একেই বলে শুটিং

>

সিঙ্গাপুরপ্রবাসী বাংলাদেশি নির্মাণশ্রমিকদের গানের দলটির নাম ‘মাইগ্রেন্টস ব্যান্ড সিঙ্গাপুর’। ভিনদেশে বাংলা গানের সুর ছড়ানো এই দলের গল্প গত বছরের ১০ মার্চ ‘ছুটির দিনে’তে প্রকাশিত হয়েছিল। সেই প্রতিবেদন ধরেই শাহ্ সিমেন্ট–প্রথম আলো একযোগে তৈরি করল প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের তারকা। প্রামাণ্যচিত্র তৈরির পেছনের গল্প নিয়েই এই প্রতিবেদন।

ভূত দেখার মতো চমকে গেছেন সেবাস্তিয়ান। হাতখানেক দূর থেকে পরিষ্কার দেখছি তাঁর মুখ মোটামুটি রক্তশূন্য। সামনে ব্ল্যাক ম্যাজিক ক্যামেরা চালু। কিন্তু সেবাস্তিয়ানের চোখ অন্য দিকে। ওপাশে পুরোনো তোশকের আড়ালে কিছু একটা দেখেছেন তিনি। নিশ্চয়ই ভয়ংকর কিছু!

গত বছরের সেপ্টেম্বরের ঘটনা। সিঙ্গাপুরের লিটল ইন্ডিয়া এলাকায় মাইগ্রেন্টস ব্যান্ডের প্র্যাকটিস প্যাডে এসেছি চিত্রধারণের জন্য। ঘরে ব্যান্ডের সদস্যরা মিলে গাইছেন—বাংলাদেশ! বাংলাদেশ! লাইট ঠিকঠাক। ক্যামেরাও চলতে শুরু হয়েছে। মোক্ষম মুহূর্তে এসে কী বিপদ!

 ‘এখানে কাজ হবে না। সারা ঘরভর্তি ব্যাড বাগস।’ সিদ্ধান্ত জানালেন সেবাস্তিয়ান।

নির্মাণের তারকা প্রামাণ্যচিত্রের একটি দৃশ্য
নির্মাণের তারকা প্রামাণ্যচিত্রের একটি দৃশ্য

ব্যাড বাগস? মানে ছারপোকা! সিঙ্গাপুর এসে কিনা শেষমেশ ছারপোকার পাল্লায়!

 ‘সব ছারপোকা আমার ক্যামেরার ব্যাগে ঢুকে গেছে। এই ব্যাড বাগস সঙ্গে নিয়ে গেলে পলিনা আমাকে ঘরে ঢুকতে দেবে না।’ তাঁর সমস্যা খোলাসা করলেন সেবাস্তিয়ান।

পলিনা তাঁর গার্লফ্রেন্ড। বহু কাঠখড় পুড়িয়ে এই পোলিশ তরুণকে চিত্রগ্রহণের কাজটা করতে রাজি করিয়েছি। কিন্তু এখন যে ছারপোকার উৎপাতে তাঁর ঘর-মন দুটোই ভাঙার জোগাড়।

শেষ চেষ্টা হিসেবে বোঝানোর চেষ্টা করলাম সেবাস্তিয়ানকে—মানুষ তো আমাজনের গহিন জঙ্গলে গিয়েও শুটিং করে। তুমি না ফিল্মমেকার? ফিল্মমেকারদের এত ডরপোক হলে চলে? সেবাস্তিয়ান কী বুঝলেন কে জানে। ফোন ঘাঁটাঘাঁটি করতে করতে গটমট করে চলে গেলেন তাঁর হোটেল রুমে।

মাইগ্রেন্টস ব্যান্ডের পরিবেশনা
মাইগ্রেন্টস ব্যান্ডের পরিবেশনা

সিঙ্গাপুরে যন্ত্রণাময় এক রাত কাটল। পরদিন সকাল সকাল জেগে বসে আছি। মনমেজাজ খারাপ। এর মধ্যে হোটেল রুমের দরজায় টোকা। ওপাশে সেবাস্তিয়ান। মুখে অপ্রস্তুত হাসি। বললেন, ‘ভেবে দেখলাম আসলেই তো আমি ফিল্মমেকার। চলো, কাজটা শেষ করি।’

 পরের চার দিনে সেবাস্তিয়ান মোটামুটি অবিশ্বাস্য পরিশ্রম করলেন। তার চেয়ে বড় কথা, সিঙ্গাপুরে আমাদের ‘বাংলাদেশি ভাই’দের সঙ্গে এই পোলিশ তরুণ মিশে গেলেন যাকে বলে একদম পানির মতো।

