নিঃসঙ্গ যাত্রা

বান্দরবানের পাইক্ষংপাড়ার সেই দোকান
বান্দরবানের পাইক্ষংপাড়ার সেই দোকান
জুয়েল দেব
জুয়েল দেব

দোকানের যে অবস্থা তাতে এটাকে দোকান বলে চালানোই কষ্টকর। বৃদ্ধার দোকানে শুধু চা পানের বন্দোবস্ত আছে, আর কিছু নেই। আর একটা মূল্যবান জিনিস আছে, যেটা এই এত উঁচু পাহাড়ে রীতিমতো দুষ্প্রাপ্য। মাটির পাত্রভর্তি ঠান্ডা পানি।

 বৃদ্ধা আমাদের বললেন, ‘চা দিতে পারব। তবে নিজে বানিয়ে খেতে হবে। আমি চোখে দেখতে পাই না।’ বৃদ্ধা দোকানের ভেতর গুড় গুড় করে হেঁটে চলেন এপাশ থেকে ওপাশে। আমরা আটজন মুহূর্তেই মাটির পাত্রের সবটুকু ঠান্ডা পানি শেষ করে ফেলি। হঠাৎ রান্নাঘর থেকে বের হয়ে ছোট্ট একটা ছেলে মাটির
পাত্র নিয়ে কোথায় যেন এক দৌড়ে চলে গেল। বৃদ্ধা হেসে বললেন, ‘আমার নাতি। ও দৌড়ে দৌড়ে সব করে দেয়। আমি তো কিছু দেখতে পাই না।’

এত ছোট ছেলে চা বানাতে পারবে না বলে আমরা সবাই রান্নাঘরে ঢুকে যাই। রান্নাঘর মানে একটা বেড়া দিয়ে আলাদা করা একটা অংশ। সেটার পেছন দিক পুরোটাই খোলা। বৃদ্ধা আমাদের সামনে এসে ভাঙা ভাঙা বাংলায় বলেন, ‘তোমাদের ছায়া ছায়া দেখছি। তোমরা আছ সেটা বুঝতে পারছি। কিন্তু তোমাদের নাক–চোখ–মুখ আলাদা করে দেখতে পাচ্ছি না। বুঝতে পারলাম চোখে ছানি পড়ে যাওয়াতে বৃদ্ধার কাছে আমরা একেকজন সাদা-কালো ছবি হয়ে গেছি। যার সাদা-কালো রংগুলো লেপ্টে যাওয়াতে নাক–চোখ–মুখ সব সমান হয়ে গেছে।

 পাত্রের পানি শেষ হয়ে গেলে বৃদ্ধার নাতি আবার খালি পাত্রটা নিয়ে দৌড়ে হারিয়ে যায় জঙ্গলের ভেতর। তারপর কোথা থেকে যেন সেটা পূর্ণ করে নিয়ে আসে। বৃদ্ধা বলেন, ‘বয়স কম থাকতে সারা দিন জুমে কাটিয়েছি। সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে বাঁশকোড়লের তরকারি দিয়ে ভাত খেয়ে বেরিয়ে পড়তাম। সূর্য ডোবার আগে ফিরে আসতাম। এখন চোখে দেখি না, তাই জুমে যেতে পারি না। কিন্তু ঘরে বসে থেকে কী করব! এই পাহাড়ের গন্ধ না শুঁকতে পারলে আমি কবেই মরে ভূত হয়ে যেতাম।’

 পাইক্ষংপাড়া থেকে আমরা হেঁটে রওনা দিয়েছিলাম দুপুরের মধ্যেই রোয়াংছড়ি পৌঁছাব বলে। মাঝপথে নিঃসঙ্গ বৃদ্ধার মতো নিঃসঙ্গ এই দোকানটি আমাদের কিছুক্ষণ আটকে রাখে শহরের পথে যাত্রার দীর্ঘ সময়টাতে। চা খাওয়া শেষ হয়ে যাওয়ার পরও দোকানের ভেতরে বাঁশের মাচায় আমরা স্থির বসে থাকি। পাহাড়ের নিস্তব্ধতা আমাদের স্থানুর মতো নিশ্চল করে রাখে। বৃদ্ধা হাতড়ে হাতড়ে খালি কাপগুলো নিয়ে যান আমাদের সামনে থেকে। দীর্ঘ রাস্তায় পানির প্রয়োজন হবে বলে আমরা মাটির পাত্র থেকে পানি নিয়ে আমাদের ফ্লাস্কগুলো পূর্ণ করি। বৃদ্ধা হেসে বলেন, ‘পানি নিয়ে যাও। অনেক রাস্তা হাঁটতে হবে।’

বৃদ্ধার নাতি খালি পাত্র নিয়ে আবার দৌড়ে হারিয়ে যায় জঙ্গলে।