আমজাদ হোসেনের কলের গান এখনো চালু

গান শোনার এক নস্টালজিক যন্ত্রের নাম গ্রামোফোন। বাংলাদেশে আমরা যেটি চিনি কলের গান নামে। এখনো পুরোনো দিনের সিনেমায় দেখা যাওয়া যন্ত্রটি স্মৃতি হিসেবে সংগ্রহে রেখেছেন অনেকেই। কলের গানের তেমনই একজন সংগ্রাহক আমজাদ হোসেন। কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার কেবলকৃষ্ণ জুম্মাহাটে তাঁর বাড়ি। আমজাদ হোসেনের সংগ্রহে থাকা গ্রামোফোনগুলো শুধু শোকেসের শোভা বাড়ানোর জন্য নয়, এগুলো এখনো সচল। চাইলে শোনা যায় বিভিন্ন শিল্পীর পুরোনো দিনের জনপ্রিয় গান।

উনিশ শতকের শেষের দিকে তৈরি হওয়া এই গ্রামোফোন পুরো বিশ শতক গান শোনার যন্ত্র হিসেবে ছিল ব্যাপক জনপ্রিয়। বিশ শতকের শেষের দিকে গান শোনার বিভিন্ন নতুন যন্ত্র আবিষ্কার হওয়ায় যন্ত্রটি তার বাজার হারাতে থাকে। ঠাঁই নিতে থাকে জাদুঘরে, শৌখিন সংগ্রাহকদের সংগ্রহশালায়। সেই ধারায় বাংলাদেশেও হারিয়ে যেতে থাকে যন্ত্রটি। কিন্তু এক অমোঘ নেশার টানে কুড়িগ্রামের আমজাদ হোসেন সংগ্রহ করতে শুরু করেন গ্রামোফোন যন্ত্র এবং এই যন্ত্রে গান শোনার রেকর্ড প্লেয়ার।

আমজাদ হোসেনের সংগ্রহে থাকা গ্রামোফোন ও রেকর্ড প্লেয়ার। ছবি: লেখক
আমজাদ হোসেনের সংগ্রহে থাকা গ্রামোফোন ও রেকর্ড প্লেয়ার। ছবি: লেখক

২.
শুরুটা হয়েছিল বাবার হাত ধরে, সেই ছোটবেলায়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই আমজাদ হোসেনের বাবা দেলওয়ার হোসেন ‘জনতা মাইক সার্ভিস’ নামের একটি দোকান দিয়ে নিজ এলাকায় শুরু করেন মাইকের ব্যবসা। তখন আমজাদের বয়স ১২/১৪ বছর। মাইক ভাড়া হওয়ার পর কখনো কখনো মাইক অপারেটর খুঁজে পাওয়া না গেলে আমজাদকে পাঠানো হতো অপারেটর হিসেবে। কিশোর বয়সে এভাবেই মাইক ও কলের গানের সঙ্গে প্রেম শুরু হয় আমজাদ হোসেনের। বাবার মাইকের ব্যবসা আর নিজের ভালো লাগার সুবাদে তিনি সংগ্রহ করতে থাকেন বিভিন্ন শিল্পীর গানের রেকর্ড। যেখানেই গানের রেকর্ডের খবর পেয়েছেন, রেকর্ড কিনতে ছুটে গেছেন সেখানে। এমনও হয়েছে, ৫ হাজার টাকা দিয়ে আব্বাসউদ্দীন আহমদের একটি গানের রেকর্ড কিনে নিতেও দ্বিধা করেননি তিনি।

১৯৯০ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বেসামরিক বিভাগে পেইন্টার পদে যোগদান করেন আমজাদ হোসেন। তত দিনে পৃথিবীর অন্যান্য দেশে গ্রামোফোনের বাজার মোটামুটি শেষ। উৎপাদনও প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে যন্ত্রটির। কিন্তু বাংলাদেশে তখনো কলের গানের কিছুটা অস্তিত্ব ছিল। চাকরিতে যুক্ত হয়েও আমজাদ হোসেনের কলের গানের প্রতি ভালোবাসার কমতি হয়নি এতটুকু। বরং এ সময় তিনি আরও কিছুটা উদ্যমী হয়ে ওঠেন গ্রামোফোন ও তার রেকর্ড সংগ্রহ করার ব্যাপারে। সকাল সাড়ে ৭টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত অফিস করার ফাঁকে ফাঁকে চলে তাঁর গ্রামোফোন ও রেকর্ড প্লেয়ার খোঁজার পালা। অফিস শেষ করে বিভিন্ন জায়গায় ছুটে যান গ্রামোফোনের সন্ধানে। ঢাকা শহরের অলিগলি ঘুরে একে একে সংগ্রহ করেন হাতে ঘোরানো দুষ্প্রাপ্য ৮টি গ্রামোফোন এবং ১২টি ইলেকট্রিক গ্রামোফোন রেকর্ড প্লেয়ার। বেতনের টাকা বাড়িতে কম করে পাঠিয়ে ধীরে ধীরে কিনে ফেলেন ৫ হাজার রেকর্ড। এর মধ্যে ইপি ৩ হাজার কপি (ছোট), এলপি ২ হাজার কপি (বড়)। এ ছাড়া তাঁর সংগ্রহে রয়েছে হাজারখানেক অডিও ক্যাসেট।

আমজাদ হোসেন জানান, ১৯৯১ সালে তিনি মিরপুরের কালুবাড়ি বাউনিয়া এলাকায় ‘জনতা অডিও-ভিডিও সেন্টার’ নামে একটি দোকান দিয়ে গানের রেকর্ড ও ভিডিও ক্যাসেট ভাড়া দেওয়ার ব্যবসা শুরু করেন। তিনি বলেন, ‘অবসরে বাজাতাম বঙ্গবন্ধুর তিনটি ভাষণের রেকর্ড। খবর পেলাম দুষ্কৃতকারীরা এই রেকর্ডগুলো ধ্বংস করে দেবে। এই ভয়ে রেকর্ড ৩টি পলিথিনে মুড়িয়ে মাটির নিচে পুঁতে রাখি। পরে আবার সেগুলো তুলে সংরক্ষণের চেষ্টা করি। কিন্তু তত দিনে রেকর্ডের কভারগুলো নষ্ট হয়ে গেছে।’ আমজাদ হোসেন পরবর্তীতে নতুন মোড়কে সেই রেকর্ড তিনটি সংরক্ষণ করেন।

লং প্লে। ছবি: লেখক
লং প্লে। ছবি: লেখক

৪.
অষ্টম শ্রেণি পাস আমজাদ হোসেন ২০১৭ সালের ৫ জুলাই চাকরি থেকে অবসর নিয়ে ফিরে যান নিজ গ্রামে। বাড়িতেই তৈরি করেন তাঁর সংগ্রহশালা। বর্তমানে টিনের ঘরে সাধ্যমতো কাঠের র‍্যাক বানিয়ে সংরক্ষণ করছেন ২০টি গ্রামোফোন, প্রায় ৫ হাজার রেকর্ড ও আনুমানিক ১ হাজার অডিও ক্যাসেট। তাঁর সব কটি গ্রামোফোন এখনো সচল। এগুলোর কোনো যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দিলে তিনি বিভিন্ন জায়গা থেকে বিকল্প পার্টস তৈরি করে নিজেই সচল রাখেন।

আমজাদ হোসেন বলেন, ‘আমার প্রতিদিনের কাজ হলো গ্রামোফোনগুলো পরিষ্কার করা। বাজার থেকে মশার কয়েলের খালি প্যাকেট সংগ্রহ করে মোড়ক বানিয়ে শিল্পী ও অ্যালবামের নাম লিখে রেকর্ডগুলো সংরক্ষণ করা।’

আমজাদ হোসেনের রয়েছে উত্তরবঙ্গের পুরোনো দিনের ভাওয়াইয়া গানের এক সমৃদ্ধ সংগ্রহ। ‘নদীর পানি খাকলাত, কি খুকলুত, কি খালাউ খালাউ করে রে/ হায় হায় প্রাণের বন্ধু রে’, ‘ওকি একবার আসিয়া/ সোনার চান্দ মোর যাও দেখিয়া রে’ বা আয়শা সরকারের গাওয়া কালজয়ী ভাওয়াইয়া গান ‘আইজ পুতুলের অধিবাস কাইল পুতুলের বিয়্যা/ পুতুল যাইবে শ্বশুর বাড়ি মুকুট মাথায় দিয়্যা’। এমন বিভিন্ন শিল্পীর গাওয়া জনপ্রিয় ভাওয়াইয়া গানগুলো আমজাদ হোসেনকে বিমোহিত করে। পুরোনো দিনের এই ভাওয়াইয়া গানগুলোর বেশির ভাগই এখন আর শুনতে পাওয়া যায় না। কিছু কিছু গান ব্যক্তিগত সংগ্রহে রয়েছে বিভিন্ন লোকের। আমজাদ হোসেনের সংগ্রহশালায় রয়েছে আব্বাসউদ্দীন, আব্দুল আলীম, হৈমন্তী শুক্লা, কিশোর কুমার, আশা ভোসলে, অনুপ ঘোষাল, অনুপ জলটা, পঙ্কজ উদাস, মোহাম্মদ রফীসহ শত শত বিখ্যাত শিল্পীর গানের পুরোনো রেকর্ড। পাশাপাশি তিনি সংরক্ষণ করেছেন বঙ্গবন্ধুর ওপর ভিত্তি করে লেখা সব গান ও ভাষণ।

আমজাদ হোসেনের চাওয়া—বঙ্গবন্ধুর ওপর ভিত্তি করে লেখা সব গান ও ভাষণ নিয়ে ‘বঙ্গবন্ধু কলের গান মিউজিয়াম’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান হোক।

সংগ্রহগুলো ভালোভাবে সংরক্ষণ করতে চান আমজাদ হোসেন। ছবি: লেখক
সংগ্রহগুলো ভালোভাবে সংরক্ষণ করতে চান আমজাদ হোসেন। ছবি: লেখক

৫.
কুড়িগ্রামের আমজাদ হোসেন চান তাঁর সংগ্রহে থাকা গ্রামোফোন ও গানের রেকর্ডগুলো সযত্নে রক্ষা করতে। কিন্তু টিনের ঘরে, অনিয়ন্ত্রিত আবহাওয়ায় ঠিক কত দিন সেগুলোকে তিনি সংরক্ষণ করতে পারবেন, সে প্রশ্নের উত্তর তাঁর জানা নেই।

নিজের সংগ্রহের পাশে আমজাদ হোসেন। ছবি: লেখক
নিজের সংগ্রহের পাশে আমজাদ হোসেন। ছবি: লেখক

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী