কার্ডিফ থেকে লর্ডস

কার্ডিফের সেই ভৌতিক বাড়ি,টন্টন সিটি সেন্টারে এক টুকরো লাল–সবুজ
কার্ডিফের সেই ভৌতিক বাড়ি,টন্টন সিটি সেন্টারে এক টুকরো লাল–সবুজ

ঢাকা থেকে বুকিং দেওয়ার সময়ই মনে হয়েছিল হোটেলটার অবস্থান নির্জন কোনো এলাকায়। স্টেডিয়ামের খুব কাছে বলেই এ হোটেল বেছে নেওয়া। কিন্তু জায়গাটা যে কতটা নির্জন, গত ২৩ মে কার্ডিফে পৌঁছে বোঝা গেল।

যুক্তরাজ্যে প্রথমবার আসা, ক্রীড়া সাংবাদিক হিসেবে আইসিসির কোনো টুর্নামেন্টে প্রথমবারের মতো কাভার করা—মনের ভেতর অন্য রকম রোমাঞ্চ। কিন্তু সে রোমাঞ্চ হঠাৎ উবে গেল কার্ডিফের নির্জন এলাকার ভৌতিক হোটেলটায় উঠে। মনকে প্রবোধ দিতে হলো, মাত্র কটা তো দিন, দেখতে দেখতে কেটে যাবে। এরপর আরেক শহর, আরেক হোটেল...। কিন্তু এই কটা দিন যে কীভাবে কাটবে, বড় চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়াল।

ভারত ও পাকিস্তানের বিপক্ষে বাংলাদেশের দুটি প্রস্তুতি ম্যাচ কাভার করতে সফরের শুরুতেই কার্ডিফে থাকতে হয়েছিল এক সপ্তাহ। এই এক সপ্তাহ ঠিকানা হলো শহরের ক্যাথেড্রাল রোডের নির্জন, ভৌতিক হোটেলটায়। সন্ধ্যার পর আশপাশে কোনো মানুষের শব্দ পাওয়া যায় না। মধ্যরাতে শুধু পাওয়া যায় কাঠের মেঝেতে মচমচ করে হাঁটার শব্দ! কখনো কখনো কোনো ওয়াশ রুম থেকে ভেসে আসা পানি পড়ার শব্দ। আর সকালে দূরের কোনো গির্জা থেকে ভেসে আসে ঘণ্টার শব্দ। একদিন হোটেলের ম্যানেজারকে বিষয়টা জানাতে হো হো করে হাসলেন। জানতে চাইলেন, যে শহর থেকে এসেছি অর্থাৎ ঢাকায় জনসংখ্যা কত? প্রায় ২ কোটি তো হবেই! শুনে হাঁ করে তাকিয়ে রইলেন। বললেন, ‘কার্ডিফে ১০ লাখ মানুষ বাস করে কিনা সন্দেহ! স্বাভাবিকভাবেই আপনার কাছে ভীষণ নির্জন মনে হবে এ শহর। তবে নির্জন মানেই ভৌতিক নয়। ভৌতিক কিছু ঘটেও, আমরা তো আছিই।’

ব্রিস্টলে রাজা রামমোহন রায়ের সমাধি
ব্রিস্টলে রাজা রামমোহন রায়ের সমাধি

পুরো যুক্তরাজ্য সফরে ব্রিটিশদের কাছে এমনই আতিথেয়তা পাওয়া গেল। শত ব্যস্ততার মধ্যে আন্তরিকতা দেখিয়েছেন বাংলাদেশ দলের সদস্যরাও। সেই আন্তরিকতা থেকে কার্ডিফের সোফিয়া গার্ডেন মাঠে একদিন অনুশীলনের ফাঁকে মাশরাফি বিন মুর্তজা স্বভাবসুলভ রসিকতায় খোঁজ নিলেন এভাবে, ‘হোয়াটস আপ রানা আব্বাস’! সেটির ভিডিও ফেসবুকে মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ল।কার্ডিফ হয়ে লন্ডন। লন্ডন থেকে আবার কার্ডিফ। সেখান থেকে ব্রিস্টল। ব্রিস্টল-পর্ব শেষে টন্টন, নটিংহাম, সাউদাম্পটন, বার্মিংহাম হয়ে আবার লন্ডন। আতিথেয়তার সঙ্গে ব্রিটিশরা নানাভাবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে তাদের কঠিন কঠিন সব নিয়ম আর আদবকেতার সঙ্গেও।

