সুপেয় পানির ফেরিওয়ালা

মানুষের কাছে সুপেয় পানি পৌঁছে দেন আমিনুল ইসলাম। ছবি: লেখক
মানুষের কাছে সুপেয় পানি পৌঁছে দেন আমিনুল ইসলাম। ছবি: লেখক

খুলনার কয়রা উপজেলায় সুপেয় পানির সংকট তীব্র হয়ে উঠল ঘূর্ণিঝড় আইলার পর। এমনিতেই এই এলাকার মানুষের জন্য সুপেয় পানি সহজে মেলে না। সারা বছরই লোনাপানির সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যেতে হয় উপজেলাবাসীর। অগভীর বা গভীর নলকূপ অকার্যকর। পুকুরের পানিই তাদের ভরসা। ২০০৯ সালের ২৫ মে ঘূর্ণিঝড় আইলার আঘাতের পর তা যেন আরও প্রকট হলো। এক কলসি পানযোগ্য পানি যেন তখন সোনার হরিণ। মানুষ খাওয়ার পানির আনতে ছুটে যাচ্ছিল মাইলের পর মাইল। 

তখনই কয়রার মাদারবাড়িয়ার ভ্যানচালক মো. আমিনুল ইসলাম ভাবলেন বাড়ি বাড়ি পানি পৌঁছে দেওয়ার কথা। মোটামুটি অবস্থাসম্পন্ন মানুষ নিশ্চয় তাঁর পানি কিনবেন। ভাবনা থেকেই শুরু করলেন কয়রা উপজেলার মহারাজপুর বটতলা এলাকায় পানি বিক্রির কাজ। ১০ বছরের বেশি সময় তিনি সেই কাজই করছেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পানি বিক্রির এলাকার পরিধি বেড়েছে। উপজেলার মাদারবাড়িয়া, বটতলা, বাইলহারানিয়া, বামিয়া, বাকিনগর, শ্রিফলতলা গ্রামসহ পার্শ্ববর্তী কয়েক গ্রামে পানি বিক্রি করেন তিনি। 

আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘১০ বছর ধরি এই কাজ করছি। মানুষের ছুটিছাটা আছে। আমার ঈদেও রেস্ট নাই।’ 

প্রতিদিন ভোরে ঘুম থেকে ওঠেন আমিনুল। ভ্যানগাড়ি নিয়ে বাড়ি থেকে সাত কিলোমিটার দূরের ইসলামপুর সরকারি পুকুরে ছুটে যান। এরপর পুকুর থেকে ছোট-বড় ড্রাম ভরে সেগুলো ভ্যানে তোলেন। ড্রামগুলো পানিতে ভরে গেলে ভ্যান ঠেলে নিয়ে আসেন বটতলা বাজারের কাছে। দোকানগুলোর নির্দিষ্ট স্থানে রাখা পানির পাত্র ভরে রাখেন। সকালে ও বিকেলে বাজারের দোকানে তাঁর এই পানি সরবরাহের কাজ চলে। সব কটি দোকানে পানি ভরা শেষ হলে বাড়ি বাড়ি পানি সরবরাহ করেন আমিনুল। 

ভ্যানগাড়িতে প্রতিবার সাতটি করে ড্রামে পানি আনেন আমিনুল। ৩০ লিটারের প্রতি ড্রাম পানির দাম ১০ টাকা। তবে দূরের গ্রামগুলোতে গ্রাহকদের দিতে হয় ১৫ টাকা করে। এতে প্রতিদিন তাঁর ৫০০ টাকার মতো আয় হয়। 

এই আয়ে চলে আমিনুল ইসলামের চার সদস্যের সংসার। দুই সন্তানের মধ্যে মেয়েটা সবে স্কুলে যেতে শুরু করেছে আর ছেলেটা আরও ছোট। তাদের নিয়েই আমিনুলের যত ভাবনা। জমিজমা বলতে ৩ শতাংশের একটি বাড়ি-ভিটেই সম্বল। ফসলি কোনো জমি নেই। বিকল্প কোনো পেশা নিয়েও ভাবেননি এখনো। তবে এরই মধ্যে আমিনুল ইসলামের দেখাদেখি আরও অনেকেই পানি বিক্রির পেশায় জড়িয়েছেন। দূরদূরান্ত থেকে সুপেয় পানি সংগ্রহ করে গ্রাহকদের বাড়ি কিংবা দোকানে পৌঁছে দেন তাঁরাও। প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত এই মানুষেরাও আমিনুল ইসলামের মতো ঘুরে দাঁড়ানোর নিরন্তর সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন।