বাংলার জয়

অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী
অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী

অস্ট্রেলিয়ায় বসবাসকারী বাংলাদেশিদের জীবনযাপন, সুখ-দুঃখের পর্যালোচনাই ছিল আমার পিএইচডি অভিসন্দর্ভের মূল বিষয়। অভিবাসীদের কাছে উপস্থাপনের জন্য তৈরি প্রশ্নমালা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় অনুবাদ করতে বলা হয়েছিল। সেদিনই কম্পিউটারে বাংলা লেখার হাতেখড়ি। দেশ থেকে সাড়ে ৯ হাজার কিলোমিটার দূরে প্রশান্ত মহাসাগরের পূর্ব উপকূলের এক শহরতলিতে বসে বাংলায় লিখতে পেরে কেমন লাগছিল, তা বলে বা লিখে বোঝানো যাবে না। তবে সেদিন আমার মধ্যে নতুন এক আমাকে আবিষ্কার করি। দিনরাত বাংলা শব্দের নাচন মাথার ভেতর। কম্পিউটারে লিখে জমিয়ে রেখে তবেই শান্তি। আলোর মুখ দেখা হলো কি হলো না, তা নিয়ে পরে ভাবা যাবে।
বাড়ির কাজ হিসেবে সবার আগে তৈরি জরিপ প্রশ্নমালা। যথাসময়ে জমা দিই তত্ত্বাবধায়ক বরাবর। বাংলা অনুবাদের পাতা হাতে নিয়ে গবেষণা নির্দেশকের মন্তব্য, ‘হোয়াট আ বিউটিফুল ম্যানুস্ক্রিপ্ট!’ এই বর্ণমালা রক্ত দিয়ে কেনা, বলেছিলাম ওদের বড় গর্ব করে, যদিও বুক কাঁপছিল, আটকে রাখতে পারিনি চোখের পানি।
‘এথিকস ক্লিয়ারেন্স’-এর জন্য গবেষণা সম্পর্কে ছোট্ট একটা ভূমিকা লিখতে হয়েছিল বাংলায়, যেখানে নির্দেশকদের নামও বাংলায় লিখেছিলাম। তাই দেখে তাজ্জব ওরা। বাংলা ভাষায় লেখা ওদের নাম! জুলি তৎক্ষণাৎ কাঁচি দিয়ে ওদের নামগুলো কেটে নেয়। বুঝতে পারিনি, ও ঠিক কী করতে যাচ্ছে। দরজায় ওদের নাম লেখা যে ছোট্ট বাক্সটা ছিল সেখানে ওদের নাম ইংরেজিতে লেখা। তার পাশেই ওদের বাংলা নামটা প্রতিস্থাপন করেন জুলি। কাছে গিয়ে দেখি, মাইকেলের নামটা জুলি উল্টো করে বসিয়েছেন। আমি তা ধরিয়ে দিতেই হো হো করে হেসে ওঠে তারা। তাদের হাসি শুনে অন্য বিভাগের কজন শিক্ষকও ছুটে আসেন। আমার পরামর্শমতো বাক্সটা খুলে জুলি ঠিক করে বসায় মাইকেলের বাংলা নাম লেখা ছোট্ট কাগজ।
সেই প্রশ্নমালা আর গবেষণা সম্পর্কে ছোট্ট ভূমিকা হাতে নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছিলাম তিন–তিনটি অঙ্গরাজ্য—ভিক্টোরিয়া, নিউ সাউথ ওয়েলস আর কুইন্সল্যান্ড। বছর তিনেক বাদে প্রবাসী ভাইবোনদের হাসি কান্না, আনন্দ-বেদনার গল্পগুলোকে এক মলাটে নিয়ে অভিসন্দর্ভ জমা দেওয়ার দিন আকাশ ভেঙে বৃষ্টি পড়ছিল। জুলি তার বিশাল ছাতায় করে আমাকে নিয়ে যাচ্ছিল নির্ধারিত ভবনের দিকে। পাশে পাশে আছে আমার কন্যা ও তার বাবা, অন্য ছাতার নিচে। জুলি জানতে চাইল ‘কনগ্র্যাচুলেশন’-এর বাংলা কী?
‘অভিনন্দন’ উচ্চারণ করতে ওর দাঁত ভেঙে যাওয়ার জোগাড়। ওভারকোটের পকেট থেকে কাগজ–কলম বের করে লিখে দিতে বলল। আমি ইংরেজি শব্দে লিখে দিলাম অভিনন্দন শব্দটি। এবার বেশ সহজে বলতে পারল জুলি।
যে মুহূর্তে আমি জমা দিচ্ছিলাম অভিসন্দর্ভ, সেই মুহূর্তে জুলির নতুন এক শিক্ষার্থী নাম লেখাচ্ছিলেন, পিএইচডি শিক্ষানবিশ হিসেবে। জেমস নামের সেই যুবকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন জুলি আমাকে বেশ বড় গলায়। জেমসকে তিনি শিখিয়ে দিলেন আমাকে ‘অভিনন্দন’ বলার জন্য। সেই চিরকুট দেখে অনেক কসরত করে জেমস আমাকে ‘অভিনন্দন’ বলল। আমি বললাম, ‘তোমার হলো শুরু, আমার হলো সারা।’ হাঁ করে তাকিয়ে ছিল আমার দিকে—জুলি ও জেমস। আমি বেশ গর্বিত ভঙ্গিতে বললাম, আমাদের কবিগুরু জীবনের সব অবস্থা নিয়ে লিখে গেছেন। তাঁর কথাগুলো জায়গামতো বসিয়ে দিতে পারলেই হলো। নিজ থেকে কিছু না বললেও চলে।
শিক্ষাজীবনের শেষ বিদায়ের দিন গিয়েছিলাম ওদের কামরায়। দেখে এসেছিলাম দরজায় শোভা পাচ্ছিল আমারই লেখা বাংলায় ওদের নাম; মাইকেল লিচ ও জুলি কিম্বার। ওরা আমাকে বলেছে, এই সুন্দর অচেনা বর্ণ কটি প্রতিদিন মনে করিয়ে দেবে আমার কথা।

সালমা বিনতে শফিক
অস্ট্রেলিয়া।