প্রযুক্তিনির্ভর কৃষিব্যবস্থা আজ সময়ের দাবি

কৃষিপ্রধান আমাদের এই দেশে, ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে প্রযুক্তিনির্ভর কৃষিব্যবস্থা আজ সময়ের দাবি। উন্নত বিশ্বের দেশগুলো ইতিমধ্যে আধুনিক মেশিন ও বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে কৃষিকাজ করে সফলতা অর্জন করছে। নিজেদের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি কৃষিপণ্য বিদেশে রপ্তানি করে তারা এখন বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে। বাংলাদেশেও এর সূচনা হয়েছে।

মো. আনিসুজ্জামান ময়মনসিংহের একটি উচ্চবিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক। অবসরের পরপরই তিনি সিদ্ধান্ত নেন নিজ গ্রামে কৃষিকাজ শুরু করবেন। কিন্তু ধান কাটার সময় শ্রমিকের সংকট, অধিক উৎপাদন খরচ, আশানুরূপ ফলন না পাওয়া ইত্যাদি কারণে তিনি সফলতা পাচ্ছিলেন না। পরে প্রথম আলোর মাধ্যমে তিনি মেশিন ও প্রযুক্তিনির্ভর কৃষিকাজের ব্যাপারে জানতে পারেন। নতুন করে আবার সরকারের ভর্তুকি নিয়ে তিনি একটি কোম্পানি থেকে রিপার কেনেন। কিন্তু যথাযথ প্রশিক্ষণের অভাব, সার্ভিসিং, কোম্পানির অসহযোগিতায় তিনি আবারও ব্যর্থ হন।

এবার মো. আনিসুজ্জামান শেষ চেষ্টাসরূপ ২০১৮ সালের বোরো চাষের আগে ধানের চারা রোপণের জন্য সরকারি ভর্তুকিতে এসিআই মটরস থেকে একটি ইয়ানমার রাইস ট্রান্সপ্লানটার নেন। এই মেশিন চালানোর জন্য তিনি প্রথম যে সমস্যার সম্মুখীন হন, তা হলো চারা তৈরি। কিন্তু এসিআই থেকে একজন প্রতিনিধি গিয়ে চারা তৈরির বিষয়টাতে প্রশিক্ষণ, সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধান এবং চারা রোপণের সময় সার্বিক সহায়তা প্রদান করেন। সেই সময় ও পরবর্তী সময়ে আমন চাষের সময় এসিআইয়ের লোকজনের সহায়তায় তিনি মেশিনের মাধ্যমে ধানের চারা রোপণ করেন।

মো. আনিসুজ্জামান নিজের জমির পাশাপাশি অন্যদের জমির জন্য চারা তৈরি ও রোপণের মাধ্যমে সরাসরি আয়ের মুখ দেখছেন। রাইস ট্রান্সপ্লান্টের মাধ্যমে চারা রোপণ করলে একরপ্রতি সময় লাগে দুই ঘণ্টা সেখানে শ্রমিক দিয়ে করলে চারজনের এটিই লাগবে সারা দিন। খরচের ক্ষেত্রেও ট্রান্সপ্লান্টের মাধ্যমে করলে চারা ছাড়া খরচ হবে ২ হাজার ৩০০ টাকা শ্রমিকের মাধ্যমে করলে তা হবে ৪ হাজার টাকা। একরপ্রতি প্রায় ১ হাজার ৭০০ টাকা সাশ্রয় হবে মেশিনের মাধ্যমে করলে।

রাইস ট্রান্সপ্লান্টের সাফল্যের পর এসিআই মটরসের প্রতিনিধিদের পরামর্শে মো. আনিসুজ্জামান এবার ইয়ানমার কোম্পানির একটি কম্বাইন্ড হারভেস্টর নেওয়ার সাহস করলেন। কম্বাইন্ড হারভেস্টারের মাধ্যমে খেতেই একটি মেশিনের সাহায্যেই ধান কাটা থেকে শুরু করে ধান মাড়াই, ঝাড়া হয়ে একদম বস্তাবন্দী হয়ে বিক্রির জন্য তৈরি হয়ে যাই। এ পুরো প্রক্রিয়াটিই হয় একটি মেশিনের মাধ্যমে এবং এতে সময় লাগে মাত্র একরপ্রতি দেড় ঘণ্টা। শ্রমিক দিয়ে করলে যা বেশ সময়ের ব্যাপার। খরচের ক্ষেত্রেও মেশিনে খরচ একরপ্রতি ২ হাজার ৫০০ টাকা, শ্রমিকের ক্ষেত্রে তা সাড়ে ১০ হাজার টাকা। এ মেশিনের মাধ্যমে কৃষকেরা শুধু নিজের জমি বাদেও অন্যদের ভাড়া দিয়েও চাষের সময় একরপ্রতি পাঁচ হাজার টাকা লাভ করতে পারেন। এই মেশিনের ছয়টি সেন্সর রয়েছে, যা মেশিনের কোনো ধরনের সমস্যা হওয়ার আগেই সতর্ক করে।

মো. আনিসুজ্জামান সাহেবের দেখাদেখি গ্রামের অন্যান্য কৃষকেরাও এখন মেশিননির্ভর চাষে আগ্রহী হচ্ছে। তারা মেশিন ভাড়া করে তাদের জমিতেও এখন যন্ত্রনির্ভরভাবে কৃষিকাজ করছেন। আরেকজন কৃষকের সঙ্গে কথায় তিনি বললেন , ‘মেশিনের মাধ্যমে চাষে শ্রমিক খরচ কম, সময় কম এবং ফলনও বেশি হয়।’ অনেকেই এখন মেশিনের মাধ্যমে চাষে আগ্রহী হচ্ছে। কৃষকের অর্থনৈতিক অবস্থার কথা চিন্তা করে এসিআই মটরস টাকা পরিশোধের ক্ষেত্রে কিস্তিরও ব্যবস্থা করেছে।

তরুণ প্রজন্ম এগিয়ে আসুক এই নতুন প্রযুক্তিনির্ভর কৃষিব্যবস্থায়। বৈজ্ঞানিক উপায়ে কৃষিকাজের মাধ্যমে দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠুক। কৃষকেরা দেখুক লাভের মুখ।