটিকে ধন্যবাদ জানালে সে বলল, ‘ওয়েলকাম। তয় মোর একটু টাইমে গোলমাল হইলে ধন্যবাদ দেওনের সুযোগ পাইতেন না।’
যুবক ছেলেটি তখনো কাছছাড়া হয়নি। আমাকে ভোলাভালা নির্বোধ টাইপের লোক ভেবেই হয়তো তখনো সরেনি। হাঁটতে হাঁটতে বলল, ‘যে রকম ইয়া বড় ষাঁড় গুতা খাইলে আর রক্ষা ছিল না। বুঝলেন, এইটারে একটু আগে একজনরে কিনতে দেখছি। পাঁচ লক্ষ টাকা দাম। লোকজন ভিড় করে তারে দেখতেছিল। যে কিনছে সে যে হেব্বি বড়লোক তা চেহারা দেইখা বোঝনই যায় নাই।’
বললাম, ‘তাই বুঝি! তো গরুটা যদি হারিয়ে যায়, ধরতে না পারে, বা দৌড়াতে দৌড়াতে হাঁপিয়ে গিয়ে হার্টফেল করে, তখন কী হবে ক্রেতার? অত পয়সার গরু, ক্রেতাকেই না গরুটার অনুসারী হতে হয়।’
যুবক বলল, ‘এক কথায় অত টাকার চয়েসে যে গেছে তার টাকা লইয়া কোনো দুঃখ থাকার কথা না। কিছুই হইব না দেইখেন।’
আমার এ ঘটনার এখানেই যে সমাপ্তি, তা নয়। দুজন ভিড় ঠেলে হাঁটছি গল্প করতে করতে। এমন সময় পেছন থেকে চিত্কার শোনা গেল, ‘সরেন, সরেন।’ চমকে উঠলাম। এবার আবার কোন ষাঁড় আসছে? পেছনে তাকাতে যাব অমনি কিছু বোঝার আগেই হুড়মুড় করে নাদুসনুদুস কালো আর সাদা রঙের দুই গরু এসে হাজির। কিছু ভাবার আগেই একটি আমার পা-কে টার্গেট করে মাড়িয়ে দিয়ে চলে গেল ক্রেতার পাশাপাশি হেঁটে, নিশ্চিন্তে। পায়ে পাড়া দিয়ে ঝগড়া বাধিয়ে টু-পাইস কামাবার অভ্যাস আছে হাইজ্যাকারদের শুনেছি। গরুদের তো তা নেই, তাই রক্ষে।
প্রথমে এফেক্টটা বোঝা যায়নি। কিছুক্ষণের মধ্যেই পা-টা ফুলে ঢোল হয়ে গেল এতটাই যে, স্যান্ডেলের ফিতা ছিঁড়ে যাওয়ার জোগাড়।
যাই হোক, এরপর থেকে আমি পারতপক্ষে গরুর হাটমুখী হই না। প্রয়োজনে অন্যদের ওপর ভরসা করি। শুনি ইদানীং নাকি অনেকেই আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করার সুযোগ নেন পশু কেনার ব্যাপারে। মানে লাইন ধরে হাটে যেতে হয় না। অনলাইনে কেনাকাটার কাজ সারেন। সেই প্রক্রিয়া আমার জানা নেই অবশ্য। গাড়ি ডাকা, মোটরসাইকেল ডাকা থেকে শুরু করে নাকি হেন দিক নেই যে অনলাইনে হয় না।
শুনেছি প্রেম-প্রীতি, ভালোবাসা, জুটি বাঁধাবাঁধি তা-ও নাকি হয়। শুধু এসবই নয়, অনলাইনে গুজব ছড়িয়ে দেশের রাজনীতিতে ভয়াবহ তালগোল পাকানোর ব্যবস্থাও করে কেউ কেউ।
তো এ রকম অনলাইন মানে প্রযুক্তির লাইনের ওপর আমার দাঁড়ানো হয়নি। নিয়মটাই ধাতস্থ হয়নি। চেষ্টাও করি না। তাই অনলাইন ছেড়ে চিরাচরিত ম্যানুয়াল বুদ্ধিতেই থাকি। এটাকে অফলাইন বলা যায় কি না তা অবশ্য ভাবিনি কখনো। এই ক্ষেত্রে আমি অপেক্ষায় আছি হকারদের। পাড়ায় পাড়ায় চিত্কার করে যারা পণ্য বিক্রি করে তাদের। আমি সেই দিনের অপেক্ষায় আছি যেদিন হকাররা ঈদে তো বটেই এমনিতেও আস্ত গরু ভ্যানে করে গলিতে চিত্কার করবে ‘গরু রাখবেন গরু, ইন্ডিয়ান, দেশি, মিয়ানমারের গরু, অস্ট্রেলিয়ান...! খাঁটি গরু, ওষুধ না খাওয়া, নির্ভেজাল গরু নিবেন।’ এ রকমটা হলে আমার মতো ভীত এবং আলসে লোকদের পক্ষে নিশ্চিন্ত থাকার ব্যাপারটি ঘটবেই। এ ছাড়া অনলাইন শপিংয়ে দামাদামি করার উপায় নাকি নাই। হকাররা সে সুযোগটি দিয়ে থাকে।