অনেকেই জানতে চেয়েছেন, যুক্তরাজ্যে যে কটা শহরে থাকা হলো, সবচেয়ে সুন্দর কোন শহর? কঠিন প্রশ্ন। একেক শহরের রূপ, সৌন্দর্য একেক রকম। লন্ডন যদি ইতিহাস, ঐতিহ্য, আভিজাত্য, আধুনিকতার সর্বোচ্চ নিদর্শন হয় কার্ডিফ হচ্ছে শান্তির শহর। নাগরিক কোলাহল ছেড়ে ছিমছাম, পরিপাটি, সাজানো-গোছানো ছোট এ শহরে এলেই মনটা জুড়িয়ে যাবে। শহরের বেশ কটি জায়গায় কিছু মূর্তি চোখে পড়েছে। এর মধ্যে একটি ভাস্কর্য মহাত্মা গান্ধীর, আরেকটি শ্রীচিন্ময়, চিন্ময় কুমার ঘোষের। দুজনই শান্তির বার্তাবাহক। শান্তির শহর তাই বিশেষ শ্রদ্ধা জানিয়েছে দুই শান্তির বার্তাবাহককে।

ব্রিস্টল টানবে পাহাড়-নদীর মিতালি, রোমাঞ্চকর সাসপেনশন ব্রিজ, ভারতীয় সমাজসংস্কারক রাজা রামমোহন রায়ের সমাধি আর সাবেক ইংরেজ অধিনায়ক ডব্লিউ জি গ্রেসের স্মৃতিধন্য ডাউনএন্ড। ইংল্যান্ডের গ্রাম কত সুন্দর, সেটি দেখার আদর্শ জায়গা টন্টন। রবিনহুডের শহর নটিংহাম, টাইটানিক যে শহর থেকে ছেড়ে গিয়েছিল, সাউদাম্পটনও কি কম সুন্দর! অন্য শহরগুলোর তুলনায় বার্মিংহামকে কিছুটা মলিন, অনুজ্জ্বল আর নোংরা মনে হয়েছে। উপমহাদেশীয় মানুষের আধিক্য বলেই কিনা এ শহরটা ঠিক প্রথাগত ব্রিটিশদের মনে হয়নি। তবে ২০২২ কমনওয়েলথ গেমস সামনে রেখে শহরটা নতুন করে সাজাচ্ছে ব্রিটিশ সরকার। পুরো শহরে এখন চলছে নির্মাণকাজ।

কোন শহর কেমন সেটির চেয়ে একজন ক্রীড়া সাংবাদিক হিসেবে বেশি টেনেছে ব্রিটিশদের ক্রিকেট-সংস্কৃতি। মাঠ যত বড় কিংবা যত ছোট হোক, প্রতিটির ইতিহাস-ঐতিহ্য সুপ্রাচীন এবং ভীষণ মুগ্ধতা জাগানিয়া। টন্টন হচ্ছে সমারসেটের হোম গ্রাউন্ড। মাত্র আট হাজার লোক ধারণক্ষমতাসম্পন্ন এই স্টেডিয়ামে পা পড়েছে কত কিংবদন্তির। সমারসেটের হয়ে খেলেছেন জোয়েল গার্নার, স্যার ভিভ রিচার্ডস, স্যার ইয়ান বোথামের মতো কিংবদন্তিরা। টন্টনে যেদিন বাংলাদেশ খেলল ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে, এ ম্যাচ ঘিরে কিংবদন্তিদের একটা মেলাই বসেছিল। এসেছিলেন ক্লাইভ লয়েড, অ্যান্ডি রবার্টস, গার্নার, স্যার কার্টলি অ্যামব্রোসদের মতো ক্যারিবীয় কিংবদন্তিরা।

টন্টনের ছোট মাঠে ক্যারিবীয়দের হারিয়ে বড় কীর্তি গড়েছে বাংলাদেশ। ওয়েস্ট ইন্ডিজের করা ৩২১ রান অনায়াসে তাড়া করে রেকর্ড গড়লেন সাকিবরা। বিশ্বকাপে এটিই বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রান তাড়া করে জেতা রেকর্ড। দৃশ্যটা খুব মনে পড়ে, ম্যাচ শেষে গার্নার পা টেনে টেনে হেঁটে চলছেন স্টেডিয়ামের প্রধান ফটকের দিকে। তাঁর হতাশ চেহারাটা দেখে মায়াই হচ্ছিল। ক্যারিবীয়দের সোনালি যুগের এক সেনানী দেখছেন কীভাবে ওয়েস্ট ইন্ডিজ পড়ে পড়ে মার খাচ্ছে! ‘এখন আর এসব দেখে বিচলিত হই না’—গার্নারের স্বগতোক্তি এখনো কানে বাজে।

