ভারতেশ্বরী হোমসের সেই রাত

>
তাসনিম সানজিদা
তাসনিম সানজিদা
জীবনের অনেক ঘটনাই রোমাঞ্চকর উপন্যাসকেও হার মানায়। আবার জীবনযাপনের কিছু ঘটনা ছুঁয়ে যায় হৃদয়, স্মৃতিতে গেঁথে থাকে আজীবন। বাস্তবের রুদ্ধশ্বাস কাহিনি ও জীবন যেমন বিভাগে ছুটির দিনে প্রতি সপ্তাহেই পাঠকের এ ধরনের লেখা তুলে ধরে। ৪ নভেম্বর প্রথম আলোর ২১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ছুটির দিনের এ দুটি বিভাগে পাঠকের বিশেষ লেখা আহ্বান করা হয়েছিল। তাতে সাড়া দিয়ে প্রচুর লেখা পাঠিয়েছেন পাঠকেরা। সেসব থেকে বাছাই করা লেখা নিয়ে সাজানো হয়েছে এবারের ছুটির দিনে।

আমি তখন ভারতেশ্বরী হোমসে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ি। ২০১৫ সালের এক রাতের ঘটনা। সারা দিন ক্লাস আর খেলাধুলা করে বেশ ক্লান্ত ছিলাম। তাই শোবার সঙ্গে সঙ্গে বিছানায় মিশে গিয়েছিলাম। আচমকা বিকট চিৎকারে চমকে উঠি। ঘুমটাও কেমন যেন ভেঙে যায়।

চতুর্থ তলার আমার বিছানা থেকে জানালা গলে দক্ষিণ-পশ্চিমে তাকালে শ্মশানঘাটটা নজরে আসে। বাইরে তাকাতেই দেখি শব দাহ করা হচ্ছে। আগুন দেখা যাচ্ছে। যদিও যথেষ্ট সাহসী আমি, তবু ঘাবড়ে গেলাম, ভয় ভয় লাগল। আমি চেষ্টা করতে থাকলাম ঘুমানোর।

রাত ১১টায় বাতি বন্ধ করে দিলাম। প্রায় ১২টার দিকে সব গুনগুনানি থেমে গেল। আমাদের রুমটা ছিল বেশ বড়। এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে দাঁড়ানো মানুষকেও চেনা যায় না। তখন রুমে ৪৮ থেকে ৫০ জন ছিলাম। গুনগুনানি থেমে যেতেই রুমে ভয়াবহ নিস্তব্ধতা নেমে এল। সেই সঙ্গে ক্লান্তি আর তন্দ্রা।

তখনই আবারও আচমকা একটা আওয়াজ এসে কানে বিঁধল। উঠে বসলাম। শব্দটা গাঢ় হতে লাগল। আমি শিউরে উঠলাম। গলাও শুকিয়ে আসছে। ঢিপঢিপ ঢিপঢিপ শব্দে কান ধরে আসছে। আমি আস্তে আস্তে লাল কেঁচোর মতো নিজেকে গুটিয়ে পাথর হয়ে থাকলাম।

কোনোমতে হাত দিয়ে নিঃশব্দে ঘড়িটা কম্বলের ভেতর ঢুকিয়ে দেখি একটা বাজে। দেখতে দেখতে দুইটা, তিনটা। আমার বেডমেট সুবর্ণাকে ডাকলাম। সে বিরক্ত হয়ে বলল, ‘কই কিচ্ছু শুনতেছি না, ঘুমা তো! সকালে ড্রিল আছে।’ ও ঘুমের দেশে পা বাড়াতেই ডাক, ‘তাসনিম...তাসনিম...এই তাসনিম...।’

‘হুম।’

‘কিছু শুনতেছ?’

‘হুম।’

‘ঘুঙুরের শব্দ তাই না? কে হাঁটে ছাদে? ছাদে তো তালা, দরজায় বড় একটা পাথরও আছে, এত রাতে...।’

এভাবেই চলল ভোর পর্যন্ত। নামাজ পড়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। সকালে উঠে মুখ খুললাম না। সবার মধ্যে জানাজানি হওয়ার ভয়ে।

সেই রাতের কথা আমি আজও ভুলতে পারি না। যদিও এত দিনে বিষয়টা জানতে পারলাম, আসলে   ওটা একধরনের পোকার ডাকের ছন্দ ছিল। যেটা শুনতে সম্পূর্ণ ঘুঙুরের মতো...।

শিক্ষার্থী, ঢাকা।