গলির গল্প

অলংকরণ: তুলি
অলংকরণ: তুলি

আমাদের গলিতে একটা চায়ের দোকান আছে। বাসা থেকে বেরিয়ে সেই দোকানের কাঠের বেঞ্চে বসে আছি। ছোট্ট দোকান। ময়লা মাদুরে বসে আছেন দোকানি। মালপত্র তেমন কিছু নেই। দুটো চায়ের কেটলি, চারটা কি পাঁচটা কাপ, দড়িতে ঝুলছে দুটো পাউরুটির ব্যাগ, খোলা বিস্কুটের ঝোলানো দুটো পলিথিন, কয়েকটা চিপসের প্যাকেট, সস্তা দামের কিছু সিগারেট আর পানিতে ভেজানো কিছু কচি পান।

আজ বাসায় রান্না হয়নি। এই বেলা বাইরে খেতে হবে। যাত্রাবাড়ীর অলিগলিতে কিছু হোটেল আছে। সস্তায় ভাত পাওয়া যায় বলে এগুলো গরিবের হোটেল নামে পরিচিত। ৩০-৫০ টাকায় জম্পেশ খাওয়া যায়। বুয়া না এলে আমরা সেখানেই খাই। দাদা কল করে সময় চেয়েছেন। গোসল শেষ করেই তবে আসবেন। তারপর দুজন একত্রে খেতে যাব। আমি বেঞ্চের এক কোণে বসে ফেসবুকের নিউজফিড স্ক্রল করে চলেছি। আমার পাশে ছোট্ট একটা ছেলে বসা। তারপর বাদামওয়ালা। বাদাম বিক্রেতার এটাই সর্বশেষ গন্তব্য। সন্ধ্যা থেকে জোর হাঁকে গলিতে গলিতে বাদাম বিক্রি করেন। সারা দিনের বিক্রি শেষে এই দোকানে বসেন। নিয়ম করে চা পান করেন। বিক্রি ভালো হলে চায়ের সঙ্গে কখনো কখনো পাউরুটি জোটে। নাহলে এক কাপ চা খেয়েই তাঁর সন্তুষ্ট থাকতে হয়। শরৎকাল হলেও তাপমাত্রা বেশ ঊর্ধ্বগতির। পাশে বসে থাকা কুকুরটি জিহ্বা বের করে হাঁপাচ্ছে। গরম বেশি হলে বাদাম কম বিক্রি হয়। তার প্রমাণ পেলাম বাদামওয়ালার শুধু চা পানে। আমারও চা খেতে ইচ্ছে হচ্ছে। পাশে বসা ছোট্ট ছেলেটি আমাদের দুজনের দেয়াল হিসেবে বসে আছে। বাদামওয়ালার ব্যবহার অমায়িক। দেখা হলেই একটা মুচকি হাসি দেবেন।

জিজ্ঞেস করবেন, ‘মামা, কেমন আছেন?’

তারপর হাতে দশ টাকার বাদাম গছিয়ে দেবেন। যেন আমি বাদামগুলো তাঁর থেকে পাওনা ছিলাম। মানিব্যাগ অর্থের অভাবে ঝিমিয়ে পড়েছে। সঙ্গে প্রচণ্ড গরম। বাদামওয়ালার দিকে আর দৃষ্টি ফেলা যাবে না। চায়ের কাপেও না।

আমার পাশে বসা ছোট্ট ছেলেটি হাঁসফাঁস করছে। কণ্ঠে তার অবাধ্যতার গোঙানি। চোখে তার স্বাধীনতার ঢেউ। ঘামে পুরো শার্ট ভেজা। নিশ্চিত লাফালাফি করে এসেছে কোথা থেকে। বয়স নয়-দশের বেশি হবে না। এই বয়সে বাচ্চারা এমন দুরন্তপনাই হয়। দোকানদার নীরব দৃষ্টিতে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে আছেন। গ্রাহক নেই বলে ব্যস্ততাও নেই। বাবার নীরব চাহনি ছেলেটিকে কিছুটা হলেও কাবু করেছে। ‘আমি দোকানে বসতে পারব না’ বলার পরিবর্তে কণ্ঠে বাজল ভিন্ন সুর।

‘তোমার দোকানে বসতে আমার বিরক্ত লাগে।’

‘কেন রে, বাপ?’

‘তুমি দোকানে ফ্যান লাগাওনি। প্রচণ্ড গরম।’

‘কী দিয়ে লাগাব বল? দোকানে মাল ওঠানোর টাকা নেই।’

‘সবার দোকানে ফ্যান আছে। তুমি বসাও না কেন?’

‘বাবা রে, টাকা থাকলে তো তোরেও ভালো স্কুলে পড়াতাম। তোর বোনটাকে ঈদে সুন্দর ড্রেস কিনে দিতে পারতাম। সবই কপাল।’

‘সবাই বৃহস্পতিবার রাতে খেলে বেড়ায়। তুমি আমাকে দোকানে বসাও।’

‘সবার বাবার অবস্থা কি আর তোর বাবার মতো? একটু বস, বাবা। আমি বাসায় যাই। ১১টার দিকে দোকান বন্ধ করে দিস। কাল সারা দিন খেলিস। আর টাকা হলেই তোর জন্য একটা ফ্যান লাগাব দোকানে।’

চা–দোকানির কণ্ঠ ভারী হয়ে আসছে। শেষ বাক্য কিছুটা হলেও বাচ্চাটাকে পরিতৃপ্ত করেছে। বাদামওয়ালার সঙ্গে আমার চোখাচোখি হলো। আজ বাদাম গছিয়ে দিচ্ছেন না। ‘কেউ এলে ভালো ব্যবহার করবি’—এ বলেই বাসার পথ ধরছেন চা–দোকানি। আমরা দুজন ফ্যালফ্যাল চোখে তাঁর চলে যাওয়া দেখছি। গলির সরু পথ ধরেই আস্তে আস্তে কদম ফেলে চলছেন। সামনে যেতেই হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মুছে নিচ্ছেন। হয়তো ভাগ্যদেবীর ওপর অভিমান ভর করেছে। বাদামওয়ালার চোখগুলো কেমন বিমর্ষ হয়ে আছে। চোখে অথই জল খেলা করছে। চা–দোকানির কষ্ট হয়তো হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন। পরক্ষণেই জোরেই হাঁকলেন, ‘ভাতিজা, দুইটা চা দাও। সাথে দুইটা রুটি। একটা মামার, আরেকটা আমার।’

ইকবাল আজাদ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়