লেনিনের গাড়ি হাইজ্যাক!

ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের ব্যবহৃত একটি গাড়ি
ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের ব্যবহৃত একটি গাড়ি

এত দিন পর রুশ বিপ্লবের নেতা ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনকে নিয়ে লেখা কেন? তাঁকে শান্তিতে ক্রেমলিনের সমাধিতে থাকতে দিলেই তো হয়। এখন যখন রুশ বিপ্লবের কথা মনে করে তেমন কেউ আর উজ্জীবিত হয় না, তখন লেনিনের সম্পর্কে কারই–বা আকর্ষণ থাকবে?

এ রকমই ভাবা হয়ে থাকে হয়তো, কিন্তু লেনিন সম্পর্কে আগ্রহের শেষ নেই এখনো। অনেকেই লেনিনকে খুঁজে চলেছেন তাঁর বইয়ের মাধ্যমে কিংবা অন্তর্জালে ঢুকে।

অনেকেই হয়তো জানেন, ১৯১৭ সালের অক্টোবর বিপ্লবের নায়ক ১৯১৯ সালের জানুয়ারিতে খোদ মস্কো শহরে পড়েছিলেন ডাকাতদের পাল্লায়! লুবিয়ানকার মহাফেজখানায় সেই ডাকাতির ঘটনা নিয়ে ২৩ খণ্ডের এক মামলার বিবরণ রয়েছে। সোভিয়েত যুগে এই ঘটনা ছিল গোপনীয়। কাউকে জানতে দেওয়া হয়নি। তবে লেনিনই তো তা জানিয়ে গিয়েছিলেন একটু রহস্য তৈরি করে। লেনিনের কমিউনিজমে বামপন্থী বাল্যরোগ নামের বইয়ে বিষয়টির উল্লেখ পাওয়া যাবে।

সে যা হোক, ঘটনাটি কী ছিল, সে কথা বলে ফেলা যাক।

১৯১৯ সালে সোভিয়েতজুড়ে চলছিল সমাজতন্ত্র গড়ে তোলার বিশাল আয়োজন। গ্রাম থেকে কমিউনিস্টরা আসছেন, ক্রেমলিনে গিয়ে দেখা করছেন লেনিন বিপ্লবের মূলনায়কদের সঙ্গে। তাঁরা বিভিন্নভাবে সমস্যার সমাধান জেনে নিয়ে আবার চলে যাচ্ছেন নিজ গন্তব্যে। অর্থাৎ এক বিশাল কর্মযজ্ঞ চলছে এই দেশে।

সে রকমই একটি সময়, ১৯১৯ সালের ১৯ জানুয়ারি লেনিন চলেছিলেন তাঁর গাড়িতে, মস্কোর পথে। গাড়িতে ছিল তাঁর বোন, দেহরক্ষী এবং গাড়ির চালক।

ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন
ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন

বিংশ শতাব্দীর শুরুতে ডাকাত হিসেবে ইয়াকভ কুজনেৎসোভের ছিল নামডাক। ষন্ডা ডাকাতেরা তাঁকে ডাকত ইয়ানকা কাশেলোক নামে। ইয়াকভের বাবা ছিলেন সাইবেরিয়ায় নির্বাসনে। ইয়াকভকে ডাকাত হিসেবে ভয় পেত সবাই। ইয়ানকা কাশেলোকের ডাকাত–জীবনের বড় একটা ঘটনা হলো লেনিনের গাড়িটি মস্কো থেকে হাইজ্যাক করা। সে সময় গাড়িতে ছিলেন লেনিন। ১৯ জানুয়ারির ওই দিনে মস্কোর প্রান্তে একটা বড় বাগানবাড়িতে ডাকাতি করতে চাইছিল ইয়ানকার দল। এ জন্য তাদের দরকার ছিল একটি গাড়ির। সে সময় মস্কোতে গাড়ির সংখ্যা ছিল একেবারেই কম। তাই রাস্তায় কোনো গাড়ি দাঁড় করিয়ে সেটা থেকে আরোহীদের নামিয়ে দিয়ে নোভিন্‌স্কি বুলেভার্ডে নিয়ে যাবে ডাকাতি করতে—এই ছিল ভাবনা। কার গাড়ি থামানো হচ্ছে, সেদিকে চোখ ছিল না ডাকাতদের। গাড়িতে তখন লেনিন, তাঁর বোন মারিয়া, চালক স্তেপান গিল, দেহরক্ষী ইভান চাবানোভ। পথেই হাত দেখিয়ে গাড়ি থামাতে বলল ডাকাতেরা। লেনিন ভাবলেন, এটা লাল ফৌজের কাজ। তাদের কাজের তারিফ করার জন্য লেনিন গাড়ি থামাতে বললেন। কিন্তু গাড়ি থামানোর পর যখন ডাকাতেরা সবাইকে গাড়ি থেকে নেমে আসতে বলল, তখন লেনিনও খুব অবাক হলেন। তিনি বেশ গাম্ভীর্যের সঙ্গে বললেন, ‘আমি লেনিন।’

উত্তরে শুনলেন, ‘তুমি লেনিন, তাতে কী? আমি কাশেলোক, আমি এ শহরে রাতের সম্রাট।’

লেনিনদের নামিয়ে দিয়ে ডাকাতের দল গাড়ি নিয়ে চলে গেল। শুধু কি তাই, তারা লেনিনের পিস্তল, তার কাগজপত্রও নিয়ে গেল সঙ্গে।

এবার তো খোঁজ পড়ল গাড়ির। সারা মস্কোর জরুরি বিভাগ সক্রিয় হয়ে উঠল। ডাকাতদের ধরার জন্য উঠে পড়ে লাগল গোয়েন্দারা। কয়েক ঘণ্টা পর তারা ফেলে যাওয়া গাড়ির সন্ধান পেল। ডাকাত দলের সন্ধানে চলতে থাকল তদন্ত।

অবশেষে ফেব্রুয়ারি মাসে ইয়ানকা কাশেলোকের দলের পাঁচ ষন্ডাকে গ্রেপ্তার করল মিলিশিয়া। এদের মধ্যে ভোলকভ ও আলেকসেয়েভ নামে দুজন ছিল লেনিনের ওপর হামলাকারী। পাঁচজনকেই গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। তখনো কাশেলোককে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। তাঁর মৃত্যু হয়েছিল ১৯১৯ সালের ২৬ জুন। পুলিশের সঙ্গে ‘এনকাউন্টারে’।

কাশেলোকের দল ঘাপটি মেরে বসে ছিল এক জায়গায়। তাদের সত্যিই চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলেছিল মিলিশিয়া। দুপক্ষের মধ্যে হয়েছিল গুলিবিনিময়। মিলিশিয়ার গুলিতে রক্তাক্ত কাশেলোককে ধরে ফেলা হয়। বেশিক্ষণ তিনি বাঁচেননি। তাঁর কাছ থেকে ‘ব্রাউনিং’ পিস্তলটা উদ্ধার করা হয়, যেটির মালিক ছিলেন লেনিন। দলের অন্য সদস্যদের বিচার করে গুলি করে হত্যা করা হয়। বামপন্থার বাল্যব্যাধিতে ‘বিপ্লবের গুরুকেও কখনো কখনো আপস করতে হয়’ বলে গাড়ি হাইজ্যাকের ঘটনাটির উল্লেখ করেছিলেন লেনিন।

সূত্র: আইফ্যাক্ট ডটআরইউ