শীতল পানির ফেরিওয়ালা

ট্রেন যাত্রীদের পানি পান করাচ্ছেন হামিদুর রহমান। ছবি: সংগৃহীত
ট্রেন যাত্রীদের পানি পান করাচ্ছেন হামিদুর রহমান। ছবি: সংগৃহীত

‘পানি খান, ফ্রিতে পানি খান...।’ হাঁকডাক শুনে তাকাই মানুষটির দিকে। এক হাতে পানির পাত্র, অন্য হাতে প্লাস্টিকের ছোট মগ। সেই মগে পানি ভরেই অপেক্ষমাণ যাত্রীদের হাতে তুলে দিচ্ছেন। বরফশীতল পানি পান করে তৃষ্ণার্ত মানুষও স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ছে। তাতেই যেন আনন্দ খেলে যাচ্ছিল তাঁর চোখেমুখে।

মে মাসের সেই দুপুরে আগ্রহ নিয়ে তাঁর কাছে যাই। পাশে দাঁড়িয়ে নাম জিজ্ঞেস করতেই বললেন, ‘আমার নাম শিপন।’ আরও কথার পর জানলাম, তাঁর পুরো নাম হামিদুর রহমান। কুষ্টিয়ার কুমারখালী রেলস্টেশনে যখন ট্রেন থামে, তখন তৃষ্ণার্ত যাত্রীদের পানি পান করান তিনি। এ কাজটি করছেন ছয় বছর ধরে। হামিদুর রহমান বলছিলেন, ‘মানুষ হিসেবে মানুষের সেবা
করাই আমার কাজ। অতিরিক্ত গরমের সময় অনেকেই ট্রেনের মধ্যে তৃষ্ণার্ত থাকে। একটু ঠান্ডা পানি পেলে তাদের পিপাসা মিটতে পারে।’ শুধু গরমের সময়ই নয়, রমজান মাসে ইফতারির সময় রোজাদারদের পানি পান করান তিনি।

কুমারখালীর কাজীপাড়া গ্রামের বাসিন্দা হামিদুরকে পরিচিত মানুষেরা চেনে ‘ভিন্ন শিপন’ নামে। কেন এই নাম? মুখে হাসি ধরে রেখে বললেন, ‘আমার একটা দোকান আছে, সেটার নাম—ভিন্ন রকম দোকান।’ এই দোকানের নামের সঙ্গে মিলিয়ে আর ভিন্নধর্মী সমাজসেবামূলক কাজের কারণেই পরিচিতজনের কাছে তিনি ‘ভিন্ন শিপন’। কুমারখালী রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মের পাশেই তাঁর দোকানটি। হামিদুরের কাছে দোকানের গল্প শুনতে শুনতেই এগিয়ে যাই সেদিকে।

হামিদুর রহমান
হামিদুর রহমান

দোকানের পণ্য গামছা, তোয়ালে আর রুমাল। বিস্ময়কর তথ্য জানলাম দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে—দোকানে কোনো বিক্রেতা নেই। সেই দোকানে ক্রেতারা আসেন, পণ্য দেখেন, প্রতিটি পণ্যের গায়ে লেখা দাম দেখে পছন্দ হলে নির্ধারিত মূল্য পরিশোধ করে নিয়ে যান প্রয়োজনীয় জিনিস। পণ্য কিনে দাম পরিশোধের জন্য রয়েছে প্লাইউডের তৈরি বাক্স। সেখানেই ক্রেতারা টাকা রেখে যান। হামিদুর জানালেন, পাঁচ বছর আগে দিয়েছেন দোকানটি। এত বছরে তাঁর দোকানের একটি পণ্যও চুরি হয়নি।

হামিদুর পেশায় হকার। কখনো বাসে, কখনো ট্রেনে চেপে আবার কখনোবা ফুটপাতে বসে বিক্রি করেন লুঙ্গি, গামছা, রুমাল। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন কুমারখালী এমএন পাইলট মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। অভাবের কারণে হকারের পেশা বেছে নেন। তাতেও সংসার চালাতে কষ্ট হচ্ছিল বলে দোকানটি দেন। দোকানে দৈনিক বিক্রি থেকে প্রায় ১৫০-২০০ টাকা আয় হয়, বিক্রি বেশি হলে আয়ও কিছুটা বাড়ে। হামিদুর রহমান বলছিলেন, ‘আমি মানুষকে বিশ্বাস করি। এই বিশ্বাসের ওপর ভর করেই বিক্রেতাবিহীন দোকান করেছি। লোকে আমার বিশ্বাস ভাঙেনি।’