ক্যামেরায় আঁকেন সম্পর্কের ছবি

সালমা আবেদিন। ছবি: ছুটির দিনে
সালমা আবেদিন। ছবি: ছুটির দিনে

আলোকচিত্রী হওয়ার কোনো পরিকল্পনা ছিল না সালমা আবেদিন পৃথ্বীর। ছোটবেলায় সত্যজিৎ রায়ের গোয়েন্দা চরিত্র ফেলুদার প্রেমে পড়ে হতে চেয়েছিলেন গোয়েন্দা। কিন্তু গোয়েন্দাগিরি আর করা হয়ে ওঠেনি। তবে এখন ক্যামেরা আর গবেষণার মাধ্যমে অন্যভাবে গোয়েন্দাগিরি করেন। মানুষের মনের, জটিল জটিল সম্পর্কের।

২০০৬ সালে ঢাকায় বেগম বদরুন্নেছা মহিলা কলেজ থেকে স্নাতক হয়ে কাজ শুরু করেন একটি টেলিভিশনে, সহকারী প্রযোজক হিসেবে। ২০০৮ সালে নিউজরুম সম্পাদক এবং উপস্থাপক-সঞ্চালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সংবাদ উপস্থাপনা করেন কিছুদিন। এই সময়ে তাঁর সহকর্মীদের তোলা কিছু আলোকচিত্র দেখে অনুপ্রাণিত হন। ছবিগুলোই মূলত তাঁকে আলোকচিত্রী হতে উৎসাহ জোগায়।

সেই অনুপ্রেরণা নিয়ে আলোকচিত্রের প্রাথমিক কোর্স করতে ভর্তি হন ঢাকায় পাঠশালা সাউথ এশিয়ান মিডিয়া ইনস্টিটিউটে। কিন্তু কারিগরি ক্লাসগুলো করতে গিয়ে মনে হতে থাকে, এ তো বেশ কঠিন। ছবি তোলা আসলেই অনেক ঝামেলার কাজ। বেসিক কোর্স শেষ করে ভর্তি হন তিন বছরের পেশাদার কোর্সে। সেই কোর্সের কারিগরি ক্লাস ছাড়া বাকি ক্লাসগুলো খুবই ভালো লাগতে থাকল। তৃতীয় বর্ষে পড়তে পড়তে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন, টেলিভিশন ছেড়ে আলোকচিত্রী হিসেবেই পেশা গড়বেন।

পাঠশালায় পড়াশোনা শেষ করে পৃথী মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে শুরু করলেন। ছবি তোলার চেয়ে তাদের কথা শুনতে লাগলেন বেশি। মানুষের সম্পর্কের জটিল সমীকরণ বুঝতে চেষ্টা করলেন। শুরু করলেন অতিপরিচিত, পরিচিত, অল্প পরিচিত, অচেনা মানুষের সঙ্গে কথা বলা। স্বামী-স্ত্রী, ভাই-বোন, পরিবারের ভেতর ও বাইরের মনোদৈহিক সম্পর্কের অনুসন্ধান করা এবং তার ভিত্তিতে করা ‘ডিয়ার লাভ’ ফটো সিরিজটি প্রদর্শিত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের মনক্রিপ ক্যানসার ইনস্টিটিউটে।

পৃথীর ছবি তোলার ধরন ছবি তোলার গতানুগতিক ধারা থেকে ভিন্ন।মেয়েরা সাধারণত নিজের পরিবারে বেড়ে ওঠার গল্প, একধরনের নিয়মের বেড়াজাল এবং তাঁর জীবনযাপন নিয়ে সামাজিক ব্যবস্থাকে প্রশ্ন করেন না।কল্পনাপ্রবণ, অনুভূতিপ্রবণ পৃথী তাই তাঁর ছবির মাধ্যমে প্রশ্ন করতে চান সম্পর্কের সংজ্ঞাগুলো, জটিলতাগুলো। ঘরে স্টুডিও বানিয়ে বিভিন্নভাবে প্রতিকৃতি তুলেছেন—যে ছবিগুলো মনের ওপর চাপ প্রয়োগ করে। ‘গ্লুমি সানডে’ সিরিজের ছবিগুলোর জন্য ২০১৭ সালে পেয়েছেন নিউইয়র্ক থেকে ‘উইমেন ইন ফটোগ্রাফি’ গ্রান্ট।

পুরান ঢাকায় ছোটবেলায় দেখা একটা ঘটনা এখনো পৃথীকে তাড়িয়ে বেড়ায়। অনেক লোক এক পকেটমারকে পিটিয়ে মেরে ফেলে। এই দৃশ্য পৃথীসহ পরিবারের অন্যরা দেখেন বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে। নিজের চোখের সামনে ঘটে যাওয়া সেই মেরে ফেলার ঘটনা বারবার ভেসে ওঠে। বর্তমান সময়ে বিভিন্ন কারণে মানুষের অসহিষ্ণু হয়ে ওঠা এবং ছোটখাটো কারণে মানুষ মারার যে সংস্কৃতি, সেটা পৃথী বিচলিত করে। নিয়ত ঘটে যাওয়া এসব মেরে ফেলার ঘটনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আর পত্রিকার মাধ্যমে সংগ্রহ করে বারবার সেটা পড়েন। আর খুঁজতে থাকেন এই মনোবৈকল্যের পেছনের কারণ। ঘটনাগুলোকে অনুসন্ধিৎসু মনে, বারবার কল্পনায় চিত্রায়ণ করেন। তারপর সেই ঘটনাকে এমনভাবে উপস্থাপন করেন, যাতে সেই ছবিগুলো হয়ে দাঁড়ায় একেকটা গল্প-ভায়োলেন্স আর মানবিক বিপর্যয়ের একেকটা শক্তিশালী মেটাফর। শিশু হত্যা, ধর্ষণ শেষে মেরে ফেলা, সামান্য কারণে খুন করাসহ সমাজে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোকে তুলে ধরা আলোকচিত্র সিরিজটি ২০১৯ সালে ম্যাগনামের ‘ফটোগ্রাফি এবং সোশ্যাল জাস্টিস’ ফেলোশিপ অর্জন করেছে। ২৩টি দেশের ৭০০ আবেদনকারীর মধ্যে নির্বাচিত ৯ জন আলোকচিত্রশিল্পী, সাংবাদিক, অ্যাকটিভিস্টের মধ্যে সালমা আবেদিন পৃথী একজন।

পৃথীর এসব ভায়োলেন্সের খবর পড়তে পড়তে ক্লান্তি পেয়ে বসে। মানসিক ও শারীরিকভাবে অসুস্থতার ভেতর দিয়ে তাঁর কাজ চালিয়ে যান। শুরু করতে চান সামাজিক সচেতনতার কাজ। শুধু গ্যালারিতে প্রদর্শনীর মাধ্যমে নয়, নিজের কমিউনিটিতে মানুষকে আহ্বান জানিয়ে, ডায়ালগ তৈরি করে, আলাপের ভিত্তিতে চালিয়ে যেতে চান সচেতনতা। মানুষের এই মূল্যবোধ অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে স্বপ্ন দেখেন মানুষ একদিন ফিরে পাবে তাদের মূল্যবোধ, বন্ধ হবে নিজেদের ভেতর এই অনাকাঙ্ক্ষিত হানাহানি।

আবীর আবদুল্লাহ: আলোকচিত্রী এবং পাঠশালা সাউথ এশিয়ান মিডিয়া ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ।