অসংখ্য ঘটনার নায়ক মাশরাফি

>

তাঁরা বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের খেলোয়াড়দের বন্ধু। কেউ বাল্যবন্ধু, কেউ আবার স্কুলের সহপাঠী। বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান তাঁদের কাছে শুধুই ফয়সাল, মুশফিকুর রহিম হয়ে আছেন এখনো মিতু, তরুণ তুর্কি সাইফউদ্দিন তাঁদের সাইফ। জাতীয় দলের কয়েকজন ক্রিকেটারের বেড়ে ওঠার দিনগুলোর হাঁড়ির খবর বন্ধুদের জানা। ২২ গজের সেই তারকাদের কথাই লিখেছেন তাঁদের বন্ধুরা।

মাশরাফি বিন মুর্তজার সঙ্গে তাঁর বন্ধু সঞ্জীব বিশ্বাস
মাশরাফি বিন মুর্তজার সঙ্গে তাঁর বন্ধু সঞ্জীব বিশ্বাস

অসংখ্য ঘটনার নায়ক মাশরাফি

‘মানবিক গুণে অনন্য, বাংলাদেশকে তুলে ধরেছে বিশ্ব আসরে’—মাশরাফি বিন মুর্তজাকে নিয়ে এসব আলোচনা যখন হয়, বাল্যবন্ধু হিসেবে গর্বে আমার বুক ভরে যায়। আমার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় লোকজন যখন বলে ওই যে মাশরাফির বন্ধু, তখন নিজেকেও তারকা তারকা মনে হয়। প্রথম শ্রেণি থেকে কলেজ পর্যন্ত তার সঙ্গে পড়েছি। খেলাধুলার ঝোঁকে পড়াশোনা আর হয়নি। এখন ‘ক্রিকেট কোচ’ পেশা হিসেবে নিয়েছি।

মাশরাফি যখন নড়াইলে আসে, তখন একেবারে সাধারণ একজন হয়ে যায়। মনে হয় ছেলেমানুষ। ফিরে যায় শৈশবে। বিশ্বনন্দিত তারকা, বর্তমানে সাংসদ। আমুদে মানুষটির আচরণে তা বোঝাই যায় না। বড় মনের মানুষ সে। নড়াইলে তার বন্ধুত্ব তথাকথিত নিচু শ্রেণির মানুষের সঙ্গেই বেশি। জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব অকৃত্রিম। গোপনে গোপনে আর্থিকভাবে সহায়তা করে এসব বন্ধুকে। অনেককেই স্বাবলম্বী করেও তুলেছে। কিন্তু আরেক বন্ধু তা জানতে পারে না। এভাবে শুধু বন্ধুদেরই নয়, সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষগুলোরও অকৃত্রিম বন্ধু সে।

সব ধরনের গ্রাম্য খেলায় তার পাল্লায় পড়ে মেতে থাকতে হতো বন্ধুদের। শৈশবকালের অধিকাংশ সময় তার কেটেছে পাশেই নানাবাড়িতে। কাছেই ছিল চিত্রা নদীর ‘কুণ্ডুবাড়ির ঘাট’। শৈশবকালে দিনের সবচেয়ে বেশি স্মৃতি সেখানে। ভাত খেতে বসেছি, এ অবস্থায় ধরে নিয়ে এসেছে, নদীতে যেতে হবে। অভিভাবকদের দেওয়া হতো গোসল করার অজুহাত। বেশির ভাগ দিন সকাল ১০টা থেকে বেলা তিনটা পর্যন্ত নদীতে। কেউ চলে যেতে উঠলে মাশরাফি এসে কাদা মাখিয়ে দিত। তাই আবার নামতে হতো।

চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র তখন। স্কুলে ক্লাসের ফাঁকে খেলছি ‘চোর ছোঁয়া’ খেলা। সে হয়েছে চোর। অন্যদের ছুঁয়ে দিতে হবে। যাকে ছোঁয়া হবে, সে হয়ে যাবে চোর। এক ছাত্রী বন্ধুকে এ খেলায় ছুঁতে গিয়ে জোরে থাপ্পড় লাগে তার গায়ে, সঙ্গে সঙ্গে নালিশ স্যারদের কাছে। মাশরাফির নানি ছিলেন সহকারী শিক্ষক। অভিযোগ পেয়ে শিক্ষক নানি তালপাখার হাতা দিয়ে আচ্ছামতো কষতে থাকলেন মাশরাফিকে। এ দেখে আমরা তখন সবাই চিৎকার করে কাঁদছি। কাঁদছে মেয়েটিও। নানির কাছে মেয়েটিসহ সবাই হাতে-পায়ে ধরে মাফ পাই।

