সাইদুলের কিস্সা-কাহিনি

গান ও নাচের তালে কিস্‌সা বলেন সাইদুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত
গান ও নাচের তালে কিস্‌সা বলেন সাইদুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

২০ বছর বয়সে নাম লিখিয়েছিলেন যাত্রা দলে। দিনে দিনে তিনি তখন দলটির পাকা অভিনেতা। নায়কের ভূমিকায় মঞ্চে ওঠেন প্রায়ই। কিন্তু ১৯৮৩ সালের একটি ঘটনা তাঁর জীবনের বাঁক বদলে দিল। তবে সেই বাঁকবদল মঞ্চচ্যুত করেনি সাইদুলকে।

২১ জানুয়ারি বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির প্রাঙ্গণে বসে সেই গল্পই শোনান সাইদুল ইসলাম, ‘সে সময় একদিন যাত্রাপালা শেষ করে রাতে বাড়ি ফিরছিলাম। পথে হঠাৎ চোখে পড়ল একদল মানুষের জমায়েত। কেউ একজন কিস্‌সা গাইছেন আর সবাই তা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনছেন। আমিও বসে পড়লাম সেই আসরে।’ মুগ্ধ হয়ে তিনিও কিস্‌সা শুনলেন। ভক্ত বনে গেলেন সুরে সুরে কিস্‌সা বলতে থাকা সেই শিল্পীর। অনুষ্ঠান শেষে পরিচিত হলেন তাঁর সঙ্গে। জানতে পারলেন শিল্পীর নাম জয়নাল আবেদিন। বাড়ি জয়পুরহাট জেলার পাঁচবিবি উপজেলায়।

কিস্‌সা বলার অভিনব উপায়ে তিনি যেন নিজেকে মঞ্চে দেখতে পেলেন। তাই তো দিন কয়েক বাদেই কিস্‌সা গাওয়ার তালিম নিতে ছুটে গেলেন জয়নাল আবেদিনের বাড়িতে। টানা ১১ দিন থাকলেন ওস্তাদের বাড়িতে। সেখানে নানা বইপত্রও পড়লেন। গানে ও নাচের তালে কিস্‌সা বলা রপ্ত করে ফিরে এলেন নিজ গ্রাম রামরায়পুরে। বন্ধু দুলাল, আবুল কাশেম, রাজ্জাক, হাবিবুর রহমানসহ আরও দুজনকে নিয়ে গড়লেন কিস্‌সার দল। সাইদুল বললেন, ‘আমার দলের সদস্যসংখ্যা এখনো সাতজনই।’

সাইদুল হলেন তাঁর লোকনাট্যদলটির মূল গায়েন। হারমোনিয়াম কাঁধে নিয়ে কিস্‌সা গাইতে থাকেন তিনি। আর দলে বাকিদের বলা হয় দোহার। তাঁরা পেছনে বসে গায়েনের কিস্‌সার তালে বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র বাজান। হারমোনিয়াম ছাড়াও বাঁশি, খঞ্জন, ঢোল, তবলা, কার্নেট, কঙ্গ ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করে থাকেন তাঁরা।

শুরুর দিকে নিজ গ্রাম আর এর আশপাশের কয়েকটি গ্রামে কিস্‌সা বলতে যেতেন সাইদুল ও তাঁর দল। ষাটোর্ধ্ব এই শিল্পী জানালেন, সে সময় পুরো রাত কিস্‌সা পরিবেশনের বিনিময়ে সম্মানী পেতেন মাত্র ৬০ টাকা। আর বর্তমানে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সাইদুলের ডাক পড়ে। ভারতেও একাধিকবার কিস্‌সা পরিবেশন করে এসেছেন সাইদুল। আর পারিশ্রমিকও বেড়েছে বহুগুণ। বর্তমানে তাঁর সম্মানী ৪০ হাজার টাকা। ঈদ, পূজা, পয়লা বৈশাখসহ বিভিন্ন ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কিস্‌সা পরিবেশনের আমন্ত্রণ পান সাইদুল।

সাইদুল বলছিলেন, ‘কিস্‌সা গাওয়াই আমার একমাত্র নেশা ও পেশা। কিস্‌সা গাওয়ার বাইরে আর কোনো পেশার কথা ভাবিনি।’ জানালেন, তাঁর প্রায় চার শ কিস্‌সার অ্যালবাম প্রকাশিত হয়েছে। ইউটিউবেও তাঁর কিস্‌সার ভিডিওগুলোও বেশ জনপ্রিয়।

সাইদুলের পাঁচ সন্তান। দুই ছেলে আর তিন মেয়ে। সাইদুলের সন্তানেরা কেউই কিস্‌সার সঙ্গে যুক্ত না হলেও স্ত্রী সুরাইয়া ইসলাম যুক্ত আছেন তাঁর কিস্‌সার দলে। সুরাইয়াও একসময় যাত্রাদলে নিয়মিত অভিনয় করতেন। গান-বাজনাতেও পারদর্শী সাইদুলপত্নী। মঞ্চে দোহারের ভূমিকায় বসে বাদ্যযন্ত্র বাজান আর আবহ সংগীত দেন তিনি। আর পর্দার পেছনে দলের পোশাকের নকশা আর মেকআপের দায়িত্বটিও রয়েছে তাঁর কাঁধে।

জীবনের বেশির ভাগ সময় কিস্‌সার পেছনে দিয়েছেন সাইদুল। এ নিয়ে কি তাঁর কোনো আফসোস আছে? প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এই পেশা থেকে অনেক মানুষের ভালোবাসা আর সম্মান পেয়েছি। তবে কষ্টের ব্যাপার হলো, নতুন প্রজন্মের কেউই কিস্‌সায় আগ্রহী নয়। আমি মারা যাওয়ার পর আর কেউ এটি ধরে রাখবে কি না, তা–ও জানি না।’