ভেলা ভেসে দূরে চলে এল

অলংকরণ: তুলি
অলংকরণ: তুলি

তখন প্রথম কি দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ি। আমার ছোট ভাইটি স্কুলে যাওয়াই শুরু করেনি। সে সময় আমাদের দিনের একটা বড় সময় কাটত ঘরবন্দী হয়ে। কারণ, মা-বাবা দুজনই অফিসে যেতেন আমাদের ঘরে রেখে। প্রতিদিন অফিসে যাওয়ার সময় তাঁরা দুজনই আমার হাতে দুই টাকা করে দিয়ে যেতেন। দুই যোগ দুই—চার টাকা। এই টাকা আমরা খরচ করতাম বাসা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কাজে!

বাসার নিচে যখন শাপলা বিক্রি করতে আসত আমাদেরই বয়সী মরিয়াম, রাসেল, পাপ্পুরা—তখন ওদের ওপরে ডাকতাম। দুই টাকার শাপলা কিনতাম। তারপর বাকি দুই টাকা হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলতাম, দরজার তালা খুলে দিতে। ওরাও খুলে দিত। তারপর আর পায় কে! বেরিয়ে পড়তাম ওদের সঙ্গে। দলে ভিড়ে ডিঙিতে বা কখনো কলাগাছের ভেলায় চড়ে শাপলা তুলতাম, মাছ ধরতাম সারা দুপুর। আবার মা আসার আগে আগে বাসায় চলে আসতাম। 

একদিন ছোট ভাইকে নিয়ে এভাবেই বেরিয়েছিলাম। সেদিন কলাগাছের ভেলায় ওঠার পালা। ভেলাটি ছিল মাত্র তিনটি কলাগাছ দিয়ে বানানো। যাঁরা ভেলায় চড়েছেন, তাঁরা জানেন তিন কলাগাছের ভেলায় দুজনের বেশি ওঠা বিপদজ্জনক। আমরা যেহেতু ছোট, তাই অনায়াসে দুজন উঠতে পারলাম। মরিয়াম নামের মেয়েটি আমাদের ভেলায় তুলে দিল, তারপর ওরা সবাই মিলে এক ধাক্কা...। ভেলা ভেসে পাড় থেকে দূরে চলে এল। 

কিন্তু বিপত্তি বাধল ভেলার নিয়ন্ত্রণ নিতে গিয়ে। এত দিন শুধু ভেলায় সঙ্গী বসে থাকতাম, আজ তো কান্ডারি হয়ে গেলাম। ওরা যখন বুঝল আমি ভেলা বাইতে পারি না, ততক্ষণে দুজন অনেকটা দূরে কচুরিপানায় আটকে পড়েছি। না পারছি সামনে যেতে, না পারছি পেছনে ফিরতে। তখন কেবল সাঁতার শিখছি, ভালো করে সাঁতরাতেও পারি না। আশপাশে সাহায্য করার মতো কাউকে দেখাও গেল না। পাপ্পুরা চিৎকার করে বলছিল পাড়ে আসতে। দেখাচ্ছিল কীভাবে লগি ধরে এগোতে হবে। কিন্তু আমি তো লগি কীভাবে চালাতে হয় সেটাই জানি না। 

তারপর সাতপাঁচ না ভেবে বিলের পানিতে নেমে গেলাম। চিন্তা করলাম সাঁতরে সাঁতরে ভেলা টেনে পাড়ে নিয়ে যাব। কিন্তু তখনই ঘটল আরেক বিপত্তি, আমার নামা দেখে ছোট ভাইও নেমে পড়েছে। মহাবিপদ। ওকে বাঁচাব, না নিজে বাঁচব! 

তারপর অনেক চেষ্টা করে কোনোমতে ওকে আবার ভেলায় তুলেছি। ততক্ষণে দুজনেই পানি খেয়ে পেট ঢোল বানিয়ে ফেলেছি। তখন খেয়াল করলাম—ভেলার অবস্থাও ভীষণ নড়বড়ে হয়ে গেছে, জোড়াগুলো লিকলিকে অবস্থা। উল্টে যাবে যাবে করছে। তারপর এক হাতে কচুরিপানা পরিষ্কার করে আরেক হাতে ভেলা টানা শুরু করলাম। কিন্তু ভেলা এগোয় না। যতটুকু এগোয় তার চেয়ে বেশি যেন পিছিয়ে যায়। এভাবে চলল অনেকটা সময়। 

এরই মধ্যে পাপ্পুরা গিয়েছিল ওদের এক মামাকে ডাকতে। তাঁকে আসতে দেখে স্বস্তি ফিরে পেলাম। তারপর তিনি এসে আমাদের উদ্ধার করলেন। কিন্তু প্রায় এক ঘণ্টা বিলের পানিতে উদ্ধারযুদ্ধে আমার শরীরের অবস্থা কাহিল। 

রুকাইয়া জহির

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।