এ ধরনের ছোট ছোট অসংখ্য ঘটনার নায়ক ছিল মাশরাফি। 

অনুলিখন: মারুফ সামদানী, লোহাগড়া, নড়াইল 

সাকিব আল হাসানের সঙ্গে খান নয়ন
সাকিব আল হাসানের সঙ্গে খান নয়ন

সবার সাকিব আর আমাদের ফয়সাল

ক্রিকেটের সঙ্গে সাকিবের সখ্য কবে থেকে, এটা মনে হয় না কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারবে। তাই অনেকেই মজা করে বলে, আমাদের ফয়সাল জন্ম থেকেই ক্রিকেট খেলছে! বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসানের ডাকনাম ফয়সাল। পরিবার, পাড়া-প্রতিবেশী থেকে আমরা বন্ধুরা ফয়সাল নামেই তাকে ডাকি।

আমরা মাগুরা সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে পড়তাম। সাকিব পড়তে চলে গেল বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিকেএসপিতে। তত দিনে সাকিব রীতিমতো স্কুলের তারকা খেলোয়াড়। আর এখন তো জাতীয় তারকা।

স্কুলজীবনে ফয়সালকে নিয়ে টানাটানি চলত, এমনও হয়েছে, তাকে দলে ভেড়ানো নিয়ে বন্ধুদের মধ্যে মনোমালিন্য হতো। অবশ্য এখনো এই মনোমালিন্য চলে, তবে সেটা একটু অন্যদিকে রূপ পেয়েছে। এখন আর স্কুল ক্রিকেট বা পাড়া-মহল্লার মধ্যে খেলা হয় না। আমরা বন্ধুরা ঈদে বা অন্য ছুটির সময় মাগুরা গেলে বিবাহিত বনাম অবিবাহিতদের মধ্যে খেলা হয়। সব সময় বিবাহিত দল জেতে, কারণটাও ওই ফয়সাল। এই তো গত কোরবানির ঈদে ফুটবল খেলার আয়োজন করলাম বন্ধুরা মিলে, সাকিব আল হাসান প্রথমে খেলবে না বলে জানাল, খবর শুনে অবিবাহিত দল ভীষণ খুশি। কিন্তু খেলা শুরু হলে হঠাৎই মাঠে নেমে পড়ল। কিছু সময়ের মধ্যে দুই গোল করে বসল!

সবাই হয়তো জানেন, সাকিব খুব চুপচাপ স্বভাবের ছেলে। তবে আমরা তাকে চিনি একটু অন্যভাবে। সাকিব চেনাজানা মানুষের সঙ্গে আড্ডা দিতে ভীষণ পটু। তবে গল্প বলার চেয়ে গল্প শুনতে বেশি পছন্দ করে। সুযোগ পেলেই সব বন্ধুকে বাসায় ডেকে নিয়ে চলে বিরতিহীন আড্ডা।

তবে এখন সবার ব্যস্ততার কারণে আড্ডা কিছুটা কমে গেছে। কিন্তু সবার সঙ্গে সাকিবের নিয়মিত যোগাযোগ হয়। সুযোগ পেলেই বন্ধুরা মিলে মাঠে বসে খেলা দেখি। কখনো সাকিবকে সমর্থন করতে বিদেশের মাটিতে গিয়েও হাজির হই।

মাগুরায় পাড়ার ক্লাব, স্টেডিয়াম, দোয়ারপাড় মোড়, নোমানি ময়দান, নদীর কূল বা কোনো দূরের গ্রাম ঘোরা বা আড্ডা আমাদের ভীষণ প্রিয়। আর ঢাকাতে একসময় নিয়মিত টিএসসি আর রাইফেলস স্কয়ার (বর্তমান সীমান্ত স্কয়ার) এবং মিরপুরে আড্ডা হতো বন্ধুদের। কিন্তু সাকিবের তারকাখ্যাতির পর বাইরে আড্ডা বেশ কমে গেছে। 

অনুলিখন: কাজী আশিক রহমান, মাগুরা 

বন্ধু মাহমুদউল্লাহর সঙ্গে লেখক (বাঁয়ে)
বন্ধু মাহমুদউল্লাহর সঙ্গে লেখক (বাঁয়ে)

মাহমুদউল্লাহ আমার মাঠের প্রতিপক্ষ

এই লেখার জন্য বন্ধুদের আড্ডায় রিয়াদের (জাতীয় দলের ক্রিকেটার মাহমুদউল্লাহ) কাছ থেকে যে উঁচু দরের পচানি হজম করতে হতো, শুরুতে সেই চিত্রই মনের ভেতর উঁকি দিচ্ছে! পার্কের আড্ডায় হয়তো তার প্রথম বাক্যটাই হতো, ‘দেখছস, হীরা তো আমার বিরাট বন্ধু হয়ে গেছে রে!’ তবে সৌভাগ্যই বলতে হবে, লেখাটা যখন প্রকাশিত হচ্ছে, রিয়াদ সে সময়টায় দেশে নেই (দেশে নেই মানেই শিগগিরই ময়মনসিংহে আসার সম্ভাবনাও নেই)।

চেহারার মধ্যে সহজাত গম্ভীর ভাবটা রেখে বন্ধুদের পচানোর দক্ষতায় রিয়াদের জুড়ি মেলা ভার। তার পচানি খেয়ে যে রাগ করবে কিংবা অভিমান করবে, তারও উপায় থাকে না। কারণ, ওর ওপর রাগ করে থাকাটা আরেক চ্যালেঞ্জিং ব্যাপার। কোনো না কোনো ছুতোয় রাগ ভাঙাবেই, এমন একটা অবস্থা তৈরি করবে—এসবের কিছুই, কখনো হয়নি। মানুষকে বাগে আনার রিয়াদের এই অসীম গুণটা ছোটবেলার (বন্ধু বিপুল দে এর বড় প্রমাণ। তাঁদের দুজনের সম্পর্ককে বন্ধুমহলে যে ভাষায় উল্লেখ করা হয়, তা জনসমক্ষে বলার সাহস আমার নেই!)।

রিয়াদের সঙ্গে আমার বন্ধুত্বের দিনক্ষণ মনে নেই। সম্পর্কে আমরা চাচা-ভাতিজা। ছোটবেলা থেকে ক্রিকেট ঘিরেই আমাদের স্বপ্ন দেখা। আমাদের ‘বড় বাড়ি’। পাশাপাশি দুই বাড়ি। ছোটবেলায় ওদের বাড়ির বড়রা আমাদের এখানে খেলতে আসত। আমরা ছোটরা সেই দলে ভিড়তাম।

আমরা বড় হতে থাকলাম। বাড়ির আঙিনা ছেড়ে মাঠে হাজির হলাম। ক্রিকেট নিয়ে স্বপ্ন ডালপালা মেলল। সার্কিট হাউস মাঠে আমরা ২০-২৫ জন একসঙ্গে অনুশীলন করতাম। এটাই আমাদের দল, সবাই আমরা বন্ধু। দলের মধ্যমণি—মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। স্কুল ক্রিকেট ছাপিয়ে ক্লাবের আসরে নাম লেখালাম। কিন্তু কখনোই রিয়াদ আর আমি এক ক্লাবে খেলতে পারিনি বা খেলার সুযোগ হয়নি। তাই আমরা সব সময় মাঠের প্রতিপক্ষ। ২২ গজের উত্তেজনায় দুজনেই মুখোমুখি হয়েছি অসংখ্যবার।

রিয়াদ ছুটি পেলেই চলে আসে ময়মনসিংহে। তাকে ঘিরেই আমাদের পার্কের আড্ডা জমে ওঠে। সে না থাকলেও রিয়াদকে ঘিরেই আমাদের আড্ডা হয়। আসলে রিয়াদ আমাদের গর্ব, রিয়াদ আমাদের প্রতিনিধি। যখন সে মাঠে খেলে, তখন মনে হয় আমরা খেলছি। 

অনুলিখন: সজীব মিয়া 

মুশফিকুর রহিমের সঙ্গে আসাদুজ্জামান জেকি। ছবি: সংগৃহীত
মুশফিকুর রহিমের সঙ্গে আসাদুজ্জামান জেকি। ছবি: সংগৃহীত

মুশফিক আমার প্রাণের বন্ধু

স্পষ্ট মনে আছে, ২০০০ সালের ১৪ জুলাই আমরা বিকেএসপিতে ভর্তি হই। মিতুর (মুশফিকুর রহিম) সঙ্গে একই ব্যাচে ভর্তি হতে পারায় নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করি। জাতীয় দলের তারকা খেলোয়াড় বলে নয়, ওর মতো ভালো ছেলেকে বন্ধু হিসেবে পাওয়াটাই গর্বের। আমার জীবনে দেখা সবচেয়ে ভালো ছেলেদের মধ্যে মুশফিক সেরা। যার কোনো দোষ-ত্রুটি বা অহমিকা নেই।

বিকেএসপিতে আমরা একসঙ্গে ছয় বছর পড়াশোনা করেছি। তখন একটা ওপেন সিক্রেট বিষয় ছিল, শুধু আমাদের ব্যাচেই নয়, বিকেএসপির সব ছাত্রের মধ্যে সবচেয়ে ভদ্র ছেলে মুশফিক। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ত, সময়মতো মাঠে যেত। হোস্টেলের কোনো দুষ্টুমিতে থাকত না। ক্লাস সেভেন থেকে এইচএসসি পর্যন্ত ক্লাসের ফার্স্ট বয়। এসএসসি-এইচএসসিতে পেয়েছিল জিপিএ–৫।

মুশফিকের একটা গুণের কথা হয়তো কারও জানা নেই। ও খুব ভালো ছবি আঁকতে পারে। দেয়ালিকা (দেয়াল পত্রিকা) প্রতিযোগিতায় ছবি আঁকলে প্রথম স্থান অর্জন করত। মুশফিকের আঁকা ছবি দেখে স্যারদেরও অনেক সময় অবাক হতে দেখেছি। হাতের লেখাও মুক্তার মতো ঝকঝকে।

 রুমমেট না থাকলেও দুজন ছিলাম প্রাণের বন্ধু। আমার জীবনের একটা বড় অংশে লেখা থাকবে বন্ধু মুশফিকের নাম। আমি পেস বোলিং অলরাউন্ডার ছিলাম। কিন্তু স্পাইক কেস কেনার সামর্থ্য আমার ছিল না। ও সচ্ছল পরিবারের ছেলে হওয়ায় ছাত্র থাকা অবস্থাতেই আমাকে সিএ স্পাইক কেস কিনে দিয়েছিল।

আমরা বন্ধুরা সবাই খুব মিষ্টি পছন্দ করতাম। ছুটি শেষে বাড়ি থেকে ফেরার সময় ও ১০ কেজি মিষ্টি বা দই নিয়ে আসত। তার বেশি অংশই বরাদ্দ থাকত আমার আর ইমরানের জন্য। আমরা দুজন অন্যদের চেয়ে বেশি খেতে পারতাম।

বিকেএসপি থেকে বের হয়েছি ২০০৬ সালে। অথচ সবার সঙ্গে এখনো ও নিয়মিত যোগাযোগ রাখে। ওর বিয়ের সময় সবাইকে আলাদাভাবে ফোন করে ও কার্ড পাঠিয়ে দাওয়াত দিয়েছে। বিপদে-আপদে সবার আগে ওই খোঁজখবর নেয়। ও চট্টগ্রামে যতবার খেলতে এসেছে, আমাদের বাড়িতে আসেনি, এমন ঘটনা ঘটেনি। ভালোবেসে আমার ছেলেকে ডাকে নেক্কার নামে।

 অনুলিখন: রাশিদুল ইসলাম 

লিটন দাসের সঙ্গে জাহিদ জাভেদ। ছবি: সংগৃহীত
লিটন দাসের সঙ্গে জাহিদ জাভেদ। ছবি: সংগৃহীত

লিটনকে আমি ‘কাকু’ বলে ডাকি!

রাজশাহী বিভাগে অনূর্ধ্ব-১৩ খেলার জন্য দিনাজপুর থেকে সুযোগ পেয়েছিলাম আমরা তিনজন। কিন্তু সমস্যা হলো, লিটনের বাবাও রাজি হচ্ছিলেন না, আমার বাবাও না। অনেক অনুনয়-বিনয় করে কোচ মিঠু ভাইয়ের সহযোগিতায় আমাদের বাবাদের রাজি করানো গিয়েছিল। পরদিন সকালে স্টেশনে এসে দেখি, লিটনই পৌঁছে গেছে তার বাবাকে সঙ্গে নিয়ে।

রাজশাহীতে পৌঁছলাম তখন দুপুরে। পরদিন বাছাইপর্ব। প্রথম দিনেই তিনজনের মধ্যে লিটন আর আমি বাছাইপর্বে উত্তীর্ণ হলাম। পরে তিন দিন সেখানে অনুশীলন শেষে খেলার উদ্দেশ্যে ঢাকা যাত্রা করি। তখন নানা গল্পের মধ্যে ‘কাকু’ শুধু একটা কথাই বলত, যেমন করেই হোক ভালো খেলতে হবে।

আমরা মহারাজা গিরিজানাথ স্কুলে একসঙ্গে পড়তাম। সখ্য হয় ষষ্ঠ শ্রেণিতে ওঠার পর। তখন আমরা মাঠে নিয়মিত ক্রিকেট অনুশীলন শুরু করি। বন্ধু হলেও দুজন দুজনকে ‘কাকু’ বলেই ডাকি। খুব কম কথা বলা মানুষ লিটন। চুপচাপ থাকতে পছন্দ করে। কোনো কারণে আমার ওপর রেগে গেলে ‘কাকু’ বলেই জড়িয়ে ধরি। ‘কাকু’ বলার সঙ্গে সঙ্গেই হো হো করে হেসে উঠি আমরা!

কাকু ছিল ম্যাককালামের উঁচু দরের ভক্ত। দলের সবার সম্পর্কে খুব ইতিবাচক মানসিকতার সে। তবে মাশরাফি ভাইয়ের নেতৃত্বের খুব প্রশংসা করে। যদিও সমবয়সী আমরা। কিন্তু লিটন যখন কোনো বিষয়ে বোঝায় বা পরামর্শ দেয়, তখন চুপচাপ শুনে যাই। যেকোনো সমস্যার সমাধান খুব ঠান্ডা মাথায় করতে পারে সে।

দিনাজপুরে বাড়িতে আসার আগেই ফোনে বলে, ‘আসতেছি’। আমিও সব ব্যস্ততা শেষ করে ফেলি। ও এলে দুজনে মোটরবাইক নিয়ে বের হয়ে যাই। হাঁসের মাংস খুব পছন্দ করে কাকু। যে কদিন থাকে প্রায় সময়েই আমরা ‘দশ মাইল’ এলাকায় পাখির মাংস আর দিনাজপুরের লক্ষ্মীতলায় হাঁসের মাংস দিয়ে ভাত খেতে যাই।

দিনাজপুরের ক্রিকেট এবং ক্রিকেটারদের নিয়ে লিটনের ভাবনার শেষ নেই। কীভাবে ঢাকা লিগে, ফার্স্ট ডিভিশন লিগে দিনাজপুর থেকে বেশির ভাগের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যায়, সে বিষয়ে প্রায়শই কথা হয় আমাদের। দিনাজপুরের অনেকের জন্যই ব্যাট, প্যাড, গ্লাভস, হেলমেট, জার্সিসহ ক্রিকেট সরঞ্জামাদি পাঠায় সে। সবাইকে উৎসাহ দেয়। ভালো খেলার পরামর্শ দেয়। ক্রিকেটের প্রতি তার ভালোবাসা, একাগ্রতার যেন শেষ নেই। বন্ধু থেকে দিনে দিনে আমি যেন তার ভক্ত হয়ে উঠেছি। 

অনুলিখন: রাজিউল ইসলাম, দিনাজপুর 

তামিম ইকবাল ও মিনহাজ উদ্দিন খান। ছবি: সংগৃহীত
তামিম ইকবাল ও মিনহাজ উদ্দিন খান। ছবি: সংগৃহীত

তামিমের সঙ্গে ম্যারাথন আড্ডা হয়

তামিমের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব কলেজজীবনে। বাসাও ছিল কাছাকাছি। তামিমদের বাসা কাজীর দেউড়ি, আমাদের বাসা এনায়েত বাজার। ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আমাদের। জাতীয় দলে জায়গা পাওয়ার পরও এই বন্ধুত্ব অটুট রয়েছে।

এখন তামিম খুব একটা সময় পায় না। তবে সময় পেলেই আড্ডা হয়। আমিও কর্মসূত্রে ঢাকা থাকি। তাই সে দেশে থাকলেই নিয়মিত আড্ডা হয়। আমি ক্রীড়া সাংবাদিক হওয়ার সুবাদে খেলার মাঠে তার সঙ্গে দেখা হয়। এর বাইরেও তামিমের সঙ্গে ঢাকায় প্রায় আড্ডা হয়। তবে আড্ডা হয় মূলত নতুন নতুন রেস্তোরাঁয়। খেতে যাই। বিশেষ করে গুলশানের একটি কফি হাউসে নিয়মিত আড্ডা দিই। সেখানে খেলা থেকে শুরু করে সব প্রসঙ্গ আসে।

আমি, তামিম ছাড়াও ইয়াসির মাহমুদ এবং সুমন নামে দুই সিনিয়র বন্ধু থাকেন। সে নিজেই আড্ডা খুব পছন্দ করে। আর ঢাকার বাসায় যাওয়া–আসা তো আছেই। পারিবারিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দেখা হয়। ২০০৫-০৬ সালে সানশাইন গ্রামার স্কুল অ্যান্ড কলেজে এ-লেভেলে পড়েছি। তখন থেকেই তামিম জাতীয় দলে কড়া নাড়ছিল।

স্কুলজীবন থেকেই একই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রী আয়েশার প্রেমেই পড়েছিল তামিম। এ-লেভেলে পড়ার সময় তাদের তুমুল প্রেম চলে। তা দেখেছি আমরা। এর আগে যখন প্রেমিকার সঙ্গে তামিমের ভাব একটু-আধটু জমে ওঠে, তখন আয়েশাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল মালয়েশিয়ায়। চট্টগ্রাম টু মালয়েশিয়ার এই প্রেমের সাক্ষীও ছিল তামিমের দু–একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু। এক বন্ধুকে তো মালয়েশিয়ায় আয়েশার সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার সময় নিয়ে গিয়েছিল তামিম। এরও পর তো দুজনের সংসারজীবন শুরু।

২০০৭ সালে তামিম জাতীয় দলে সুযোগ পায়। এরপর থেকে ব্যস্ততা বাড়তে থাকে। বন্ধুদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ কমে যায়। তবে যখন সময় পায়, তখন তাদের আড্ডা হয় ম্যারাথন। চট্টগ্রামে খুব কম যায় তামিম। যদি কখনো যায়, তখন সব বন্ধুকে নিয়ে আমরা কোথাও বসি। আমরা যেটা করি বাসায় একটা কক্ষে সব বন্ধু এক হয়ে ম্যারাথন আড্ডা দিই। সেখানে স্কুল–কলেজের অনেক বন্ধু থাকে। আর ঈদ কিংবা কারও বিয়েশাদি উপলক্ষে আগে থেকে সবার সঙ্গে যোগাযোগ করে আড্ডার সব আয়োজন আগে থেকে করে নিই আমরা।

 অনুলিখন: প্রণব বল, চট্টগ্রাম 

29571460_1310244515787609_39980306814422523_n
29571460_1310244515787609_39980306814422523_n

সৈকতের সান্নিধ্য

পরিচিত মহলে ‘লেট লতিফ’ হিসেবে আমার আলাদা খ্যাতি আছে! ঘুম নামের অতিসুখকর একটা বিষয় ছোটবেলাতেই এই খ্যাতি এনে দিয়েছে। তবে এই খ্যাতির বিড়ম্বনায় পড়তে হয় মোসাদ্দেক হোসেন সৈকতের বেলায়। বন্ধুদের মধ্যে তার মতো সময়নিষ্ঠ আর কেউ নেই। সকাল ১০ মানে তার কাছে ৯টা ৫০! কোনো দাওয়াত, প্রীতি ম্যাচে অংশ নিতে কোনো এলাকায় খেলতে যাওয়া কিংবা বৈকালিক আড্ডা—এই একটি কারণেই ওর সঙ্গে কতবার যে ঝগড়া হয়েছে, মিনিট কয়েক মুখ-দেখাদেখি বন্ধ হয়েছে, তার হিসাব আমারও জানা নেই।

সৈকত এই সময়নিষ্ঠ হয়ে ওঠার গুণ হঠাৎ করে পায়নি, এটা ওর রক্তে ছিল, আপনমনে লালন করেছে। ছোটবেলায় আমরা যখন বৃষ্টিবিড়ম্বনায় বাসায় হাই তুলতাম, তখনো সে চলে যেত মাঠে, অনুশীলনে। কোনো বিশেষ দিন, কোনো পারিবারিক অসুবিধা কিংবা কোনো আয়োজন—এসবের কিছুই সৈকতের অনুশীলনে বাধা হয়ে দাঁড়াত না। বিকেলে কাজ তো সৈকত মাঠে হাজির থাকত সকালে, বিকেলে আটকে পড়েছে তো সন্ধ্যায় ঠিকই চলে যেতে ব্যাট-প্যাড নিয়ে। এই গুণগুলোই তাকে আমাদের কাছ থেকে আলাদা করে নিয়েছিল। তাই বেড়ে ওঠার দিনগুলোতে আমরা বুঝতে পেরেছিলাম, বন্ধুদের মধ্যে সৈকত আমাদের থেকে ভিন্ন। সে একদিন আমাদের গর্ব হয়ে উঠবে।

