পাপ্পু আর্টের ক্যানভাস বদল

ছোট ক্যানভাসে পাপ্পুর তুলির আঁচড়
ছোট ক্যানভাসে পাপ্পুর তুলির আঁচড়
>মো. হানিফ পাপ্পুর ইস্পাত–কালো চুল দেখে মনে হয় তাঁর বয়স ৫০ বছর। খোঁচা খোঁচা শুভ্র গোঁফ–দাড়ি দেখে মনে হয় ৭০। এই ধারণা আরও জোরালো হয় তাঁর মুখের দৃশ্যমান অংশের নিঃসঙ্গ দুটি দাঁত দেখে। আদতে মো. হানিফ পাপ্পুর বয়স ৫৭। সিনেমার ব্যানার আঁকাআঁকিতে তাঁর হাতেখড়ি ৬–৭ বছর বয়সে। মানে পেশাজীবনের বয়স ৫০ বছর। সব মিলিয়ে এঁকেছেন প্রায় চার শ ব্যানার। চল নেই বলে ব্যানার আঁকেন না ১৭ বছর হলো। নানা পেশায় আশ্রয় খুঁজে অবশেষে বেছে নিয়েছেন রিকশাচিত্র। আঁকছেন বিচিত্র সব উপকরণে। তাঁর শিল্পীজীবনে বারবার ক্যানভাস বদলের গল্প শুনে এসেছেন মাহফুজ রহমান

আশির দশকের কোনো এক অলস দুপুর। পুরান ঢাকার বকশীবাজার লেন যেন ভাতঘুম দিচ্ছে। কেবল ভালো ছাত্রের মতো নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত রূপায়ণ আর্ট পাবলিসিটির কর্মীরা। সবার হাতেই তুলি, সিনেমার ব্যানার আঁকার কাজ চলছে দ্রুতলয়ে। তন্ময় আঁকিয়েরা হঠাৎ সবিস্ময়ে আবিষ্কার করলেন, তাঁদের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন নায়ক জসীম। কেউ কেউ ভাবলেন, সিনেমার ব্যানার এত বাস্তব হলো কী করে! ব্যানার থেকে নায়ক জসীম তাঁদের সামনে চলে এলেন কোন জাদুবলে? ২৮ আগস্টের দুপুরে এই গল্প শুনছিলাম মো. হানিফ পাপ্পুর কাছে।

তারপর কী হলো? সে সময়ের হিট নায়ক জসীম রূপায়ণ আর্ট পাবলিসিটির কর্মীদের আলিঙ্গন করলেন। পাপ্পু প্রশান্তির হাসি হেসে বলছিলেন, ‘জসীম সাহেব আমগো কিছু ট্যাকাটুকা ধরায়া দিয়া কইলেন, “তোমগো ব্যানার খুব ভালা হইছে। ট্যাকাটা রাখো, মিষ্টি খাইয়ো। সামনে আরও ব্যানার আঁকতে হইব।”’

পুরান ঢাকার বকশীবাজার লেনে নিজের দোকানে কাজ করছেন মো. হানিফ পাপ্পু। ছবি: সাইফুল ইসলাম
পুরান ঢাকার বকশীবাজার লেনে নিজের দোকানে কাজ করছেন মো. হানিফ পাপ্পু। ছবি: সাইফুল ইসলাম

পাপ্পুর মনের ক্যানভাসে ফ্লুরোসেন্ট রঙের মতো এমন আরও জ্বলজ্বলে স্মৃতি আছে। নায়ক রাজ্জাক, আলমগীররাও নাকি তাঁদের ধন্যবাদ জানিয়ে গেছেন। জানানোর যথেষ্ট কারণও ছিল। মানুষ সে সময় ব্যানার দেখে সিনেমা হলে যেত। ব্যানার যথেষ্ট আকর্ষণীয় না হলে কথা শুনতে হতো আঁকিয়েদের। কিংবা ব্যানারের ছবির সঙ্গে সিনেমার দৃশ্যের মিল না থাকলে দর্শক খিস্তিখেউর করতেও ছাড়তেন না। পাপ্পু ও তাঁর সঙ্গীসাথিদের এমন অভিজ্ঞতা হয়েছিল একাধিকবার। দর্শক এবং প্রযোজকের প্রচণ্ড চাপের মধ্যেই একেক দিনে কখনো ১০টি করে ব্যানারও আঁকতে হতো তাঁদের!