টিডব্লিউসিটু (সিঙ্গাপুরে অভিবাসী শ্রমিকদের সংগঠন ট্রান্সিয়েন্ট ওয়ার্কার্স কাউন্ট টু) মিলনায়তন থেকে সিঙ্গাপুর মাইগ্রেন্টস ব্যান্ডের যাত্রা শুরু হয়েছিল। জায়গাটা সিঙ্গাপুরের বিখ্যাত মোস্তফা মার্টের কাছে। সেখানেই মাইগ্রেন্টস ব্যান্ডের একটা পারফরম্যান্স রেকর্ডের পরিকল্পনা। কিন্তু কোথায় মিলবে দর্শক। কোথায় কী।

১৬ সেপ্টেম্বর। বিকেল পাঁচটার মতো বাজে। ব্যান্ডের কান্ডারি নীল সাগর তাঁর দলবল নিয়ে চলে এসেছেন আগেভাগে। কি-বোর্ড বসানো হচ্ছে। বাঁশি, ঢোল-তবলা সব তৈয়ার। লাইট, ক্যামেরা তৈরি। কিন্তু দর্শক কই? মানুষজনের হাততালির দৃশ্য যদি ঠিকঠাক না পাই, তাহলে তো সব বরবাদ। শিখিয়ে পড়িয়ে দু–একজনের হাততালির অভিনয় সম্ভব। কিন্তু ফরমায়েশি হাততালিতে কি মন ভরে?

শুটিং মুহূর্ত
শুটিং মুহূর্ত

দূর থেকে কাইলকে দেখছি মুখ ভোঁতা করে হাঁটাহাঁটি করছে এমাথা-ওমাথা। গত বছর লোকার্নো চলচ্চিত্র উৎসবে গোল্ডেন লেপার্ড বিজয়ী আ ল্যান্ড ইমাজিনড ছবিতে সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন কাইল। সিঙ্গাপুরে স্রেফ আমাদের ‘উপকার’ করতেই এসেছেন।

মোটামুটি দর্শকশূন্য মিলনায়তনে দলনেতা নীল সাগর গান ধরলেন, সূর্যোদয়ে তুমি, সূর্যাস্তেও তুমি। ও আমার বাংলাদেশ...

আর মুহূর্তেই ভোজবাজির মতো পাল্টে গেল সব। দেখি পিলপিল করে ঢুকছে মানুষ। সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ মিলনায়তন পূর্ণ। হাততালি আর বাংলাদেশের গানের তালে ভেসে যাচ্ছে পুরো ঘর। কে বলবে জায়গাটা সিঙ্গাপুর?

নির্মাণের তারকা তথ্যচিত্রের কাজ করতে গিয়ে অল্প সময়ে এমন কত আবেগময় অভিজ্ঞতা! সিঙ্গাপুরে চিত্রধারণ শেষে, ঢাকায় সম্পাদনা আর কালারিংয়ের দায়িত্ব নিলেন এস আর জিতু। শব্দ সম্পাদনায় যুক্ত হলেন জাতীয় পুরস্কার বিজয়ী রিপন নাথ।

আবুল খায়ের গ্রুপের ব্র্যান্ড মার্কেটিং ডিরেক্টর নওশাদ চৌধুরীর আগ্রহেই এই প্রকল্পের এগিয়ে যাওয়া। আর প্রথম আলোরসহযোগী সম্পাদক আনিসুল হক পুরোটা সময় ছায়া হয়ে ছিলেন মাথার ওপরে।

মাইগ্রেন্টস ব্যান্ড সিঙ্গাপুরের দলনেতা নীল সাগরের সেলফিতে লেখক এবং চিত্রগ্রাহক সেবাস্তিয়ান (বাঁ থেকে)
মাইগ্রেন্টস ব্যান্ড সিঙ্গাপুরের দলনেতা নীল সাগরের সেলফিতে লেখক এবং চিত্রগ্রাহক সেবাস্তিয়ান (বাঁ থেকে)

অভিবাসী মানুষের এই ব্যান্ড দলের সদস্যদের যাওয়া–আসার খেলায় বলা হলো না এই ব্যান্ডের মানসী ঘোষ, সোহেল রানা, জুলফিকার আলী, আকাশ আলীমের মতো বেশ কিছু সদস্যের কথা।

কিছু সীমাবদ্ধতার মধ্যেও নির্মাণের তারকা ক্ষুদ্র এই নির্মাতার কাছে অবিস্মরণীয় এক অভিজ্ঞতা। কারণ, এই তথ্যচিত্র ভিনদেশে বাংলাদেশিদের সাফল্যের কথা বলে। বিশ্বকে মনে করিয়ে দেয়—সাগর, সোহাগ, ফজলু, আর জমিরের মতো মেহনতি মানুষেরাই আসল বাংলাদেশ। যাঁরা দূর পরবাসে থেকেও দল বেঁধে গান দেশের গান। তাঁদের ভাষায় ‘দেশের গান গাইলে মনটা ভালো থাকে।’