যাঁর কাছে শিখলেন, তাঁকেই হারালেন

>মুফরাদুলের জাতীয় টেবিল টেনিস (টিটি) দলে ঢোকার পেছনে বড় অবদান পাঁচবারের জাতীয় চ্যাম্পিয়ন মানস চৌধুরীর। ছয় বছর ধরে মানস কোচিং করিয়েছেন মুফরাদুলকে। সেই মানসকেই গত সপ্তাহে ফেডারেশন কাপের পুরুষ এককের ফাইনালে হারিয়ে দেন মুফরাদুল।
শিষ্যের জয়েই তো গুরুর জয়! কোচ মানস চৌধুরীকে (পেছনে) হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন কাপ হাতে তুলে নিয়েছেন শিষ্য মুফরাদুল।
শিষ্যের জয়েই তো গুরুর জয়! কোচ মানস চৌধুরীকে (পেছনে) হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন কাপ হাতে তুলে নিয়েছেন শিষ্য মুফরাদুল।

মাস শেষে বন্ধুরা যখন ফোন করে বাবার কাছে টাকা চান, মুফরাদুল খায়ের হামজা তখন থাকেন নিশ্চিন্তে। কয়েক বছর ধরে মাস ঘুরতে না–ঘুরতেই মুফরাদুলের ব্যাংক হিসাবে জমা হচ্ছে নগদ অর্থ। বাংলাদেশ আনসার থেকে মাসিক বেতন পাচ্ছেন। রাজধানীর ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকে পড়ছেন কম্পিউটারবিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিষয়ে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিনা বেতনে পড়ার সুযোগ দিয়েছে মুফরাদুলকে। এর সবকিছুই সম্ভব হয়েছে টেবিল টেনিস (টিটি) খেলার সুবাদে।

ক্রিকেটার বা ফুটবলার হওয়ার স্বপ্নে অন্যরা যখন বিভোর থেকেছেন, মুফরাদুল বেছে নিয়েছেন টিটি খেলা। চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লায় বাড়ির ঠিক পাশেই নবীন মেলা ক্লাব। সেই ক্লাবে বড় ভাইয়েরা নিয়মিত টিটি খেলতেন। বাড়িতে সব সময় পাওয়া যেত না ভাইদের। মা প্রায়ই বকাবকি করতেন। বড় দুই ভাইকে ডেকে আনার দায়িত্ব পড়ত সবার ছোট মুফরাদুলের। ভাইদের দেখেই টিটির প্রতি আগ্রহ বাড়ে। আর ক্লাবের সভাপতি জামাল উদ্দিন বাবুও স্নেহ করতেন মুফরাদুলের। টিটি খেলোয়াড় হওয়ার পেছনে অবদান আছে এই ক্লাব কর্মকর্তার। তবে মুফরাদুলের জাতীয় দলে ঢোকার পেছনে বড় অবদান টিটিতে পাঁচবারের জাতীয় চ্যাম্পিয়ন মানস চৌধুরীর। চট্টগ্রামের এই খেলোয়াড় প্রথম দেখাতেই জহুরির চোখে বেছে নেন মুফরাদুলকে। ছয় বছর ধরে মানস কোচিং করিয়েছেন মুফরাদুলকে। সেই মানসকেই গত সপ্তাহে ফেডারেশন কাপের পুরুষ এককের ফাইনালে হারিয়ে দেন মুফরাদুল। শিষ্যের কাছে গুরুর এমন হারেও উচ্ছ্বসিত মানস, ‘ও খুবই সম্ভাবনাময় খেলোয়াড়। ভবিষ্যতে ধারাবাহিকতা ধরে রাখলে অনেক দূর যেতে পারবে।’

 ফেডারেশন কাপের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার সুবাদে জাতীয় দলে সরাসরি ঢুকে গেছেন মুফরাদুল। গত ডিসেম্বরে মুফরাদুলের র‌্যাঙ্কিং ছিল ১১। এক ধাপে সেটা তিনে উঠে এসেছে। এর মানে হচ্ছে, অবধারিতভাবে জাতীয় দলের খেলোয়াড় মুফরাদুল।