কালো চুলে বর্ণিল যাত্রা

ক্যানভাসে পানপাতা আঁকার বদলে পানের ব্যবসায়ীও হতে পারতেন পাপ্পু। বাবা আবদুল গাফফার ভারতের মুম্বাই থেকে ব্যবসা করতে এসেছিলেন ঢাকায়। পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠাতেন পান, আর সেখান থেকে কাপড় এনে বেচতেন পূর্ব পাকিস্তানে। জমজমাট ব্যবসায় আট ছেলেকেই যুক্ত করতে চেয়েছিলেন। পাপ্পুকে নিয়েও আশা ছিল তাঁর। কিন্তু পাপ্পুর স্বপ্নের ক্যানভাস ছিল আরও বর্ণিল। রঙের মায়া তাঁকে পেয়ে বসেছিল শৈশবে। নানাবাড়ি ঢাকার নবাবপুরে। নানা আবদুল জব্বার নামকরা ব্যবসায়ী। ধর্মকর্ম করেন, আঁকাআঁকিতে কড়া নিষেধাজ্ঞা। অথচ তাঁর ছেলে, মানে পাপ্পুর মামা রফিক লুকিয়ে লুকিয়ে সিনেমার ব্যানার আঁকেন। পাপ্পুর মা গোপনে তাঁর ভাইয়ের জন্য খাবার পাঠান। টিফিন ক্যারিয়ারের বাহক পাপ্পু স্কুল থেকে ফিরেই রথখোলায় ছুটে যান মামার কাছে। মামা আঁকেন, ভাগ্নে মুগ্ধ দর্শক। এসব ১৯৬৭–৬৮ সালের কথা। এই করে করেই পাপ্পু একদিন মামার আঁকা নায়কের মাথায় কালো চুল এঁকে ফেললেন। কালো চুল এঁকে শুরু হলো বর্ণিল ভুবনে পাপ্পুর যাত্রা।

পাপ্পুদের অঁাকা সিনেমার ব্যানার
পাপ্পুদের অঁাকা সিনেমার ব্যানার

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মালিকের সঙ্গে ব্যানার আঁকিয়ে প্রতিষ্ঠান সিতারা আর্ট পাবলিসিটির নামও গেল বদলে। হয়ে গেল রূপায়ণ আর্ট পাবলিসিটি, মালিক গিরিন দাস। তাঁকেই ওস্তাদ মানলেন পাপ্পু। তত দিনে হলিউডি সিনেমা চেঙ্গিস খান–এর ব্যানার দিয়ে পুরোদস্তুর শিল্পীজীবন শুরু করে ফেলেছেন। প্রথমবারের মতো বাংলাদেশি সিনেমার ব্যানার আঁকার সৌভাগ্য হলো ১৯৭২ সালে। সিনেমার নাম ওরা ১১ জন। তারপর এঁকে চললেন রংবাজ, অবুঝ মন, দুই রাজকুমার, সোনার হরিণ, বধূ এবং বেদের মেয়ে জোসনার মতো হিট সিনেমার ব্যানার। তখন আর রাত-দিনের হিসাব থাকল না। লোকে পাপ্পুর নাম দিল ‘মেশিন’। 

১৯৭৩ সালে ঢাকায় এলেন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। রেসকোর্স ময়দানে নৌকা আকৃতির মঞ্চ তৈরির দায়িত্ব পেলেন দেশের প্রখ্যাত শিল্পী নিতুন কুন্ডু। তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে মঞ্চ নকশার কাজে হাত লাগালেন টগবগে পাপ্পু। সে কী সুখের ব্যস্ততম দিন!

মেশিন যখন কাল হলো

সুখের দিন স্থায়ী হলো ২০০২ সাল পর্যন্ত। তখন ব্যানারের দাম পড়ত প্রতি বর্গফুট ৬–১০ টাকা। আঁকাআঁকির মালমসলার দামও বাড়তি। বিপরীতে ডিজিটাল ব্যানারের খরচ তুলনামূলক কম। সিনেমাওয়ালারা ব্যানারওয়ালাদের ছায়াও মাড়ান না। ডিজিটাল ব্যানার ধীরে ধীরে হাতে আঁকা ব্যানারের ক্যানভাস গিলে খেল। পাততাড়ি গোটাতে হলো ৩১ বছর বয়সী রূপায়ণ আর্ট পাবলিসিটির। ব্যানার আঁকিয়েরা কেউ ছুটলেন তৈরি পোশাক কারখানায়, কেউবা দাঁড়ালেন চায়ের দোকানে। মো. হানিফ পাপ্পু কী করলেন তখন?

‘সারা জীবনে যা কামাইছিলাম তার প্রায় সব দিয়াই কাপড়ের ব্যবসা শুরু করলাম। লস খাইলাম। শুরু করলাম স্ক্রিন প্রিন্টিংয়ের ব্যবসা।’ পাপ্পুর ঘরে তখন স্ত্রী ও এক কন্যা। জীবনে প্রথমবারের মতো ক্যানভাস বদলের কথাগুলো বলতে গিয়ে ঘোরের মধ্যে চলে গেলেন, ‘স্ক্রিন প্রিন্টিংয়ের ব্যবসাতেও লাল বাত্তি জ্বলল। জীবনে তো এই কাম করি নাই। বুঝজ্ঞান কম, বহুত কম্পিটিশন—লস না খাইয়া যামু কই! মানুষ আমারে ডাকত মেশিন নামে, সেই মেশিনই আমার কাল হইল!’

