বিলেতের মাঠে লাল-সবুজের উচ্ছ্বাস

বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের জার্সিতে লন্ডনে এমন দৃশ্য এখন চোখ সওয়া! ছবি: লেখক
বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের জার্সিতে লন্ডনে এমন দৃশ্য এখন চোখ সওয়া! ছবি: লেখক

বাংলাদেশ দল মাঠে নামলেই গা ঝাড়া দিয়ে ওঠেন ভক্তরা। তাঁদের শিরায়-উপশিরায় বইতে শুরু করে চার–ছক্কার নাচন। ঢাকা কিংবা চট্টগ্রামের মাঠে টাইগার ভক্তদের উন্মাদনা দেখে অভ্যস্ত ক্রিকেট দুনিয়া। কিন্তু সাত সমুদ্রের ওপারে বিলেতের মাঠ কাঁপাবেন টাইগার ভক্তরা, তা কে ভেবেছিল?

ক্রিকেটের বিশ্ব আসরে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন বাংলাদেশের সমর্থকেরা। মাশরাফি-সাকিবদের খেলা মানেই গ্যালারিজুড়ে লাল-সবুজের বন্যা। টাইগার ভক্তদের উদ্‌যাপনটাও দেখার মতো। খেলার আগে স্টেডিয়ামের বাইরে বাদ্য পিটিয়ে স্লোগানে স্লোগানে ক্রিকেটীয় উৎসব। মাঠে দলের ভালো কিছুতে সোল্লাসে জেগে ওঠা গ্যালারি। আর খারাপ কিছুতে শত সহস্র গগনবিদারী দীর্ঘশ্বাস।

যুক্তরাজ্যের ইংল্যান্ড ও ওয়েলসে অনুষ্ঠিত হচ্ছে এবারের ক্রিকেট বিশ্বকাপ। খেলা হচ্ছে বিভিন্ন শহরে। বিশ্বকাপে বাংলাদেশের প্রথম ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে দুর্দান্ত জয়ে টাইগারদের উড়ন্ত সূচনা। এরপর দুই ম্যাচে নিউজিল্যান্ড ও ইংল্যান্ডের সঙ্গে প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থতা। হার-জিতের এই হিসাব ভুলে প্রশংসিত হচ্ছে বাংলাদেশিদের ক্রিকেটপ্রেম।

রটে যায় বাংলাদেশ খেলছে

৫ জুন ওভালে নিউজিল্যান্ডের মুখোমুখি হয় বাংলাদেশ। লন্ডনের পাতালরেলে লাল-সবুজের জার্সি গায়ে মানুষের ছড়াছড়ি। আছে বাঘের পুতুল হাতে তরুণ-তরুণীদের জটলা। স্টেশনগুলোতেও চিৎকার-নাচানাচি। এমন দৃশ্যে ছুটে চলা লন্ডনবাসীর কৌতূহলী চাহনি। কেউ কেউ জানতে চাইছেন—ব্যাপারটা কী? যেমন জেমস উডহল নামের এক শ্বেতাঙ্গ তরুণ এমন কাণ্ড দেখে অবাক। লন্ডনে বাংলাদেশ দলের এমন সমর্থন! টাইগার ভক্তদের সঙ্গে ছবিও তুলে নিলেন তিনি।

ব্রিটিশরা ফুটবল নিয়ে যতটা বুঁদ হয়ে থাকে, ক্রিকেট নিয়ে ততটা নয়। ঘরের মাঠে ব্যাট-বলের মহাযজ্ঞ চলছে, অথচ তারা নিরুত্তাপ। কিন্তু টাইগারদের প্রথম দুই ম্যাচে লন্ডনবাসী ঠিকই জেনে গেছে, তাদের শহরে ক্রিকেট উৎসব চলছে, আর সেখানে বাংলাদেশ খেলছে।

বাংলাদেশের পতাকা বিক্রি করছেন স্থানীয় একজন, বাংলাদেশ ম্যাচ মানেই গ্যালারি হয়ে ওঠে এক টুকরো বাংলাদেশ!
বাংলাদেশের পতাকা বিক্রি করছেন স্থানীয় একজন, বাংলাদেশ ম্যাচ মানেই গ্যালারি হয়ে ওঠে এক টুকরো বাংলাদেশ!

বিচিত্র সাজে টাইগার ভক্তরা

ওভালে দর্শক ধারণক্ষমতা প্রায় ২৫ হাজার। হিসাব বলছে, গ্যালারির ৮০ শতাংশই ছিল বাংলাদেশ ভক্তদের দখলে। গ্যালারিতে দেখা মিলল যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা অনেক বাংলাদেশির। টাইগার ভক্তরা মাঠে গেছেন বিচিত্র সাজে। গায়ে লাল-সবুজের জার্সি। হাতে পতাকা। অনেকের মাথায় রংবেরঙের ঝাঁকড়া চুলের উইগ। আর স্টেডিয়ামজুড়ে ছোট–বড় বাঘের রেপ্লিকার ছড়াছড়ি। ঢোল, ভুভুজেলা ও নানা বাদ্য নিয়ে গেছেন অনেকে। ঢোল পিটিয়ে নেচেগেয়ে দলকে উৎসাহ দেওয়ার এই আয়োজন ছিল দেখার মতো! সিংহের রাজ্যে টাইগারদের এমন উদ্‌যাপনের জোয়ারে মত্ত হয়েছেন ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর ক্রিকেটপ্রেমীও। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে অনেক ইংরেজ ক্রিকেটপ্রেমীকে দেখা গেল বাংলাদেশের জার্সি গায়ে। কেউ কেউ আস্ত টাইগার সেজে গলা মিলিয়েছেন বাংলাদেশিদের সঙ্গে। স্টেডিয়ামের বাইরে টাইগার ভক্তদের উল্লাসের অনুষঙ্গগুলোর বিক্রিও ছিল দেদার।

মুগ্ধ ক্রিকেট দুনিয়া

দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে দুর্দান্ত বিজয়ের পর টাইগার ভক্তদের উল্লাসে উত্তাল ওভাল। ঠিক সেই সময়ে আইসিসির ক্যামেরায় ভেসে উঠলেন সাবেক আইরিশ ক্রিকেটার নিয়ল ও’ব্রিয়েন। লাল-সবুজের সমুদ্রের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি বললেন, ‘অবিশ্বাস্য দৃশ্য আজকের এই ওভালে। সমর্থকদের দেখুন। ঢাকা, সিলেট, খুলনা, রংপুর—সবখানেই আজ এমন উল্লাস।’

নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে বাংলাদেশ হেরেছে। কিন্তু দলটির জয়ের নায়ক রস টেলর খেলা শেষে টাইগার ভক্তদের স্মরণ করতে বাধ্য হলেন। সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশিদের ক্রিকেটপ্রেমের প্রশংসা করে তিনি বলেন, ‘মনেই হয়নি ওভালে খেলছি। মনে হচ্ছিল যেন ঢাকার মিরপুর বা চট্টগ্রামে আছি।’ স্পিনার মিচেল স্যান্টনার আরও সরল স্বীকারোক্তি দিয়ে বললেন, তাঁকে বাংলাদেশের ক্রিকেটার ও সমর্থক—দুটোর সঙ্গে লড়তে হয়েছে।

আর যুক্তরাজ্যের ডেইলি টেলিগ্রাফ–এর খবরে বাংলাদেশ সমর্থকদের উদ্‌যাপনকে ‘বিশ্বকাপ কার্নিভ্যাল’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। স্পোর্টস টুয়েন্টিফোর বলেছে, ওভালে বাংলাদেশি সমর্থকদের সমুদ্রে প্রতিপক্ষ যেন অতিথি দল।

বাংলাদেশের সমর্থকদের যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি প্রশংসা কুড়িয়েছে তা হলো, দল হারলেও টাইগার ভক্তরা সমানভাবে সমর্থন জুগিয়ে যাচ্ছেন। অর্থাৎ ক্রিকেট কেবল তাঁদের কাছে জয়ের বিষয় নয়; বরং আনন্দের উপলক্ষ, উপভোগের বিষয়। ভিনদেশে টাইগার ভক্তরা যেভাবে নিজেদের জানান দিলেন, তা ক্রীড়ামোদী জাতি হিসেবে বাংলাদেশকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাবে, সন্দেহ নেই।