ভিনদেশি যোদ্ধাদের পাশে তাঁরাও

সময়টা ১৯৪০ সাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা চারপাশে। ১৮ বছরের টগবগে তরুণ ঠান্ডা মিয়া যোগ দেন ভারতীয় সেনাবাহিনীতে। পড়াশোনা ছিল নবম শ্রেণি পর্যন্ত। সৈনিক হিসেবে প্রশিক্ষণ নিয়েই চলে যান যুদ্ধের ময়দানে। লড়েন ব্রিটিশ পরিচালিত মিত্রবাহিনীর হয়ে। যুদ্ধের শেষ দিকে জাপানিদের সঙ্গে বার্মা সীমান্তে একটি যুদ্ধে বুকে গুলি লাগে ঠান্ডা মিয়ার। ঠাঁই হয় রাঙামাটির চন্দ্রঘোনা ক্রিশ্চিয়ান হাসপাতালে। একপর্যায়ে সেখানেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।

১৯৪৫ সালে ২ সেপ্টেম্বর ঠান্ডা মিয়াকে সমাহিত করা হয় চট্টগ্রামের ওয়ার সেমেট্রিতে। তিনি ছিলেন চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার সৈয়দ বাড়ি গ্রামের বাসিন্দা। তাঁর মতো ভিনদেশি যোদ্ধাদের পাশে সমাহিত হয়েছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে চট্টগ্রাম অঞ্চলের ২০ জন শহীদ। সবার বয়স ১৮ থেকে ৩৩ বছরের মধ্যে। চট্টগ্রাম, রাঙামাটি, লক্ষ্মীপুর ও নোয়াখালী জেলার বিভিন্ন স্থানের বাসিন্দা ছিলেন তাঁরা। যুদ্ধে আহত হওয়ার পর তাঁদের চিকিৎসার জন্য আনা হয়েছিল চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল, রাঙামাটির চন্দ্রঘোনার ক্রিশ্চিয়ান হাসপাতাল ও কুমিল্লা হাসপাতালে। সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় সবার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ভারতীয় উপমহাদেশের যেসব জায়গায় যুদ্ধ হয়, তার মধ্যে অন্যতম চট্টগ্রাম অঞ্চল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ–পরবর্তী সময়ে মিত্রবাহিনীর নিহত যোদ্ধাদের স্মরণে কমনওয়েলথ যুদ্ধ সমাধি কমিশন চট্টগ্রাম ও ময়নামতিতে দুটি সমাধিক্ষেত্র তৈরি করে। এখনো তারাই এর রক্ষণাবেক্ষণ করছে।

চট্টগ্রামে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত ব্রিটিশ মিত্রবাহিনীর যোদ্ধাদের সমাধিক্ষেত্র। ছবি: সৌরভ দাশ
চট্টগ্রামে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত ব্রিটিশ মিত্রবাহিনীর যোদ্ধাদের সমাধিক্ষেত্র। ছবি: সৌরভ দাশ

কমনওয়েলথ যুদ্ধ সমাধি কমিশনের তালিকা অনুযায়ী, চট্টগ্রাম ওয়ার সেমেট্রিতে সমাহিত হন চট্টগ্রামের ১৩ জন শহীদ। তাঁদের মধ্যে চট্টগ্রাম জেলার রয়েছেন ছয়জন—বোয়ালখালীর শাকপুরার আবদুল সাত্তার, হাটহাজারীর উত্তর মাদার্শার আজিজ উর রহমান, চট্টগ্রাম শহরের দক্ষিণ পতেঙ্গার খায়ের উল বশর, সাতকানিয়ার কাঞ্চনার ওবায়দুর রহমান, সীতাকুণ্ডের জাহানাবাদের রাজা মিয়া ও রাঙ্গুনিয়ার সৈয়দ বাড়ির ঠান্ডা মিয়া। নোয়াখালী জেলার রয়েছেন সাতজন—হাতিয়ার হরনীর আবদুল মালিক, বেগমগঞ্জের উত্তর শরীফপুরের আলী আকবর, শাকপুরার আক্কাস মিয়া, সদরের বিনোদপুরের ফজল রহমান ও জয়নাল আবেদীন, কোম্পানীগঞ্জের চর কাঁকড়ার মোহাম্মদ মোস্তফা এবং চাইপাতির শামস উল হক।

এ ছাড়া কুমিল্লার ময়নামতি ওয়ার সেমেট্রিতে সমাহিত হন সাতজন। তাঁদের মধ্যে চট্টগ্রাম জেলার রয়েছেন দুজন—ফটিকছড়ির তেলপারইয়ের আবদুল রহমান ও সাতকানিয়ার রূপকানিয়ার ফজল কবির। নোয়াখালীর রয়েছেন দুজন—কবিরহাটের লামছির আবদুল হক ও স্বর্ণাবাদের দলিলুর রহমান। লক্ষ্মীপুরের (তৎকালীন নোয়াখালী) রামগঞ্জের করপারার ফজল রহমান ও সদরের পশ্চিম লক্ষ্মীপুরের আবদুল খালেক। বাকি একজন রাঙামাটির মোখলেস রহমান।

ঠান্ডা মিয়ার সমাধিফলক
ঠান্ডা মিয়ার সমাধিফলক

বাংলা একাডেমির সহপরিচালক আহমদ মমতাজ ও লোকসংস্কৃতির গবেষক রাইহান নাসরিন রচিত বাংলাদেশে কমনওয়েলথ যুদ্ধ সমাধি নামের বইয়েও চট্টগ্রাম ওয়ার সেমেট্রিতে সমাহিত চট্টগ্রামের শহীদদের তালিকা পাওয়া যায়। ময়নামতি ওয়ার সেমেট্রির অনেক তথ্য রয়েছে এতে। আহমদ মমতাজ প্রথম আলোকে বলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে চট্টগ্রামের প্রেক্ষাপট ধরে বড় পরিসরে কাজ কম হয়েছে। এতে আরও বিস্তৃত আকারে কাজ করার সুযোগ রয়েছে।

কমনওয়েলথ যুদ্ধ সমাধি কমিশনের তথ্যভান্ডার ও বইয়ে উল্লেখিত তথ্য অনুযায়ী, ১৯৩৯-১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় গভীর জলের পোতাশ্রয় চট্টগ্রাম ছিল আরাকান সামরিক তৎপরতার অন্যতম ঘাঁটি এবং উল্লেখযোগ্য চিকিৎসাকেন্দ্র বা হাসপাতাল। মূলত হাসপাতালে মৃত ব্যক্তিদের জন্য এ সমাধিস্থল সৃষ্টি করা হয়। তবে বিভিন্ন জায়গা থেকে বিচ্ছিন্নভাবে আনা মরদেহ সমাধিস্থ করার উদ্দেশ্যে সমাধিস্থল দুটি সম্প্রসারণ করা হয়। চট্টগ্রাম ওয়ার সেমেট্রিতে শায়িত রয়েছেন বিভিন্ন দেশের তিনজন নারী সৈনিকসহ সেনা ও বিমানবাহিনীর ৭৫১ জন যোদ্ধা এবং বেসামরিক চারজন ব্যক্তি। এ ছাড়া ময়নামতি ওয়ার সেমেট্রিতে সমাহিত হয়েছেন ৭৩৭ জন। তাঁদের মধ্যে ৭৩৬ জন যোদ্ধা ও একজন বেসামরিক ব্যক্তি। তাঁরা সবাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নিহত হন চট্টগ্রাম অঞ্চলে।

ঠান্ডা মিয়ার খোঁজে

চট্টগ্রাম শহর থেকে ২৭ কিলোমিটার দূরে রাঙ্গুনিয়ার সৈয়দ বাড়ি গ্রাম। এই গ্রামের পূর্বপাড়ায় ঠান্ডা মিয়ার বাড়ি। মা–বাবার একমাত্র ছেলে ছিলেন। পাঁচ বোনের আদরের একমাত্র ভাই। তিনি ছিলেন অবিবাহিত। বর্তমানে তাঁর স্বজনদের মধ্যে বোনের ছেলেরা আছেন। পাঁচ বোনও মারা গেছেন।

ঠান্ডা মিয়ার ভিটায় থাকেন তাঁর ছোট বোনের ছেলে মোহাম্মদ মুছা তৈয়বী। ৬০ বছরের মুছা তৈয়বী প্রথম আলোকে বলেন, মামার সাহসিকতা সম্পর্কে মা ও নানির মুখে অনেক গল্প শুনেছেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি ডানপিটে ছিলেন। নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন রাঙ্গুনিয়া আদর্শ বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয়ে। এরপর ১৯৪০ সালে সেনাবাহিনীতে চলে যান। যুদ্ধে তাঁর বুকে গুলি লেগেছিল বলে তাঁরা জেনেছেন। মামার অবসরকালীন ভাতা তাঁর নানি মৃত্যুর আগে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত পেয়েছেন।

এখন মামার স্মৃতি বলতে আছে শুধু তাঁর ব্যবহৃত একটি ট্রাংক, যেটা তিনি মারা যাওয়ার পর পরিবারের কাছে পৌঁছানো হয়। পরম্পরায় তিনি তা সংরক্ষণ করে রেখেছেন।

কমনওয়েলথ যুদ্ধ সমাধি কমিশনের তথ্যভান্ডারে ঠান্ডা মিয়ার ঠিকানা, মা–বাবার নাম ও সমাহিত করার তারিখ থাকলেও তিনি কখন কোথায় আহত হয়েছিলেন, সেই তথ্য পাওয়া যায়নি। বাকি যোদ্ধাদের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা— শুধু নাম–ঠিকানা ও সমাহিত করার তারিখই আছে।

চট্টগ্রাম ওয়ার সেমেট্রিতে একদিন

সবুজ ঘাসের ফাঁকে সারি সারি এপিটাফ। প্রস্তরফলকে নাম, রেজিমেন্ট বা ইউনিট আর মৃত্যুর তারিখ লেখা। পাশাপাশি মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের সমাধি। এখানে সবার এক পরিচয়—যুদ্ধে শহীদ। আছে ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, অবিভক্ত ভারত, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা ও জাপানি যোদ্ধাদের সমাধি। তাঁর কেউ সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা, কেউ সৈনিক কিংবা যুদ্ধকালীন প্রকৌশল বিভাগের কর্মী। 

চট্টগ্রাম শহরের গোল পাহাড়ের মোড় হয়ে ডান দিকে বাদশা মিয়া চৌধুরী সড়ক। ৫০ গজের মতো গোল পাহাড়ের কোল ঘেঁষে এই ওয়ার সিমেট্রি। ৭ একর জায়গার ওপর গড়ে উঠেছে এই সমাধিক্ষেত্র। মূল ফটকে পেরিয়ে পিচঢালা পথ ধরে এগোতেই প্রথমে চোখে পড়বে ফুলের বাগান। চারপাশ গোছানো, পরিচ্ছন্ন পরিবেশ। এরপর সমাধির ফটক। বড় আকারের সাদা ক্রুশ জানান দিচ্ছে সমাধিক্ষেত্রের পবিত্রতা। প্রতিটি সমাধির পাশে আছে ফুলের গাছ। কিছু গাছের ফুল ঝরে পড়েছে সমাধিতে। দক্ষিণের এক কোনায় পাওয়া যায় ঠান্ডা মিয়ার কবর। একে একে দেখা চট্টগ্রামের সব শহীদের কবর। সমাধিস্থলেই একটি ছোট ঘরে রয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ১৯৩৯ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম অঞ্চলের যুদ্ধের নানা তথ্য। কোন দেশের কতজন শহীদ, তার তালিকা।

কমনওয়েলথ যুদ্ধ সমাধি কমিশনের বাংলাদেশের কান্ট্রি ম্যানেজার মো. আবু সাঈদ বলেন, যুদ্ধের সময় বার্মা ও আরাকানের বেশ কিছু স্থানে লড়াই হয়। সেখানে যাঁরা আহত হয়েছিলেন তাঁদের চিকিৎসা দেওয়া হয় চট্টগ্রাম জেনারেল ও রাঙামাটির চন্দ্রঘোনার ক্রিশ্চিয়ানসহ অস্থায়ী বিভিন্ন হাসপাতালে। চিকিৎসাধীন মৃত ব্যক্তিদের সমাহিত করা হয় চট্টগ্রাম ও ময়নামতি ওয়ার সেমেট্রিতে। চট্টগ্রামের সেমেট্রিতে একজন ব্রিগেডিয়ারের সমাধিও আছে।

সমাধিস্থল থেকে ফেরার পথে চোখ আটকায় দক্ষিণ কোণের দুটি এপিটাফে। পাশাপাশি দুটি কবর—নুর উল্লাহ খান ও জে লারাইয়া। একজন মুসলিম, অন্যজন খ্রিষ্টান। দেশও ভিন্ন। হয়তো যুদ্ধের ময়দানে এভাবেই তাঁরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়েছেন একসঙ্গে। তাঁদের এক পরিচয়—যোদ্ধা।