সমারসেটের জাদুঘরের কথা বলা হচ্ছিল, ট্রেন্ট ব্রিজের গ্রন্থাগার দেখে তো চক্ষু ছানাবড়া! গ্রন্থাগারিকের নাম পিটার ওয়েইন থমাস, তাঁর নামেই এই গ্রন্থাগার। ইংল্যান্ডের স্বনামধন্য এই ক্রিকেট ইতিহাসবিদ ট্রেন্ট ব্রিজ গ্রন্থাগারে কাজ করছেন ১৯৭৮ সাল থেকে। নটিংহামশায়ার কাউন্টি ক্রিকেটের মাঠ ট্রেন্ট ব্রিজ বিখ্যাত সমৃদ্ধ এ গ্রন্থাগারের জন্য।

বাংলাদেশ থেকে এসেছি শুনে ওয়েইনস একটি বই বের করে দিলেন। বইয়ের শিরোনাম গোল্ডেন মিনোজ ইন দ্য ওয়ার্ল্ড কাপ ২০১৯: আফগানিস্তান অ্যান্ড বাংলাদেশ হিট দ্য বিগ টাইম। বইটার প্রথম অর্ধেক বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাস নিয়ে, বাকিটা আফগানদের উত্থানের গল্প। মাত্র ৫০০ কপি ছাপা হওয়া দুর্লভ বইটার লেখক রবিন মারলার। প্রখ্যাত এই ব্রিটিশ ক্রিকেট লেখককে খুঁজছি গত দেড়টা বছর ধরে। মারলারের সঙ্গে যোগাযোগও হলো। তাঁর সঙ্গে কথা বলে ছুটির দিনেতে লেখা হলো ‘বাংলাদেশের ক্রিকেটবন্ধু’ শিরোনামের প্রচ্ছদ প্রতিবেদন।

ব্রিস্টল-টন্টন-ট্রেন্ট ব্রিজ, সাউদাম্পটন, এজবাস্টন কিংবা লন্ডনের আরেক মাঠ ওভাল, সব মাঠকে ছাড়িয়ে উন্নত শিরে দাঁড়িয়ে লর্ডস। লর্ডস কেন ক্রিকেটের তীর্থ—প্রশ্নটার উত্তর পাওয়া গেল। এই যে ইংল্যান্ডের প্রতিটি মাঠের সুপ্রাচীন ইতিহাস, মুগ্ধ করা সৌন্দর্য, সুযোগ-সুবিধা কিংবা ইংলিশ ক্রিকেট যে শক্তিশালী ক্রিকেট অবকাঠামোর ওপর দাঁড়িয়ে, বারবার একটা প্রশ্নই জেগেছে, তবু কেন ইংল্যান্ড বিশ্বকাপ শিরোপা জিততে পারে না?

১৪ জুলাই এ প্রশ্নের উত্তর মিলেছে। ইংল্যান্ডের হাতে শিরোপা তুলে দিয়ে ক্রিকেট বিধাতা যেন একটা দায়ই মিটিয়েছেন। ইংল্যান্ডের এ বিজয় দেখে এ বঙ্গীয় বদ্বীপে একটা দীর্ঘশ্বাস উঠেছে, ‘আহ্‌, বাংলাদেশ কবে এমন...।’ এই টুর্নামেন্টে কী দুর্দান্ত সূচনা করলেন, টুর্নামেন্টের মাঝপথেও সেমিফাইনালে ওঠার আশা জাগিয়ে রাখলেন মাশরাফি-সাকিবরা। শেষ দুটি ম্যাচে হেরে স্বপ্নের জলাঞ্জলি। সবচেয়ে বেশি খারাপ লেগেছে বাংলাদেশের দর্শকদের জন্য। এজবাস্টনে ভারতের বিপক্ষে ম্যাচটা বাদে সব ভেন্যুতেই ছিল লাল-সবুজ সমর্থকদের দাপট। ইংল্যান্ডের মাঠে তাঁরা ভূমিকা রেখেছেন ‘দ্বাদশ’ খেলোয়াড় হিসেবে। যে আশায় তাঁরা সমর্থন দিয়ে গেলেন, সেটি আর পূরণ হলো না।

বাংলাদেশও একদিন আশা পূরণ করবে, ইংল্যান্ডের মতো জয়ের ধারাবাহিকতা ধরে রাখবে, সাফল্যের জোয়ারে ভাসবে, যদি এ দেশের ক্রিকেট সংস্কৃতি, সুযোগ-সুবিধা কিংবা অবকাঠামো ইংলিশদের মতো ভীষণ শক্তিশালী হয়। পুরো যুক্তরাজ্য সফরে ইংলিশদের উদ্যোগ কিংবা সাফল্য দেখে বারবার মনে হয়েছে, ‘শর্টকাট পদ্ধতিতে’ হয়তো সাময়িক ভালো করা যায়, কখনো স্থায়ী উন্নতি করা যায় না। বিশ্বকাপ দেখতে দলে দলে যুক্তরাজ্যে যাওয়া বাংলাদেশ ক্রিকেটের নীতিনির্ধারকেরাও কি এটা উপলব্ধি করেছেন?