শত বছরের 'নাও' বাজার

>
সারি সারি নৌকাগুলো আনা হয়েছে বিক্রির জন্য। ছবি: আনিস মাহমুদ
সারি সারি নৌকাগুলো আনা হয়েছে বিক্রির জন্য। ছবি: আনিস মাহমুদ
‘বর্ষায় নাও হেমন্তে পাও’। হাওরে যাতায়াতে ছন্দময় এ কথা প্রবাদের মতো প্রচলিত। ‘নাও’ মানে নৌকা। এখন বর্ষাকাল। ‘পাও’ তো আর চলবে না, চাই ‘নাও’। সিলেটের বিভিন্ন জায়গায় বসছে নৌকাবাজার। গোয়াইনঘাট উপজেলার সালুটিকর এমনই এক নৌকাবাজার। স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে, বাজারের বয়স শত বছর।

সিলেট জেলার তিনটি উপজেলার মিলনস্থলে সালুটিকরের অবস্থান। যেন এক হাটে গিয়ে তিন উপজেলায় পদচারণ। সুরমা নদীর সঙ্গে মিলিত হওয়া চেঙ্গেরখাল নদকে ঘিরে এ হাটে বসে নাওবাজার। সিলেট সদর, কোম্পানীগঞ্জ ও গোয়াইনঘাট উপজেলার মিলনস্থল সালুটিকরে যাতায়াতব্যবস্থাটাও নাও-নদীময়। চেঙ্গেরখাল নদ ঘিরে হাওর এলাকায় সংযোগ হয়েছে নৌপথের। বর্ষায় সড়ক যোগাযোগব্যবস্থাও যেন বিড়ম্বিত। জলমগ্ন হাওর-জলাশয় আর নিচু ভূমি এলাকা নৌকা দিয়ে সহজে পাড়ি দেওয়া যায় নৌপথে। তাই তো নৌকার কদর।

প্রতিবছরই বৈশাখের শুরু থেকে নৌকার হাট বসে সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার সালুটিকর বাজারে। ক্রেতা ও বিক্রেতার বেশির ভাগ এই তিন উপজেলার মানুষজনই থাকেন। বৈটাখাল, নিয়াইন, লেঙ্গুড়া ও গোয়াইনঘাট এলাকার বিক্রেতারা বেশি নৌকা নিয়ে আসেন বিক্রির জন্য। তবে ক্রেতার ক্ষেত্রে এই উপজেলাগুলো ছাড়াও হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জ জেলার বিভিন্ন এলাকার মানুষ এখান থেকে এসে নৌকা কিনে নিয়ে যান। আশ্বিন মাস পর্যন্ত চলে এই নৌকার হাট।

কবে থেকে সালুটিকরের নাওবাজার? ৯ জুলাই নৌকার বাজারবারে এমন প্রশ্নে ক্রেতা-বিক্রেতারা বিস্ময়ের মুখে পড়েন। নির্দিষ্ট কোনো সন–তারিখ জানা নেই তাঁদের। শত বছর বলে এড়িয়ে যাওয়া। কোম্পানীগঞ্জের ভোলাগঞ্জ দেশের সর্ববৃহৎ একটি পাথর কোয়ারি। সেখানে পাথর উত্তোলনে বারকি নৌকার ব্যবহার থেকে সালুটিকরে নাওবাজার প্রতিষ্ঠা হয়। কোম্পানীগঞ্জের পশ্চিম ইসলামপুর ইউনিয়ন চেয়ারম্যান শাহ মোহাম্মদ জামালউদ্দিন জানান, সুনামগঞ্জের মাইজবাড়ি গ্রাম নৌকা তৈরির জন্য বিখ্যাত ছিল। একসময় সব নৌকার জোগান সেখান থেকে হতো। এখন সড়ক যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন হওয়ায় নৌকার চাহিদা কমে গেছে।

শতাধিক বছর থেকে চলে আসা এই নৌকার হাটে বিক্রি হয় নতুন ও পুরোনো নৌকা। সপ্তাহের শনি ও মঙ্গলবার দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে কেনাবেচা। চেঙ্গেরখাল নদের সংযুক্ত চড়ক খালে নৌকা রেখে চলে বিকিকিনি। নৌকার ওপাশে থাকে বইঠাও। একটি নতুন নৌকা কেনার পর অনুষঙ্গ নতুন বইঠা কেনার আকর্ষণ থাকে ক্রেতাদের, ‘নাও কিনলে বইঠা ফ্রি’।

নতুন বইঠা কিনতেও অনেকে আসেন সালুটিকর বাজারে
নতুন বইঠা কিনতেও অনেকে আসেন সালুটিকর বাজারে

নৌকার বাজার জমে দুপুরের পর থেকে। বিকেল চারটার দিকে জমজমাট রূপ পায়। বিক্রেতারা দু–তিনটি নৌকা একসঙ্গে বেঁধে আবার অনেকেই একটির ওপর আরেকটি নৌকা নিয়ে হাটে আসেন। নৌকা খালে বেঁধে রেখে পাশেই সড়কে ছাতা নিয়ে বসে থাকেন ক্রেতার অপেক্ষায়।

নৌকার হাটে দেখা যায়, ভালো কাঠে তৈরি নৌকার দাম বেশি। ১২ ফুট প্রস্থ ও আড়াই ফুট লম্বা প্রতিটি নতুন নৌকা বিক্রি হচ্ছে সর্বোচ্চ ৮ হাজার টাকা ও সর্বনিম্ন ৪ হাজার টাকায়। পুরোনো নৌকাও বিক্রি হয়। এগুলোর দর ৬ হাজার টাকা থেকে সর্বনিম্ন ৩ হাজার। নৌকা কিনে কেউ পানিপথে আবার কেউ ট্রাক কিংবা হিউম্যান হলারে করে নিয়ে যাচ্ছেন নিজেদের এলাকায়।

ক্রেতাদের নৌকা কিনতে ইজারাদারের কাছ থেকে আগে রসিদ সংগ্রহ করতে হয়। নৌকার হাটের এবারের ইজারাদার নূর মিয়া। তিনি বলেন, পানি বেশি থাকলে চড়কখালে নৌকার হাট বসে। আর পানি কম থাকলে ভেতরে লামার বাজার দামারি বিলে হাট বসে। এখানে বিক্রেতাদের কোনো টাকা দিতে হয় না। যাঁরা নৌকা কেনেন, তাঁরা একটি নির্দিষ্ট হারে টাকা দিয়ে রসিদ নিয়ে নৌকা কেনেন।

বিক্রেতাদের অনেকেই আবার নৌকা তৈরির সঙ্গে জড়িত। তাঁদের পরিচিতি ‘আলংদার’ (নৌকার মিস্ত্রি)। তিনজন আলংদার ও দু জন সহযোগী মিলে এক দিনে একটি নৌকা তৈরি করা যায়। সাধারণ নৌকা ছাড়া বারকি বা অন্য কোনো নৌকা তৈরিতে সপ্তাহখানেক সময় লাগে। গোয়াইনঘাটের নিয়াইন গ্রামের নৌকা বিক্রেতা ফখরুল ইসলাম বলেন, এবারের বর্ষায় পানি ভালো। তাই বিকিকিনি ভালো। সপ্তাহে দুটো নৌকা তৈরি করে দুটো হাটে তোলার ঘণ্টাখানেকের মধ্যে বিক্রি হয়েছে। নূর হোসেন নামের আরও একজন নৌকার আলংদার বলছিলেন, ‘পানি বাড়লে আমরার নৌকা বিক্রিও বাড়ে।’

নৌকার ক্রেতারা বেশি গ্রামীণ সাধারণ পরিবারের। যাতায়াত আর বর্ষায় বাড়তি পেশা মাছ ধরার কাজের জন্য নৌকা কেনেন তাঁরা। নতুন নৌকার সঙ্গে পুরোনো নৌকা সংস্কার করে চলে কেনাবেচা। ৪ হাজার টাকা দিয়ে একটি পুরোনো নৌকা কিনেছেন কোম্পানীগঞ্জের মজর আলী। তিনি বলেন, ‘দেইখা কিনলে পুরান নাও নয়ার চাইতে বেশি টিকে। তাই আমি পুরান নাও কিনছি।’ মজর আলী কৃষিকাজ করেন। কিন্তু বর্ষার সময় খেত জলমগ্ন থাকায় বিকল্প পেশা হিসেবে ভাসান পানিতে মাছ ধরার কাজে ব্যবহার করেন নৌকা।

নৌকা কেনায় নারীদেরও দেখা যায়। কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার টাইয়াপাগলা গ্রাম থেকে স্বামী আজর আলীকে সঙ্গে নিয়ে নৌকা কিনতে এসেছেন রেজিয়া বেগম। জানালেন, তাঁর স্বামী বর্ষার পুরো সময় মাছ ধরার কাজ করেন। নতুন নৌকা দিয়ে মাছ ধরার সুবিধা বেশি, তাই কিনতে চান নতুন নৌকা।