গর্বের শুরুর প্রমাণ তো স্কুলেই সে রেখেছিল। সৈকত পড়ত ময়মনসিংহ পুলিশ লাইনস স্কুলে, আমি ময়মনসিংহ ল্যাবরেটরি উচ্চবিদ্যালয়ে। আমাদের স্কুল পর্যায়ের ক্রিকেটে ওর দলের কাছে নিয়মিত হারতে হতো। ওর সময়েই টানা চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ময়মনসিংহ পুলিশ লাইনস স্কুল। একবার তো টানা তিন ম্যাচে সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে নায়ক বনে গেল সে।

সৈকতের সঙ্গে এই খেলার মাধ্যমেই আমার বন্ধুত্ব। খেলতে খেলতেই জেনেছি, সৈকত অনেক আমুদে স্বভাবের মানুষ। তবে কাজের ক্ষেত্রে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে ভয়ানক আন্তরিক।

বিশ্বকাপ খেলতে যাওয়ার আগেই আমাদের এক বন্ধুর গায়েহলুদ ছিল। সবাই মিলে সেই দাওয়াতে গেলাম, অনেক আড্ডা দিলাম। ইংল্যান্ডে ও তো ব্যস্ত সময় পার করে, নিয়মের মধ্যে থাকতে হয়। এরপরও নিয়মিত যোগাযোগ হয়। 

অনুলিখন: সজীব মিয়া

সেলফিতে সৌম্য সরকারের ডানে লেখক। ছবি: সংগৃহীত
সেলফিতে সৌম্য সরকারের ডানে লেখক। ছবি: সংগৃহীত

আমার সৌম্য বন্ধু

স্কুল আর কলেজে গণ্ডির সঙ্গে এলাকার গণ্ডিও আমাদের পেরোতে হয়েছে। শুভ, হাসিব, আমি এখন ঢাকার বাসিন্দা। তবে সবার আগে এসেছিল সৌম্য। আমরা তখন সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। সৌম্যর বাবা ও আমার বাবা দুজনই তাঁদের সন্তানকে বিকেএসপিতে ভর্তির জন্য ফরম কিনেছিলেন। সৌম্য এসে বিকেএসপিতে ভর্তি পরীক্ষা দিলেও, আমার বাবা সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেন। শেষ হয় আমার খেলোয়াড়ি জীবনের স্বপ্ন। ওদিকে সৌম্যের শুরু হয় বিকেএসপিতে আনুষ্ঠানিক খেলোয়াড় হয়ে ওঠার জীবন।

সে বিকেএসপিতে ভর্তির পর বন্ধু দলের একজন সদস্য কমে যায়। তার সঙ্গে যোগাযোগও কমতে থাকে। বিকেএসপির কঠোর নিয়মের কারণে সৌম্য মোবাইল ব্যবহার করতে পারত না, তখন আমাদের দেখা হতো সে বাড়িতে এলে। সে সময় ও যেন ক্ষণগণনা করত ছুটিছাটার। আমরাও কি নই? সৌম্য বাড়িতে এলে আমরা বন্ধুরা মিলে কী না করতাম! মোটরবাইকে ঘুরে বেড়ানো ছিল সৌম্যর প্রধানতম শখ।

সৌম্য এখন জাতীয় ক্রিকেট দলের অপরিহার্য অংশ। কিন্তু আমাদের কাছে সেই ছোটবেলার বন্ধুর মতো। বাড়িতে এলেই সৌম্য একে একে বন্ধুদের কল করে। তারপর মোটরসাইকেলে চলে ঘোরাঘুরি। চলে রেস্তোরাঁয় খাওয়া। তার পছন্দ চিকেন ফ্রাই, সালাদ। সাতক্ষীরার বিখ্যাত সন্দেশ ও দই মিষ্টি খেতেও খুব পছন্দ। তবে হাঁসের মাংস থাকলে তার আর কিছু চাই না!

এখন তো সাতক্ষীরায় এলে খ্যাতির বিড়ম্বনায়ও পড়তে হয়। তবে তাতে বিরক্ত হয় না সে। মোটরসাইকেলে ঘুরতে বের হলে প্রায় ভক্তদের সেলফির আবদার মেটাতে হয়। ভিড় সামলাতে হয় আমাদের। রেস্টুরেন্টে গেলে সৌম্যের জন্য পাওয়া যায় আলাদা কদর। ভিড়ে বেচাকেনা বন্ধের উপক্রম হয়। আমরা কিছুটা আনন্দিতই হই।

যখন সে ঢাকার বাসায় একা একা থাকে, তখন আমাদের ডাকে। শুভ, হাসিবসহ হাজির হয়ে যাই। বাড়িতে কেউ না থাকলে সেই আমাদের বাবুর্চি। বিশ্বকাপ মিশনে যাওয়ার আগে ২ এপ্রিল ছিল এমনই আয়োজন। সৌম্য নিজ হাতে ডিম ভাজি আর সবজি খিচুড়ি রান্না করে। সব মিলিয়ে সৌম্য আমার এক অন্য রকম বন্ধু। 

অনুলিখন: কল্যাণ ব্যানার্জি, সাতক্ষীরা 

65028776_1079526335566537_4646408887690330112_n
65028776_1079526335566537_4646408887690330112_n

সাইফউদ্দিন কেন বাঁ হাতে ব্যাট করে?

কে এম শওকত ইমরান

আমাদের বন্ধুমহলে তো বটেই, পরিচিতদের কাছেও মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন নামটা স্রেফ ‘সাইফ’। ওর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব অষ্টম শ্রেণিতে ওঠে। ফেনীর শাহীন একাডেমিতে আমি শিশুশ্রেণি থেকে পড়লেও সাইফ এসে ভর্তি হয় অষ্টম শ্রেণিতে। আন্তস্কুল ক্রিকেট টুর্নামেন্টের জন্য দল নির্বাচনের দায়িত্ব ছিল আমার ওপর। আমিই তখন স্কুল ক্রিকেট দলটার ক্যাপ্টেন। ছোট থেকে যেহেতু একই স্কুলে পড়ছি, তাই জানতাম কে কে ভালো খেলে। সেভাবেই দল গঠন করা হচ্ছিল। এরই মধ্যে একদিন আমার বন্ধু সজীব এসে বলে সাইফের কথা। তারপরই সাইফের সঙ্গে পরিচয়, ওর খেলার সঙ্গে পরিচয়, বন্ধুত্ব।

স্কুলের সাইফের কথা মনে পড়লে এখনো একটা দৃশ্য জ্বলজ্বল করে। সেই দৃশ্যটা এমন—সাইফ সাইকেল চালিয়ে আসছে। ওর সাইকেলে আর যা-ই থাক, একটা ব্যাট আছে সামনের অংশে বাঁধা। এটা প্রতিদিনের চিত্র।

ও আসলে মাঠের মানুষ। কখনো যদি মাঠে একজনকে খেলতে দেখা যায়, সেটা ছিল সাইফ। কখনো ফুটবল পায়ে, কখনো ব্যাট-বল হাতে, মাঠই যেন ছিল ওর ধ্যান-জ্ঞান। এই একাগ্রতাই হয়তো দিনে দিনে সাইফকে অন্য ক্রিকেটার বন্ধুদের থেকে আলাদা উচ্চতায় নিয়ে গেছে।

এ কারণেই তাকে নিয়ে আমাদের উদ্‌যাপন শুরু হয়েছিল বেশ আগে থেকেই। সে অনূর্ধ্ব-১৫ খেলছে, ১৬ খেলছে...। সব টুর্নামেন্টে ভালো করছে। এসব খবর আমরা জানতাম। অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে বিশ্বকাপ খেলল। তাই জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়ার পর আমরা তেমন অবাক হইনি, আমাদের মনে হয়েছে, এটাই তো হওয়ার কথা।

অনেকেই হয়তো দেখেছেন, সাইফ বল করে ডান হাতে, ব্যাটিং করে বাঁ হাতে। এর কারণ কী? এলাকায় যখন ছোটবেলায় খেলত, তখন মাঠের ডান অংশের বাউন্ডারি ছিল ছোট। হুটহাট চার হয়ে যেত। এ কারণে নিয়ম করে দেওয়া হয়েছিল, ব্যাটিং করতে হবে বাঁ হাতে! সেই যে অভ্যাস হয়ে গেছে, সেটাই সে এখনো ধরে রেখেছে।

আবার টেলিভিশনের পর্দায় মাঠের যে গম্ভীর সাইফউদ্দিনকে আমরা দেখি, ও কিন্তু এমন গম্ভীর মানুষ নয়। বন্ধুদের দলে ওর মতো মজার মানুষ কমই আছে। মানুষ হিসেবেও অসাধারণ (বদমেজাজি হলেও মেজাজটা এখন ওর নিয়ন্ত্রণে)!

আমার বন্ধুর জন্য শুভকামনা। 

(অনুলিখিত)