চট্টগ্রাম কদম মোবারক সিটি করপোরেশন হাইস্কুলে পড়ার সময় অনূর্ধ্ব-১৩ ও অনূর্ধ্ব-১৭ পর্যায়ের স্কুল টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন। গত বছর বঙ্গবন্ধু আন্তবিশ্ববিদ্যালয়ের টিটিতে ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়কে সোনার পদক উপহার দিয়েছেন। এর আগে ২০১৪ সালে জাতীয় জুনিয়র চ্যাম্পিয়নশিপের সেমিফাইনালে ওঠেন। গত বছর র‌্যাঙ্কিং টুর্নামেন্টের সেমিফাইনালে সাবেক জাতীয় চ্যাম্পিয়ন মাহবুব বিল্লাহর কাছে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের পর হেরেছেন। দেশের বাইরে খেলেছেন পাকিস্তানে দক্ষিণ এশিয়ান টিটি চ্যাম্পিয়নশিপে, ভারতে আমন্ত্রণমূলক উন্মুক্ত টিটিতে। সিনিয়রদের হারিয়ে কোনো জাতীয় টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হবেন সেটা কখনোই ভাবেনি মুফরাদুল। অথচ এবার চ্যাম্পিয়নদের হারিয়ে জিতে নিয়েছেন শিরোপা।

আট বছর আগে প্রথম ঢাকায় আসেন মুফরাদুল। আগে খেলতেন চট্টগ্রামের বদ্ধঘরে। কিন্তু প্রথম উডেনফ্লোর জিমনেসিয়ামে ঢোকার পর মুফরাদুল বিস্ময়ে হাঁ হওয়ার জোগাড়, ‘এ আমি কোথায় এলাম? এত উঁচু, এত বড় আর এত আলোর মধ্যে খেলব? এর ওপর জিমজুড়েই এসি লাগানো।’         

বিস্ময়ের ঘোর কাটতে বেশি দিন লাগেনি। জাতীয় দলের যেসব খেলোয়াড়ের সঙ্গে আগে একটা ছবি তুলতে পারলেই চট্টগ্রামে বন্ধুদের গিয়ে দেখাতেন, তাঁরাই এখন তাঁর সতীর্থ। গত ডিসেম্বরে এসএ গেমসের দলে সুযোগ পাননি মুফরাদুল। সেই দুঃখটা এখনো ভুলতে পারেননি, ‘এর এসএ গেমসের ক্যাম্পে ডাক পাইনি। ফেডারেশন র‌্যাঙ্কিংয়ের সেরা আটজনকে ক্যাম্পে রাখে। আমার র‌্যাঙ্কিং তখন ছিল এগারো। পরীক্ষার কারণে খেলতে পারিনি, এ জন্য র‌্যাঙ্কিং পিছিয়ে যায়। অন্যরা যখন দুই বেলা ক্যাম্প করত, তখন আমি ইনডোরে বসে কাঁদতাম। এমনও হয়েছে বাথরুমে গিয়ে চোখ ধুয়ে আসতাম।’

বাবা আবুল খায়ের চট্টগ্রামের মুদিদোকানি। বাবার কাছ থেকে কোনো টাকাপয়সা নেওয়া লাগে না। এতেই খুশি মুফরাদুল, ‘আমরা ভাড়া বাড়িতে থাকি। বড় ভাই টিউশনি করতেন। ইদানীং চাকরি হয়েছে। কিন্তু আমি খেলাধুলার জন্য টাকা পাই। বিশ্ববিদ্যালয় কোনো বেতন নেয় না। বন্ধুরা যখন এক সেমিস্টারে ৫৫ হাজার টাকা দেয়, তখন আমি রোল নম্বর বললেই বিনা বেতনের রসিদ দিয়ে দেয়। আমার মতো মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলের জন্য এটা একটা বড় প্রাপ্তি।’

অন্তর্মুখী স্বভাবের মুফরাদুল বন্ধুদের কাছেও নিজের সাফল্যটা বলতে চান না। তবে বোনের শ্বশুরবাড়িতে গেলে সবাই তাঁকে প্লেয়ার বলেই ডাকেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার মাঝেমধ্যেই খেলার চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন মুফরাদুলকে। দেশের অন্যতম অপ্রচলিত একটা খেলার সুবাদে টাকা পাচ্ছেন, বিনা বেতনে পড়ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ে। টিটি খেলে তাই দেশকে বড় একটা সাফল্য উপহার দেওয়ার স্বপ্ন দেখেন মুফরাদুল, ‘আমি আজ ঢাকায় পড়াশোনা করছি, নিজের হাতখরচ চালাচ্ছি, সব কিছুই টিটি খেলি বলে। মাঝেমধ্যে মনে হয়, আমার কাঁধে অনেক বড় দায়িত্ব। বিশ্ববিদ্যালয়ের মুখ উজ্জ্বল করতে চাই টিটি খেলে, পাশাপাশি এসএ গেমসেও সোনা জিতে সবার এই ভালোবাসার দায়টা শোধ করতে চাই।’