নগর ঘুরে পূজা দেখা

খামারবাড়ির রাস্তার শুরুতেই পূজার আলো ঝলমলে গেট। ছবি: লেখক
খামারবাড়ির রাস্তার শুরুতেই পূজার আলো ঝলমলে গেট। ছবি: লেখক

দেবী দুর্গা এবার মর্ত্যে এসেছেন ঘোড়ায় চড়ে। আর ফিরে যাবেন দোলায় চড়ে। দুর্গার আগমন দিয়ে শুরু হয় শারদীয় দুর্গোৎসব। মূল পূজাও শুরু হয়ে গেছে। এখন এই উৎসবে বিভিন্ন পূজামণ্ডপ ঘুরে বেড়ানোর পালা। উৎসবমুখরতায় সব মণ্ডপই রঙিন আর আলোয় আলোয় ভরা। একেক মণ্ডপের সাজসজ্জা একেক রকম। দর্শনার্থীরা মণ্ডপ ঘুরে আবার নিজের মতো বিচার করতে বসেন কোনটার চেয়ে কোনটা সুন্দর। তাই আয়োজকদেরও নজর থাকে মণ্ডপ ও প্রতিমার সাজসজ্জার দিকে। সনাতনী ধারার পাশাপাশি মণ্ডপসজ্জায় বিষয়ভিত্তিক (থিম) ধারাও দেখা যাচ্ছে। কোনোটা সেজে উঠেছে প্রকৃতির মতো করে, আবার কোনোটা শান্তির বার্তা ছড়িয়ে দিচ্ছে। রাজধানীর কয়েকটি থিমভিত্তিক পূজামণ্ডপের কথা থাকছে এখানে।

বসুন্ধরার মণ্ডপ
বসুন্ধরার মণ্ডপ

বসুন্ধরায় দুর্গার বাহন নিয়ে
এবারে দুর্গা যে ঘোড়া–চালিত রথে করে মর্ত্যে এসেছেন, সেই বিষয়টাকেই মণ্ডপ ও প্রতিমায় তুলে ধরা হয়েছে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার দুর্গোৎসবে।

বসুন্ধরার মণ্ডপে দুর্গা প্রতিমা
বসুন্ধরার মণ্ডপে দুর্গা প্রতিমা

বসুন্ধরা সর্বজনীন পূজা কমিটির তথ্য অনুযায়ী, দেবি দুর্গার এবারের আগমনকেই বড় করে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। মাগুরার প্রতিমাশিল্পী গুরু এখানকার প্রতিমা তৈরি করেছেন। বসুন্ধরার ই–ব্লকে এই পূজা প্রাঙ্গণে কৃত্রিম ঝরনা রাখা হয়েছে।

ধানমন্ডির দুর্গা প্রতিমা
ধানমন্ডির দুর্গা প্রতিমা

ধানমন্ডিতে প্রকৃতির আবাহন
মূল ভাবনা প্রকৃতিকে ঘিরেই। তাই অনেকটাই খোলা। মূল মণ্ডপ আর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মঞ্চ আলাদা। কলাবাগান খেলার মাঠের পাশেই ধানমন্ডি লেক। সেই লেকের জলের ওপর বসানো হয়েছে ছোট প্রতিমা। এ কারণে প্রকৃতি দারুণভাবে বিরাজ করছে ধানমন্ডি সর্বজনীন দুর্গোৎসবের পুরো আয়োজনে। ধানমন্ডি সর্বজনীন দুর্গোৎসব আয়োজক কমিটির আহ্বায়ক তপন কান্তি সরকার বললেন, ‘ভারতের তামিলনাড়ুর প্রাচীন বৃহাদিশভারা (রাজারাজেসভরম নামেও পরিচিত) মন্দিরের আদলে এবার মণ্ডপ তৈরি করা হয়েছে। খুব নামকরা মন্দির এটি। আর আমরা প্রকৃতিকে ধরে রাখতে চেয়েছি। তাই এবার ধানমন্ডি লেকটাও ব্যবহার করা হয়েছে।’

