ময়মনসিংহ থেকে মুম্বাই

তেরেন্স লুইসের সঙ্গে মোফাসসাল আল আলিফ (ডানে)। ছবি: সংগৃহীত
তেরেন্স লুইসের সঙ্গে মোফাসসাল আল আলিফ (ডানে)। ছবি: সংগৃহীত

মেসেঞ্জারে কথার শুরুতেই একগাদা ছবি পাঠালেন তিনি। তাতে আলাপটা সহজ হলো। বোঝা গেল, নাচের সঙ্গে দোস্তি মোফাসসাল আল আলিফের। মাইক্রোবায়োলজির মতো খটমট একটি বিষয়ে স্নাতক করেছেন। কিন্তু স্বপ্নটা বাঁধা ছিল নূপুরের রিনঝিন শব্দে। তাই, ময়মনসিংহের ভালুকার হোসেনপুরের আলিফ এখন নাচেন বলিউডের নামকরা কোরিওগ্রাফার তেরেন্স লুইসের সঙ্গে। জনপ্রিয় রিয়েলিটি শো ড্যান্স ইন্ডিয়া ড্যান্স–এর গ্রান্ড ফিনালেও মঞ্চে তেরেন্সের সঙ্গে ছিল মনকাড়া পারফরমেন্স। তরুণ এই নৃত্যশিল্পীর সঙ্গে পরিচিত হতেই এই আলাপ।

নাচের ভূত সম্ভবত মাথায় চেপেছিল গ্রামের থিয়েটার আর যাত্রা দেখে। সেই বীজ আগলে রেখে চারাটি বড় করেছেন স্কুল ও কলেজজীবনে। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে নাচের সেই চারাগাছ ডালপালা মেলল নানা জনের হাত ধরে।

কী পেয়েছি, কী করছি

২০১৮ ও ২০১৯ সালে আলিফ অন্ধ্র প্রদেশের স্কুল অব থিয়েটার থেকে ‘কালাজেভা’ পুরস্কার পান। তামিলনাড়ু থেকে ‘নৃত্যকলা রত্ন’ সম্মান পান ২০১৯ সালে। ২০১৮ সালে মুম্বাই থেকে ‘নৃত্য তরঙ্গিনী’ পুরস্কার মেলে, আর পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান থেকে ‘প্রেরনাস্রি’ পুরস্কার পান ২০১৮ সালে। এ ছাড়া ২০১৬, ২০১৭, ২০১৮ সালে আন্তবিশ্ববিদ্যালয় সাংস্কৃতিক নৃত্য প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন আলিফ।  

বেশ কিছু দেশে ও আয়োজনে নৃত্য পরিবেশন করেছেন। ইন্টারন্যাশনাল ফোকলোর কালচারাল এক্সচেঞ্জ ফেস্টিভ্যাল থাইল্যান্ডে ২০১৭ সালে                                                                এবং মিসরে ২০১৮ সালে অংশ্রগ্রহণ করেন। পুনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল ড্যান্স কানেক্ট ড্যান্স ফেস্টিভ্যালে অংশগ্রহণ একই বছরে। পশ্চিমবঙ্গে প্রেরনাস্রি ইন্টা. ড্যান্স ফেস্টিভ্যালে ও মুম্বাইয়ে নৃত্য তরঙ্গিনী ইন্টা. ড্যান্স ফেস্টিভ্যালে ২০১৮ সালে অংশগ্রহণ করেন তিনি। তামিলনাড়ু সংস্কৃতি উৎসবে অংশ নেন ২০১৯ সালে।

আলিফ বলেন, ‘তেরেন্স স্যারের সঙ্গে কাজের পাশাপাশি একটি নাচের প্রযোজনাও করেছি “আই অ্যান্ড মাইসেলফ” নামে। এটি মূলত ভারত-বাংলাদেশের দুইজন নৃত্যশিল্পীর দ্বৈত প্রযোজনা। ইতিমধ্যে ভারতে ও শ্রীলঙ্কাতে আমরা মঞ্চায়ন করেছি। সামনে বিভিন্ন দেশে এটা নিয়ে ট্যুর করব।’ 

পড়ালেখায় ছাড় ছিল না

নাচকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে পড়ালেখা কি একটু কম প্রাধান্য পেয়েছে? আলিফ বলেন, ‘এমন অনেক  সময় গেছে, নাচের অনুষ্ঠান থেকে ফিরে ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছি। তবে ফলাফলে গোল্লা পাইনি। রেজাল্ট ভালোই ছিল।’

আলিফ নাচে যেমন ভালো, তেমনি পড়ালেখাতেও। তাই পরিবার থেকে কোনো বাধা আসেনি। বড় ভাই ছিলেন সংস্কৃতিমনা। বলেছেন, তোর যা ভালো লাগে তা–ই কর। আলিফের ভালো লাগা নাচকে ঘিরে। নাচেই নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন। তাতে বন্ধুরা সাহায্য করেছে, শিক্ষকেরা সাহায্য করেছেন, নাচের প্রশিক্ষকেরা তাঁকে এগিয়ে নিয়েছেন এতদূর। 

নাচের শুরুর গল্প

আলিফ বলেছিলেন, জাহাঙ্গীরনগর থিয়েটারে যোগ দেওয়ার পর নাচের পথটা আরও সহজ হয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে ঢাকার ঈগলস ড্যান্স কোম্পানিতে নাচ শুরু করেন। কিছুদিন পরে নন্দনকলা কেন্দ্রের এম আর ওয়াসেকের কাছে নাচের মৌলিক প্রশিক্ষণ নেন। পাশাপাশি ইউটিউব দেখে পরিচিত হন নানা দেশের নাচের ধরনের সঙ্গে। এর মধ্যে সাধনা থেকে বৃত্তি পেয়ে মুম্বাইতে চলে যান তেরেন্স লুইস কনটেম্পোরারি ড্যান্স কোম্পানিতে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য। আলিফ বলেন, ‘সাধনা থেকে এই স্কলারশিপটি আমি পাই। এ জন্য আমি কৃতজ্ঞ লুবনা মরিয়ম ও লিখন রায়ের কাছে।’

আলিফ এখানে সমসাময়িক, জ্যাজ, ব্যালে, বলিউড হিপহপসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নাচের প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। পাশাপাশি ইয়োগার ওপরও নিয়েছেন বিশেষ তালিম। আলিফের মতে, ইয়োগা নৃত্যশিল্পীদের জন্য অনেক জরুরি। এই মুহূর্তে আলিফ ব্যস্ত তাঁর প্রযোজনা ‘আই অ্যান্ড মাইসেলফ’ নিয়ে। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে বলেন, ‘গ্লোবালাইজেশনের এই যুগে নাচে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে। এখান থেকে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ নিয়ে বাংলাদেশে ফিরে গিয়ে একটি আন্তর্জাতিক মানের ড্যান্স ইনস্টিটিউট ও কোম্পানি করতে চাই। চলচ্চিত্রসহ সব সেক্টরে নাচ নিয়ে কাজ করতে চাই।’