দাবায় সুরভিত খুশবু

>
দাবাই ওয়ারসিয়া খুশবুর ধ্যানজ্ঞান। ছবি: খালেদ সরকার
দাবাই ওয়ারসিয়া খুশবুর ধ্যানজ্ঞান। ছবি: খালেদ সরকার
খুদে দাবাড়ু ওয়ারসিয়া খুশবু। সম্প্রতি উজবেকিস্তানের তাসখন্দে এশিয়ান স্কুল দাবা চ্যাম্পিয়নশিপে অনূর্ধ্ব-৭ বছর বিভাগে র‌্যাপিড ও স্ট্যান্ডার্ড বিভাগে জিতেছে সোনা আর ব্লিৎজ বিভাগে রুপা

পুতুলের বিয়ে ভেঙে গেল বলে কাঁদেনি মেয়েটা। বাবার মুঠোফোনে কেন গেমস খেলতে পারেনি, সেটা নিয়েও যেন দুঃখ নেই। এরপরও একদিন স্কুল থেকে ফিরে ভীষণ কান্নাকাটি করে ওয়ারসিয়া খুশবু। কিছুতেই আর স্কুলে যেতে চায় না মেহেদি কায়সার ও শাহিদা আক্তারের একমাত্র মেয়ে। অনেক কষ্টে মেয়ের স্কুলে যাওয়ার অনাগ্রহটা আবিষ্কার করলেন বাবা-মা। ঘটনাটা তেমন কিছুই না, স্কুলের ম্যাডাম ডেকে বলেছিলেন, ‘শুধু দাবা খেললেই চলবে, পড়াশোনা করতে হবে না? দাবা খেলাটা বরং ছেড়েই দাও।’

রাগে, ক্ষোভে, অভিমানে স্কুলই ছেড়ে দিতে চেয়েছিল খুশবু। সেটাও বছরখানেক আগের ঘটনা। আসছে আগস্ট মাসে ৭ বছর পূর্ণ হবে খুশবুর। এই বয়সের মেয়েরা যখন মুঠোফোন আর ল্যাপটপে গেমস খেলার নেশায় মত্ত, খুশবু তখন মেতে উঠেছে অন্য খেলায়। সাদা-কালো বোর্ডের চৌষট্টি ঘরের রাজা-মন্ত্রী, হাতি-ঘোড়া, সৈন্য–সামন্ত নিয়েই বেশি ব্যস্ত খুশবু। বছর দু-এক আগে বাবার সঙ্গে দাবা খেলায় হাতেখড়ি খুশবুর। শখের বসে বাবার সঙ্গে বসে বসে দাবা খেলত বাড়িতে। কিন্তু খুশবুর মনের মধ্যে দাবা খেলার বীজটা প্রথমে বুনে দিয়েছিলেন স্কুলের একজন ক্রীড়াশিক্ষিকা। একদিন স্কুলে এসে সবাইকে তিনি ডেকে বলেছিলেন, ‘তোমাদের মধ্যে কে দাবা খেলা শিখতে চাও, হাত তোলো।’ অন্যরা যখন হাত না তুলে চুপচাপ বসে রইল, খুশবু কিছু না বুঝেই হাত তুলেছিল। এরপর ধীরে ধীরে স্কুল থেকেই দাবা খেলাটা শিখে ফেডারেশনে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে শুরু করে খুশবু।

এরই মধ্যে খুশবু বিভিন্ন ঘরোয়া ও আন্তর্জাতিক আসরে আলো ছড়াতে শুরু করেছে। গত বছর কলকাতায় টেলিগ্রাফ স্কুল দাবায় অনূর্ধ্ব-৬ বছর ক্যাটাগরিতে হয়েছিল চ্যাম্পিয়ন। উজবেকিস্তানে পশ্চিম এশিয়া যুব চ্যাম্পিয়নশিপের ব্লিৎজ দাবায় সোনার পদক জেতে। এরপর থাইল্যান্ডে এশিয়ান যুব চ্যাম্পিয়নশিপে ১টি সোনা ও ২টি রুপার পদক জিতেছে। জুনিয়র ও সাব–জুনিয়র দাবায় মেয়েদের অনূর্ধ্ব-৮ বছর বয়সের ক্যাটাগরিতে হয়েছে চ্যাম্পিয়ন।

পদক হাতে ওয়ারসিয়া খুশবু
পদক হাতে ওয়ারসিয়া খুশবু

এত কিছু ছাপিয়ে খুশবু সবচেয়ে বেশি নজর কেড়েছে গত ২৭ জুন উজবেকিস্তানের তাসখন্দে এশিয়ান স্কুল দাবা চ্যাম্পিয়নশিপে। সেখানে অনূর্ধ্ব-৭ বছর ক্যাটাগরিতে র‌্যাপিড ও স্ট্যান্ডার্ড বিভাগে জিতেছে সোনা। ব্লিৎজে রুপা। অথচ টাকার অভাবে এই টুর্নামেন্টে খেলতে যাওয়া নিয়েই সংশয়ে ছিল খুশবু। বাবা মেহেদি কায়সার একটি বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত। মা গৃহিণী। বাবার চাকরির আয়ে খুশবু ঘরোয়া টুর্নামেন্টে অংশ নিলেও দেশের বাইরে খেলতে যাওয়াটা বলতে গেলে অসম্ভবই হয়ে পড়ে। ওদিকে খুশবুর অংশ নেওয়ার তারিখও দ্রুত ঘনিয়ে আসছিল। চোখে তখন রীতিমতো সরষে ফুল দেখছিল বাবা–মেয়ে দুজনই। ‘কোনো আঙ্কেল কি আমাকে একটা বিমান টিকিট দিতে পারেন।’—উজবেকিস্তান যাওয়ার আগে খুশবুর এমন আর্তির কথা জেনেছিল দাবা অঙ্গনের সবাই। শেষ পর্যন্ত তাকে সহযোগিতা করতে এগিয়ে আসে সফটওয়্যার কোম্পানি বিট মাসকট প্রাইভেট লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির ফিন্যান্স ম্যানেজার অসীম কুমার ঘোষ খুশবুর বাবার হাতে উড়োজাহাজের টিকিট তুলে দেন। খুশবুর এমন সাফল্যে উচ্ছ্বসিত এই কর্মকর্তা বলছিলেন, ‘গ্র্যান্ডমাস্টার এনামুল হোসেন রাজীব আমাদের কাছে এই মেয়ে সম্পর্কে একটা ধারণা দিয়েছিল। ও ভালো খেলবে জানতাম। কিন্তু এত ভালো ফল করবে, বুঝিনি। ওর এশিয়ান দাবায় চ্যাম্পিয়ন হওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের সামান্য অবদান আছে ভেবেই আনন্দ হচ্ছে। ভবিষ্যতেও ওর পাশে থাকব আমরা।’

খুশবু রাজধানীর সাউথ পয়েন্ট স্কুলের ইংলিশ মিডিয়ামে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ছে। ওর এমন সাফল্যে গর্বিত এই স্কুলের শিক্ষকেরাও। বিমানবন্দরে খুশবুকে ফুলেল সংবর্ধনা জানাতে গিয়েছিলেন স্কুলের ক্রীড়াশিক্ষক মোহাম্মদ সিদ্দিকুর রহমান। শুরুতে স্কুলে ওর অর্ধেক বেতন দেওয়ার কথা থাকলেও এখন বিনা বেতনে পড়াশোনার সুযোগ করে দিয়েছে স্কুলটি।

মেয়ের দাবার সাফল্যে গর্বিত মা শাহিদা আক্তার বলেন, ‘আসলে আমার মেয়েকে এখন সবাই এত আদর করে, দেখে খুব ভালো লাগে। প্রতিবেশীরা তাদের ছেলেমেয়েদের ডেকে বলে, দেখো এইটুকু মেয়ে কীভাবে দাবা খেলে সোনা জিতছে।’

ক্যান্ডিডেট মাস্টার খেতাবধারী খুশবুর রেটিং ১৩৩০। সাফল্যের সিঁড়িতে সবে পা রাখতে শুরু করেছে খুশবু। এখনই তার চোখ দূরের বাতিঘরে, ‘বাংলাদেশে রানী হামিদ (দেশের প্রথম আন্তর্জাতিক মহিলা মাস্টার) আন্টির মতো আমি বড় দাবাড়ু হতে চাই। হতে চাই কার্লসেনের (বর্তমান বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ম্যাগনাস কার্লসেন) মতো দাবাড়ু।’

ছোট খুশবু বাংলাদেশের দাবায় এখনই রীতিমতো সৌরভ ছড়াতে শুরু করেছে। যে সৌরভ দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে পৌঁছে গেছে এশিয়ার অন্য দেশগুলোতেও।