আসলে হকারদের প্রতি আমার একধরনের পক্ষপাতিত্ব আছে। এপাড়া-সেপাড়া করে বেশ খাটাখাটনি দিয়ে তাদের ব্যবসা চালায় কিন্তু মুড হারায় না। রসিকতাপ্রবণও হয় বটে। যদিও তাদের হাঁক-ডাকের ভাষা অনেক সময় বোধগম্য হয় না। যেমন কেউ কেউ হাঁক ছাড়ে-‘এই মুরগি-মোরগ।’ মনে হয় মুরগি-মোরগদের ডাকছে, আবার এও মনে হয় যেন ক্রেতাদেরই ওই রকম ভাবছে।
শোনার ভুলেও অনেক সময় হকারদের ভাষা উল্টোপাল্টা ভাবার অবকাশ থাকে। এ ব্যাপারে আমার নিজের কিছু অভিজ্ঞতা উদ্ধৃত করছি। একদিন দুপুরে শুনলাম এক মহিলা হকার চিত্কার করছে, ‘ছাই মাখবেন, ছাই মাখবেন ছাই।’
ভাবলাম মাঝেমধ্যে প্রসাধনসামগ্রী বিক্রি করতে আসে, তেমন কোনো কিছু হয়তোবা। ছাই ধরনের কত রকম জিনিস আছে। গ্রামে দেখতাম নদী থেকে এঁটেল মাটি তুলে এনে মহিলারা মাথায় মাখে। তাতে নাকি শ্যাম্পুর মতো কাজ দেয়।
গিন্নিকে জিজ্ঞেস করলাম। বললেন, ‘ওটা ছাই মাখবেন বলছে না। বলছে ছাই রাখবেন।’
এক দুপুরে ভালোবাসা-সম্পর্কিত হাস্যরসাত্মক একটি গল্প পড়ছিলাম বেশ নিবিষ্ট মনে। হঠাৎ শুনি চারদিক কাঁপিয়ে কেউ চিত্কার করছে হেঁড়ে গলায়-‘আই লাভ ইউ’। এই আপ্ত বাক্যটি ইদানীং টিভি সিরিয়াল দেখে দেখে অনেকের মধ্যে সংক্রামিত হয়েছে বলে শুনি।
কিন্তু এই অত্যন্ত প্রাইভেট আর আপন কথাটি এত চিত্কার করে বলার ধরন দেখে গিন্নিকে বললাম, ‘আরে দিনকালের হলো কী! এত চিত্কার করে আই লাভ ইউ বলা, অসভ্যতার সীমা ছাড়াচ্ছে। তরুণ প্রজন্মের হলোটা কী? পথঘাট, সময়-অসময় কিছুই মানে না, সারা দিন শুধু একই চিন্তা নিয়ে ঘোরে! গিন্নি বললেন, ‘তোমার কানের চিকিৎসা ভালো করে করলে না। আরে হকারটা লেবু বিক্রি করছে। বলছে আয় লেবু।’ আমি আর কী বলি। শুধু বলেছিলাম, ‘ওইভাবে না বলে লেবু রাখবেন লেবু বললেই তো পারে। ব্যাটা ইচ্ছা করে অ্যাটেনশন ড্র করতে এটা করছে।’ গিন্নি বললেন, ‘তা তো করতেই পারে। এটাই তো মার্কেটিংয়ের নিয়ম।’
যা-ই হোক আমার ধারণা অচিরেই গরুও এই রকম চিত্কার করে হকাররা বাসার দোরগোড়ায় বিক্রি করবে। সেদিন আমার মতো হাটভীতু মানুষ ঘরে বসে পাল্লায় মেপে গরু কিনতে পারবে মহানন্দে। তাতে জনসমক্ষে টাকার অঙ্কটা জানান দেওয়া হয়ে উঠবে না, এই একটা যা খামতি রয়ে যাবে হয়তো।
আসল হাটে পকেটের শক্তি বোঝাবার প্রতিযোগিতা যে হয়, সেটার সুযোগ তেমন থাকবে না।
তবে হকারদের গরু-ছাগল বিক্রির বেলায় চিত্কার করে হাঁক দেওয়ায় একটা বিপদ যে হতে পারে, তা নিশ্চিত করে বলা যায়। সেটা এমন হতে পারে যে, ক্রেতাদেরই ডাকছে,
‘এই গরু।’
‘এই যে ছাগল। আহেন আহেন...ছাগল...।’

লেখক: চিত্রশিল্পী