ডেনমার্কের কোপেনহেগেনের রাস্তায় হাতে আঁকা বাংলা সিনেমার ব্যানার। ছবি: সংগৃহীত
ডেনমার্কের কোপেনহেগেনের রাস্তায় হাতে আঁকা বাংলা সিনেমার ব্যানার। ছবি: সংগৃহীত

নিজেকে চেনেন কোপেনহেগেনে

মো. হানিফ পাপ্পুর জীবন থেকে আত্মবিশ্বাস, মর্যাদা, গৌরব হারিয়ে যেতে বসেছিল সিনেমার ব্যানারের সঙ্গে। ২০১৪ সালের একদিন ডেনমার্কপ্রবাসী শিল্পী রুহুল আমিন এসে পাপ্পুকে বললেন, ‘ডেনমার্কে যাবেন? সেখানে সিনেমার ব্যানার আঁকবেন, কর্মশালায় অংশ নেবেন।’ তত দিনে মানুষের মিথ্যা আশ্বাসে পাপ্পুর বুক ভেঙেছে একাধিকবার। ক্যানভাস বদল করে বেছে নিয়েছেন রিকশাচিত্রের কাজ। তাই হাতের কাজে মনোযোগ দিয়ে বলেছিলেন, ‘আমি তো হালায় সদরঘাটেই যাইবার পারতাছি না, ডেনমার্ক যামু কোন দুঃখে!’

স্বামী ছবির পোস্টার
স্বামী ছবির পোস্টার

শেষমেশ মনের সুখেই সে বছর ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে গেলেন সিনেমার ব্যানারশিল্পী মো. হানিফ পাপ্পু। সঙ্গী হলেন আরেক শিল্পী সোয়েব। আন্তর্জাতিক ওই কর্মশালায় পুরোনো দিন ফিরে পেলেন তাঁরা। চওড়া রাস্তায় আর বড় ক্যানভাসে বাংলাদেশি সিনেমার নায়ক–নায়িকার মুখ আঁকলেন পাপ্পু। ভিনদেশিরা প্রশংসায় পঞ্চমুখ। পাপ্পু বলছিলেন, ‘তখন বুঝলাম যে আমগো হাতের কাজেরও দাম আছে। একসময় ভাবছিলাম, এই লাইন পুরাপুরি ফিনিশ হইয়া গেছে। কিন্তু তখন মনে হইল, নতুন কিছু করা যায়।’

তত দিনে দেশেও সিনেমার ব্যানারের অন্য রকম চাহিদা তৈরি হলো। উৎসব–আয়োজনের উপকরণে সিনেমার ব্যানারের মতো করে আঁকার ছোঁয়া, ঘর–গৃহস্থালির অনুষঙ্গে রিকশাচিত্র। পাপ্পু ওই বকশীবাজার লেনে তাঁর দোকানের নাম দিলেন ‘রিকশা আর্ট গ্যালারি’। গ্লাস, প্লেট, বোতল আর হারিকেনের চিমনির মতো বিচিত্র ক্যানভাসে আঁকতে শুরু করলেন রিকশাচিত্র। ব্যানারের মতো এসবেও সই করতে লাগলেন ‘পাপ্পু আর্ট’।

কিন্তু পাপ্পুর মন পোড়ে বড় ক্যানভাসে আঁকার জন্য। শহরের আকাশ ঢেকে দেওয়া সিনেমার ডিজিটাল ব্যানারগুলো দেখে তাঁর বুকের কোথায় যেন মোচড় দিয়ে ওঠে। তারপরও সব কষ্ট চেপে রেখে রোজ রাত–দিন কাজ করে চলেছেন পাপ্পু। তাঁর ভাষায়, ‘কাজ না করলে তো নিজেরে এতিম এতিম লাগে। সারাক্ষণই কিছু না কিছু করনই লাগে। অনেকে আইসা এই কাজ দেইখা “আহা–উঁহু” করে, কিন্তু আসল টাইমে কেউ নাই। দুঃখ হইল, যেই কাজটা সবচেয়ে ভালোবাসি, সেইটাই করতে পারতাছি না।’

শিল্পীজীবনে বারবার ক্যানভাস বদল করতে বাধ্য হয়েছেন মো. হানিফ পাপ্পু। তিনি এটাকে দুর্ভাগ্যই মনে করেন। কেউ কেউ হয়তো একে সৌভাগ্যও বলবেন! কজন শিল্পীর ভাগ্যে এক জীবনে এত বিচিত্র ক্যানভাসে কাজ করার সুযোগ মেলে?