স্টেশনে ছিল আমাকে পেটানোর প্রস্তুতি

অংলকরণ: মাসুক হেলাল
অংলকরণ: মাসুক হেলাল

২০১০ সালের শীতের এক দুপুর। কমলাপুর রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মে বসে বসে আমি আকাশ দেখছি। দূরে একটা চিল উড়ছে। একা এক কিশোর ঢাকায় ঘুরতে চলে এসেছে, তার সঙ্গে চিলের তো মিল আছেই। 

নেত্রকোনা যাওয়ার ট্রেন সেই সকালে ছিল। মহুয়া এক্সপ্রেস। এই মেইল ট্রেন মিস করায় সকাল থেকে বসে আছি স্টেশনে। ময়মনসিংহগামী কোনো একটা ট্রেনে উঠে পড়ব। ওখান থেকে বাড়ি যাওয়া অনেক সহজ। জামালপুর কমিউটারের টিকিট ছেড়েছে একটু আগে। আগেভাগে টিকিট কেটে ফেললাম। 

এতক্ষণে অবশ্য বাসার কাছাকাছি থাকার কথা ছিল। বাসায় কী দুশ্চিন্তাটাই না করবে। নারায়ণগঞ্জে মামাবাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে বড় ভাইয়ার সঙ্গে ফোনে কথা হয়েছিল। আমার কাছে কোনো ফোনও নেই যে যোগাযোগ করব।

ট্রেন এসে দাঁড়াল প্ল্যাটফর্মে। উঠে বসতেই খানিকটা স্বস্তি অনুভব হলো। যাক, ময়মনসিংহ পৌঁছাতে পারলেই হবে। আমার পাশের সিটে একজন প্রৌঢ় বসেছেন। সারাক্ষণ পান চিবোচ্ছেন। ট্রেন ছাড়তে এখনো বেশ দেরি বলে আমি বসে বসে মানুষ দেখছি। অনেকের সঙ্গেই ভাব জমাতে চেষ্টা করছি৷ আমাদের পাশের আসনে বসেছেন একজন মধ্যবয়স্ক নারী। সঙ্গে তাঁর মেয়ে। বয়স আমার মতোই। মেয়েটির সঙ্গে বেশ কয়েকবার চোখাচোখি হতেই লাজুক হাসল। গল্প শুরু করলাম তাঁদের সঙ্গেও।

ট্রেন ছেড়েছে মাত্র। তখনো প্ল্যাটফর্ম ছাড়েনি। একজন টিকিট চেকার এসে সবার টিকিট চেক করতে শুরু করলেন। আমার সামনে বসে থাকা লোকটাকে টিকিট দেখাতে বললেন। তিনি পকেটে হাত দিয়ে হায় হায় করে উঠলেন। ‘আমার মোবাইল, আমার মোবাইল!’ বলে এদিক–সেদিক খুঁজতে শুরু করলেন। জানা গেল, তিনি তাঁর বুকপকেটে মোবাইল নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। এখন মোবাইল পাচ্ছেন না। আশপাশের সব যাত্রীই খুঁজলেন। মধ্যবয়সী সেই নারী হঠাৎ বললেন, একজন চানাচুরওয়ালা একটু আগে এখানে নুইয়ে কিছু একটা তুলেছিলেন। কথাটা শেষ হওয়ার আগেই মোবাইল হারানো লোকটা ট্রেন থেকে লাফ দিয়েই নেমে গেলেন।

হঠাৎ খেয়াল হলো লোকটা তাঁর ব্যাগ দুইটা ফেলে গেছেন ট্রেনে। আমি ব্যাপারটা বললাম সবাইকে। কেউ পাত্তাই দিল না। আমার খুব খারাপ লাগতে শুরু করল। না জানি কত জরুরি কিছু আছে এই ব্যাগের মধ্যে।

ট্রেন ছুটছে আপন গতিতে৷ আমি ভেবেছিলাম। ওই লোক বোধ হয় অন্য কোনো বগিতে উঠেছে। একসময় ঠিকই আসবে৷ কিন্তু বিমানবন্দর, জয়দেবপুর পার হয়ে অন্যান্য স্টেশনও পেরিয়ে যাচ্ছে ট্রেন৷ লোকটার আসার নাম নেই। আমি নিশ্চিত হয়ে গেলাম তিনি আর আসবেন না। সবাইকে আবার বললাম। কেউ আবারও কোনো গা করল না। দু-একজন শুধু আফসোস করল। সেই আফসোসকারীদের মধ্যে সেই মেয়েটিও ছিল।

মেয়ের মা ঠাস করে মেয়ের গালে চড় বসিয়ে দিলেন। বাজে ভাষায় কয়েকটা কথা বললেন মেয়েকে। তাঁর আচমকা এমন আচরণে আশপাশের সবাই স্তম্ভিত হয়ে গেল। হুট করে আমাকে লক্ষ্য করেও বকাবকি শুরু করলেন। আমি এত কথা কেন বলছি, এই নিয়ে নাকি প্রচণ্ড বিরক্ত তিনি।

আমিও বোকার মতো তাঁর সঙ্গে তর্ক জুড়ে দিলাম। ব্যস, আর যায় কোথায়! যাত্রীরা দুই ভাগ হয়ে গেল, এক ভাগ আমার হয়ে তর্ক করতেও ছাড়ল না। অন্যরা বসে বসে মজা দেখতে থাকল। কয়েকজন অবশ্য আমাকেও ধমকে থামাতে চাইল। মেজাজ খারাপ হয়ে গিয়েছিল আমার। তাঁকে বেশ কয়েকটা কথা শুনিয়ে দিলাম। গফরগাঁও পার হওয়ার পর শুনতে পেলাম। তিনি ফোন করে ময়মনসিংহ স্টেশনে লোক জড়ো করছেন। আমাকে পেটানো হবে বলে তাদের প্রস্তুত হতেও বললেন। আমাকে একবার শাসালেন। 

ট্রেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় েস্টশনে থামল। আমাদের বগিতে কয়েকজন শিক্ষার্থী উঠলেন। সেই নারী আবার ফোন করে নিশ্চিত করলেন সবাই এসেছে কি না। আমার চেহারার বর্ণনাও দিতে লাগলেন। আশপাশের লোকজন এবার খেপে গেল। তাঁকে সবাই কড়া কড়া কথা শোনাচ্ছে। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও আগ্রহী হয়ে উঠলেন ব্যাপারটা নিয়ে। সেই নারীর সঙ্গে তাঁরাও খানিকক্ষণ তর্ক করে ক্ষান্ত হলেন।

ট্রেন ময়মনসিংহ স্টেশনে থামতেই কয়েকজন লোক উঠল ট্রেনে। সেই নারীর কাছে এসে আমার খোঁজ করল। এবার আমি সত্যিই ভয় পেয়ে গেলাম। এমনিতেই আমি নেমে যেতাম। ওরা সত্যিই আমাকে মারার প্রস্তুতি নিয়ে এসেছে। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ঢাল হয়ে দাঁড়ালেন আমার জন্য। ওদের সঙ্গে হাতাহাতি চলল খানিকক্ষণ। কয়েকজন মিলে আমাকে নিয়ে নিচে নেমে এলেন। সবাই মাঝখানে গোল চক্র করে আমাকে স্টেশনের বাইরে নিয়ে এসে রিকশায় তুলে দিল। গৌরীপুরের বাসে উঠলাম আমি। আপাতত বোনের বাড়ি যাই। বুকটা ধড়ফড় করছে তখনো।

সৈয়দ মিজানুর রহমান
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।