ধানমন্ডি লেকের জলে ভাসমান বিষ্ণু ও লক্ষ্মী
ধানমন্ডি লেকের জলে ভাসমান বিষ্ণু ও লক্ষ্মী

ধানমন্ডির এই মণ্ডপের চূড়ার উচ্চতা ৪৮ ফুট। দুর্গাপ্রতিমা তৈরি করেছেন রতন পাল। চিরায়ত রঙিন সাজেই সাজানো হয়েছে প্রতিমা। দেবী দুর্গার বাহন এবার যেহেতু ঘোড়া, তাই প্রতিমাতেও সেই দৃশ্যপট। ঘোড়ায় চেপে অসুর বধ করছেন দুর্গা।

বনানীর প্রতিমায় শান্তির রং
বনানীর প্রতিমায় শান্তির রং

বনানী মাঠে শান্তির বার্তা
বনানীর কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউয়ের সড়কে থাকা ল্যাম্পপোস্টগুলোর আলোকসজ্জাই বলে দেবে সামনে পূজামণ্ডপ। বনানী খেলার মাঠে ভারতের দিল্লির লক্ষ্মীনারায়ণ মন্দিরের (বিড়লা মন্দির নামেও পরিচিত) আদলে গড়ে উঠেছে গুলশান-বনানী সর্বজনীন পূজা ফাউন্ডেশনের পূজামণ্ডপ। ফাউন্ডেশনের সভাপতি সুবল চন্দ্র সাহা এবং সাধারণ সম্পাদক সুধাংশু কুমার দাস জানালেন, এবার পূজা আয়োজনের বিষয় ঠিক করা হয়েছে শান্তি। ১৯৩৯ সালে দিল্লির এই মন্দির উদ্বোধন করেছিলেন মহাত্মা গান্ধী। তাঁর একটা শর্ত ছিল, এই মন্দির সবার জন্য থাকবে অবারিত। সব ধর্মের মানুষ যেন মন্দিরে যেতে পারেন। দুর্গোৎসবের যে সর্বজনীনতা, সেটার জন্যও এই মন্দিরের আদল বেছে নেওয়া।

গুলশান-বনানীর এই ১১তম আয়োজনে প্রতিমা গড়ার ক্ষেত্রে দেবীর আসল রূপ তুলে ধরা হয়েছে। নারায়ণগঞ্জের ধীরেন্দ্র পালের প্রতিমায় রঙের ছটা নেই। আছে শান্তির সাদা। প্রতিমায় ব্যবহার করা হয়েছে চাপা সাদা রং।

খামারবাড়ির এই প্রতিমা বৈদ্যুতিক মোটর দিয়ে চলে
খামারবাড়ির এই প্রতিমা বৈদ্যুতিক মোটর দিয়ে চলে

খামারবাড়ির প্রেম
মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ের খেজুরবাগান গোলচত্বরটাই সেজে উঠেছে উৎসবের আলোয়। ফার্মগেটের দিকে যে রাস্তাটা গেছে, তার গোড়াতেই আলোর ফটক। চোখে পড়তে বাধ্য। ফুল, প্রকৃতি, ময়ূর, হাতি—কত কিছুই না ছোটাছুটি করছে বৈদ্যুতিক আলোর যান্ত্রিক খেলায়। রাস্তাজুড়েই আলোর ঝলকানি। খামারবাড়ির কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনের পাশেই তোলা হয়েছে সনাতন সমাজ কল্যাণ সংঘের ২৭তম দুর্গোৎসবের মণ্ডপ। ভারতের বৃন্দাবনের প্রেমমন্দিরের আদলে গড়ে তোলা হয়েছে সোনালি-সাদা রঙের এই মণ্ডপ। মণ্ডপ ও প্রতিমার নির্মাতা ভাস্কর উত্তম সাহা জানালেন, এবারের থিম প্রেম ও তীর্থদর্শন। তিনি বললেন, অনেকেই সনাতন ধর্মের অনেক তীর্থস্থানে যেতে পারেন না। সেই তীর্থস্থানগুলোর ছোট প্রতিলিপি মণ্ডপের ভেতরে এক পাশে তৈরি করা হয়েছে।

এই মণ্ডপে যেসব তীর্থস্থানের খুদে সংস্করণ রয়েছে সেগুলো হলো কালীঘাট, দক্ষিণেশ্বর মন্দির, নিমাইয়ের জন্মস্থান, মায়াপুরের ইসকন মন্দির, নিমাইয়ের কীর্তন, বেঙ্গালুরুর শিবমন্দির, শ্রীকৃষ্ণের বেড়ে ওঠার স্থান গোকুল, শ্রীকৃষ্ণের জন্মস্থান মথুরা, নিধিবন, পুরীর জগন্নাথমন্দির, কাশীর ধামের ঘাট ও শিবলিঙ্গ। উত্তম সাহা বললেন, ‘ভক্তির জন্য আপনাকে পুরাণে যেতেই হবে। তাই প্রতিমাও সে ধাঁচে গড়া হয়েছে।’ ভিক্টোরিয়ান ঘরানার সিংহাসনে দেবী দুর্গা এখানে আসীন হয়েছেন গ্রামীণ শাড়ি পরে। এই মণ্ডপে যন্ত্রের খেলা আরও আছে। ছোট আকারে কাঠের বৈদ্যুতিক প্রতিমা তৈরি করেছেন ভূপতি মোহন রায়। কাঠের প্রতিমাগুলো মোটরের সাহায্যে নড়েচড়ে। লক্ষ্মীর ঘড়া থেকে যেমন টাকা বের হয়, তেমনি সরস্বতী বাজিয়ে চলেছেন বীণা, আবার কার্তিক ছুড়ছেন তির।

গুলশান–বনানীর মণ্ডপ গড়ে উঠেছে দিল্লির লক্ষ্মীনারায়ণ মন্দিরের আদলে
গুলশান–বনানীর মণ্ডপ গড়ে উঠেছে দিল্লির লক্ষ্মীনারায়ণ মন্দিরের আদলে

ঐতিহ্যের সঙ্গে
শ্রীশ্রী ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরের নতুন মন্দিরে এবার দুর্গাপূজা হচ্ছে। জাতীয় মন্দিরের এ আয়োজনও দেখার মতো। এখানে ঐতিহ্যবাহী ধারার দুর্গাপ্রতিমাই তৈরি করা হয়। বাংলাদেশ পূজা উদ্‌যাপন পরিষদের দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব কুমার দে বললেন, সাজসজ্জায় সাবেকি ধারাই অনুসরণ করা হয় এখানে। পটভূমিতে থাকছে কৈলাস পর্বত। ঢাকেশ্বরী মন্দিরের প্রতিমা বানিয়েছেন সুকুমার পাল।

সনাতনী ধারা কিন্তু জাঁকজমকপূর্ণ পূজার আয়োজনের দেখা মেলে পুরান ঢাকায়। নর্থব্রুক হলের জমিদারবাড়ির পূজার আয়োজন করা হয় বড় আকারে। শাঁখারীবাজারে ঢোকার মুখে প্রতিদ্বন্দ্বী পূজা কমিটির মণ্ডপ। আর শাঁখারীবাজারে রাস্তায় ঢুকলে মাথার ওপরে থাকা মাচায় সারি সারি প্রতিমা। এই রাস্তায় পুরোটা জুড়ে একটু পরপর বাঁশ-কাঠের মাচার মণ্ডপ। এগুলোর সব কটিতেই দেবী দুর্গার চিরায়ত রূপ, সাজসজ্জা চোখে পড়ে।

* ১৩, ১৪ ও ১৫ অক্টোবর রাতে ঢাকার বিভিন্ন পূজা প্রাঙ্গণ ঘুরে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে।