রাজিনের পাকা পাকা কথা

অলংকরণ : তুলি
অলংকরণ : তুলি

রাজিনকে আমি ‘পিচ্চি’ ডাকি। কত আর ওর বয়স? এই মাসে সাতে পড়ল। ক্লাস ওয়ান থেকে এবার ক্লাস টুতে উঠেছে। খুব বুদ্ধিমান ছেলে রাজিন। ‘পিচ্চি’ বললে খুব মাইন্ড করে। বলে, ‘আমাকে পিচ্চি বললা কেন? আমি কি পিচ্চি? আমি এখন লম্বা।’

‘তাহলে কী বলে ডাকব তোমাকে?’

‘কেন, রাজিন বলে। রাজিন আমার নাম।’

‘না। তোমার অন্য একটা নাম দিতে চাই।’

‘কী নাম দিবা?’ উৎসুক হয়ে জানতে চায় রাজিন।

আমি বলি, ‘আর্কিমিডিস।’

‘এটা আবার কেমন নাম!’ নামটা একেবারেই পছন্দ হলো না রাজিনের।

‘তাহলে ডাইনোসর বলে ডাকি তোমাকে।’

‘ধুর! ওটা তো একটা প্রাণীর নাম। একসময় ছিল। এখন নেই, হারিয়ে গেছে।’

‘এত কিছু জানো তুমি?’

‘হুঁ।’ হাত নাড়িয়ে নাচতে নাচতে বলল রাজিন, ‘টিভিতে কত ডাইনোসর দেখেছি।’

‘তাহলে কোন নামে ডাকব?’

‘কোনো নামে ডাকতে হবে না। আমি রা–জি–ন। এই নামেই ডাকবা।’

তারপরও মনে মনে ওর নাম দিয়েছি সক্রেটিস। কারণ, রাজিন অনেক কৌতূহলী। আর ও সারাক্ষণ ছটফট করে। ওর নানা রকম প্রশ্ন। আমি সময় পেলে ধৈর্য না হারিয়ে জবাব দিতে থাকি।

রাজিনকে একদিন বললাম, ‘শিশুদের অধিকার সবচেয়ে বেশি।’

রাজিন বলল, ‘আমি তো শিশু। তাহলে আমার অধিকার বেশি।’ বলেই সে ফ্রিজ খুলে সব বের করল। টিভি চালিয়ে দিল। আমার লেখার খাতা উল্টে দিল। আমার ঢোলা স্যান্ডেলটা পায়ে পরল। আর বলতে লাগল, ‘আমি শিশু। আমার অধিকার সবচেয়ে বেশি। কেউ আমাকে কিছু বলবা না।’

আমরা রাজিনকে কিছু বলি না। একদিন ওর সঙ্গে গল্প করতে করতে বলি, ‘যারা নতুন কিছু করতে চায়, তারা বড় হয়।’

‘যেমন?’ প্রশ্ন করে রাজিন।

‘যেমন কেউ ভালো ফুটবল খেলে। কেউ গল্পের বই পড়ে মনে রাখতে পারে। কেউ গান গাইতে পারে। কেউ নাচতে পারে। এই সব আরকি।’

‘এসব যারা পারে, তুমি কি তাদের খুব লাইক করো?’

আমি তখন লিখছিলাম। ছোট্ট করে বললাম, ‘হ্যাঁ।’

রাজিন আবার শুধাল, ‘কী লিখছ?’

আমি লিখেই চলেছি। রাজিন তখন নিজেই বলল, ‘বুঝেছি, লেখা শেষ হলে লেখাটার নাম দিবা। আর কী যে লিখছ, তুমি নিজেও জানো না।’

আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম রাজিনের দিকে। এত্তটুকুন পিচ্চি, কিন্তু কত বুদ্ধি! পরদিন রাজিন ওরিগামি বানিয়ে আনল। নৌকা, পাখি, লাফ দেওয়া ব্যাঙ, প্লেন—নানা কিছু। একদম নিখুঁত ভাঁজ দিয়ে বানিয়েছে। আমি খুব অবাক। এগুলো শিখল কোত্থেকে!

রাজিন বলল, ‘কম্পিউটারে।’

‘একবার দেখেই বানিয়ে ফেললা?’

