ব্রুকলিন ব্রিজ বিক্রি করা এক প্রতারক

আমরা যেদিন নিউইয়র্কের ব্রুকলিন ব্রিজের ওপর দিয়ে হেঁটে গেলাম, সেদিন আকাশে মেঘ ছিল না। বিকেলে ব্রিজের ওপর বসেছিল মানুষের হাট। মূলত তা ছিল পর্যটকদের দখলে। অবাক কাণ্ড, নিউইয়র্কে অনেক বাঙালির বসবাস হলেও এই নয়নাভিরাম ব্রিজটির ওপর কোনা বাঙালিকে দেখিনি সেদিন। হতে পারে, স্থায়ী বসবাসকারীরা কাজের চাপে এ রকম সময়ে ব্রিজে আসতে পারেন না কিংবা এমনও হতে পারে, পর্যটকের চোখের খিদে আর শহরের বাসিন্দার চোখের খিদে এক নয়। তাই ইস্ট রিভারের ওপর নিউইয়র্কের ম্যানহাটন আর ব্রুকলিনকে মিলিয়ে দেওয়া সেতুটি পর্যটকদের যতটা হাতছানি দিয়ে ডাকে, বাসিন্দাদের ততটা নয়।

ব্রুকলিন ব্রিজ নিয়ে নানা দেশের নানা সাহিত্যিক ও কবির আছে নানা ধরনের রচনা। সেগুলো তো সাহিত্যপাঠের জন্য জরুরি। আমি আরেক ধরনের এক রচয়িতার সন্ধান পেয়েছিলাম, যাঁর ‘অমর কীর্তি’র কথাই এখানে বলব আজ।

যুক্তরাষ্ট্রকে বলা হয় ‘সব পেয়েছির দেশ’। এ দেশে এসো এবং নিজেকে মেলে ধরো, সব পাবে—প্রচারণা এ রকমই। এরই মধ্যে যদি হঠাৎ কেউ শুনে ফেলে, ‘এর কাছে তো ব্রুকলিন ব্রিজটাও বিক্রি করে দেওয়া যায়’, তাহলে ঘাবড়ানোর কিছু নেই। সরল বিশ্বাস আর টাকাপয়সার ব্যাপারে আলাভোলা মানুষের ব্যাপারে কথাটা খুবই সত্য। এ পর্যন্ত সরল বিশ্বাসে অনেকেই ব্রুকলিন ব্রিজ কিনেছেন। এই ক্রেতাদের বেশির ভাগই পর্যটক। টাইম মেশিনে করে যদি ১০০ বছর আগে চলে যাওয়া যেত, তাহলে হয়তো জর্জ পার্কারের দেখা পেতে পারতাম আমরাও এবং তিনি আমাদের কাছে এসে জিজ্ঞেস করতে পারতেন, ‘শুভ অপরাহ্ণ, কেমন আছেন?’

‘ভালো।’

‘আপনার জন্য একটা ভালো অফার আছে, ভেবে দেখতে পারেন।’

একটু কৌতূহলী তো হতেই হতো। ‘কী?’

‘এই ব্রিজটার মালিক আমি। আমি এটা বিক্রি করে দিতে চাইছি।’

যাঁরা জর্জ পার্কারকে চিনতেন, তাঁরা জানেন, কী অবলীলায় তিনি সত্যকে মিথ্যা আর মিথ্যাকে সত্য বানিয়ে তুলতে পারতেন। তিনি সহজে বুঝিয়ে দিতে পারতেন, এই ব্রিজ কিনে কত অল্প সময়ের মধ্যেই একজন মানুষ টাকার পাহাড়ে চড়ে বসতে পারে। ওই যে, ‘সব পেয়েছি’র দেশ তো!

পার্কারের দেখানো লোভের ফাঁদে পা দিতেন কোনো কোনো বোকা মানুষ। কিনে ফেলতেন ব্রিজটি। পার্কারের তৈরি ‘সরকারি দলিলপত্র’ পেয়ে যেতেন সেতুর নব্য মালিক। তারপর?

তারপর কী হতো, সে কথা একটু পরে। আগে শুরু থেকে শুরু করি।

জর্জ পার্কার একটানা কয়েক বছর ধরে বিক্রি করেছিলেন ব্রুকলিন ব্রিজ। প্রায় প্রতি সপ্তাহেই অন্তত দুজন করে আলাভোলা ক্রেতা পেয়ে যেতেন তিনি।

অনেকেই জানেন, বহু কাঠখড় পুড়িয়ে ব্রুকলিন ব্রিজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়েছিল ১৮৮৩ সালের ২৪ মে। প্রায় দেড় লাখ মানুষ সেদিন এই ব্রিজের ওপর দিয়ে হেঁটেছিল। কিন্তু উদ্বোধনের কয়েক দিনের মধ্যেই গুজব রটে গেল, ব্রিজটা খুব বেশি মজবুত নয়। যেকোনো সময় ভেঙে পড়তে পারে। ব্রিজ সম্পর্কে নাগরিকদের অযথা মনের ভয় তাড়ানোর জন্য নিউইয়র্ক কর্তৃপক্ষ নিল এক সাহসী পদক্ষেপ। তারা সার্কাসের ২১টি হাতি নিয়ে এল এবং সেতুর ওপর দিয়ে একসঙ্গে হাঁটতে বাধ্য করল। না, ব্রিজ তাতে ভেঙে পড়েনি।

ঠিক এ সময়েই জর্জ পার্কারের আবির্ভাব।

পার্কারের সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানা যায় না। তিনি নিউইয়র্কের বাসিন্দাই ছিলেন। একদিন বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার সময় বড়াই করে বলেছিলেন তিনি, ‘আমি যেকোনো কিছু বিক্রি করে দিতে পারি।’

এক বন্ধু রসিকতা করে বলল, ‘যেকোনো জিনিস? ব্রুকলিন ব্রিজটা বিক্রি করতে পারবে?’

‘পারব!’

এই ছিল পার্কারের ব্রুকলিন ব্রিজ বিক্রির নেপথ্যে।

ব্রুকলিন ব্রিজ প্রথমবারের মতো বিক্রি করতে খুব বেশি দিন অপেক্ষা করতে হয়নি পার্কারকে।

জর্জ পার্কার
জর্জ পার্কার

ব্রিজের ওপরেই পথচারীদের থামিয়ে পার্কার বলতেন, তিনিই এই ব্রিজের মালিক, কিন্তু এখন ঠিক করেছেন, বিক্রি করে দেবেন ব্রিজটা। এরপর ব্যাখ্যা করে বোঝাতেন, যিনি কিনবেন, তিনি কীভাবে এই ব্রিজ থেকে লাভবান হবেন। যেকোনো সময় ব্রিজের ওপরে লাঠি দিয়ে আটকে দেওয়া যাবে পথচারী বা যান চলাচল। তারপর পথচারী আর গাড়ির চালকের কাছ থেকে ব্রিজ ব্যবহারের জন্য টাকা তোলা যেতে পারে। এখন অনেক গবেষকই ধারণা করেন, জর্জ পার্কার আদতেই ছিলেন পেশাদার এক বিক্রেতা–ক্যানভাসার। তাঁর কথার জাদুতে বিভ্রান্ত হতো মানুষ। তাঁর কথায় চিড়ে ভিজত। এবং সত্যিই বিক্রি হয়ে যেত সেতুটি। নকল দলিলপত্র পেয়ে ব্রিজের নতুন মালিক হতেন খুব খুশি। কিন্তু সে খুশি খুব বেশি দিন স্থায়ী হতো না। অচিরেই তিনি বুঝে ফেলতেন, নিউইয়র্কে সরকারি সম্পত্তি বিক্রি করা বা কেনা যায় না। যখনই সেতুর ওপর টোল আদায়ের ব্যবস্থা করতে যেতেন সেতুর নতুন মালিক, তখনই চলে আসত পুলিশ, এসে বলত, ‘তুমি ফেঁসে গেছ হে!’

কীভাবে ক্রেতা সংগ্রহ করতেন পার্কার? কখনো নিজের পরিচয় দিতেন এই স্থাপনার যিনি স্থপতি, তাঁর আত্মীয় বলে। কখনো ব্যবহার করতেন জেনারেল গ্র্যান্টকে। বলতেন, তিনি জেনারেল ইউলিসিস গ্র্যান্টের নাতি। এই গ্র্যান্টই পরে হয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ১৮তম প্রেসিডেন্ট।

সপ্তাহে দুবার করে এই ব্রিজ বিক্রি করা শুরু করে দিয়েছিলেন পার্কার। তাঁর সাহস এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে তিনি স্থাবর সম্পত্তি বিক্রির জন্য একটি অফিসও খুলে বসেছিলেন। সেই অফিস থেকে কুমিরের ছানার মতো শুধু ব্রুকলিন ব্রিজই বের হতো না, নিউইয়র্কের সেরা সেরা স্থাবর সম্পত্তিও বের হতো। জর্জ পার্কারের কল্যাণে বিক্রি হতে শুরু করল ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেন, মেট্রোপলিটন মিউজিয়াম অব আর্ট, গ্র্যান্টস টম্ব, এমনকি স্ট্যাচু অব লিবার্টি!

জর্জ পার্কার গ্রেপ্তার হন ১৯২৮ সালে। সে বছরের ১৭ ডিসেম্বর তাঁর প্রতারণার ব্যাপারে আদালতের রায় আসে—যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। নিউইয়র্ক থেকে ৪৮ কিলোমিটার দূরে ওসিনিং শহরের সিং সিং কারাগারে তাঁকে রাখা হয়। এই কারাগারের সেলেই এই প্রতারকের জীবনের ৮টি বছর কেটেছে। ১৯৩৬ সালে এখানেই তাঁর মৃত্যু হয়।

ইস্ট রিভারের ওপর এই ব্রুকলিন ব্রিজ কি তার ছদ্ম বিক্রেতার নাম মনে রেখেছে? ব্রুকলিন ব্রিজের ওপরে আমরা সে প্রশ্ন ছড়িয়ে দিলাম। আকাশে তখনো গাঙচিলগুলো উড়ে বেড়াচ্ছে আর মাঝেমধ্যে কর্কশ স্বরে ডেকে চলেছে।

সূত্র: আইফ্যাক্ট ডটআরইউ