‘তো? কয়বার দেখব?’

‘তো’ বলাটা রাজিনের অভ্যাস। এই ছোট্ট শব্দটা দিয়ে সে অনেক কিছু বোঝাতে পারে।

‘এখন তুমি নিশ্চয়ই আমাকে লাইক করবা? আমিও তো আলাদা কিছু পারি। তাই না, কাক্কা?’

আমি বললাম, ‘নিশ্চয়ই। তোমার এই ওরিগামি বানানো দেখে আমি ভীষণ খুশি। তোমাকে আমি পুরস্কার দেব। কী চাও তুমি?’

রাজিন সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল, ‘সাইকেল।’

আমি বললাম, ‘ওকে।’

রাজিন থাকে দোতলায়। আমি একতলায়। রাজিন আমার ছোট ভাইয়ের ছেলে। ওর সবচেয়ে প্রিয় কাক্কা আমি। যখনই আমি বাসায় ফিরি কিংবা বাসা থেকে বের হই, তখনই ও এসে ঘুরঘুর করে। নানা প্রশ্ন করে। সাত বছর বয়স। কিন্তু ওর প্রশ্ন শুনে মনে হয় ও আমার অভিভাবক।

সেদিন বলল, ‘তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরবা। কেন তুমি দেরি করো? কী করো এত?’

এমন প্রশ্ন এই জীবনে কেউ আমাকে করেনি। আমি খুব স্বাধীন মানুষ। নিজের মতো চলি। নিজের মতো কাজ করি।

রাজিনের দুরন্ত প্রশ্নে তাই কিছুটা ধাক্কা খাই। তারপর স্নেহের উত্তাপে ওকে জড়িয়ে ধরি।

বাসায় ফেরার সময় প্রতিদিন ওর জন্য কিছু না কিছু কিনে আনি। মিষ্টিজাতীয় জিনিস ও বেশি পছন্দ করে না। চিকেন ফ্রাই, চিকেন টিক্কা, চিকেন গ্রিল, চিকেন নাগেট—ওর পছন্দ এ–জাতীয় খাবার। ও যা পছন্দ করে, আমিও সেভাবেই ওর সঙ্গে চলি। কারণ, ও জানে, শিশুর অধিকার পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি।

দুই.

আমাদের বাসায় দুজন রবিন আছে। একজন ড্রাইভার রবিন, ও নোয়াহ্ মাইক্রোবাস চালায়। আরেকজন আমাদের বাসার পাহারাদার। ও আসে সন্ধ্যার পর।

সেদিন রাতে রাজিনের জন্য নুডলস ও পাস্তা রান্না করলাম আমি। পাস্তা রাজিনের খুব পছন্দ। খেতে খেতে ও আমাকে নানান প্রশ্নে জর্জরিত করতে লাগল।

‘কাকা, তুমি এত জোরে জোরে ধমক দিয়ে ওদের সঙ্গে কথা বলো কেন?’

আমি চুপ। কোনো উত্তর জানা নেই।

‘কাক্কা, তুমি মোবাইলে খালি দাবা খেলো কার সাথে?’

‘কারও সাথে না। আমি দাবা খেলা দেখি। বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন জিয়া এখন মুম্বাইয়ে টুর্নামেন্টে খেলছে। ওর খেলা দেখছি।’

‘ও...।’

আমার উত্তর ওর কাছে খুব অর্থহীন মনে হলো হয়তো। কাছে এসে বলল, ‘তোমার গেঞ্জিটা গন্ধ হয়ে গেছে! কত দিন ধোও না?’

আমি বললাম, ‘সাত দিন।’

‘ইশশশ...!’ নাকে হাত দিল রাজিন, ‘কী নোংরা তুমি!’

‘নোংরা থাকাই ভালো। যাও, রবিনকে ডাক দাও।’

রাজিন ঝটপট জানতে চাইল, ‘কোন রবিন আংকেল?’

আমি বললাম, ‘ড্রাইভার।’

রাজিন সঙ্গে সঙ্গে ওর ড্রাইভার আংকেলকে ডেকে আনল।

এবার আমি রাজিনকে বললাম, ‘বলো তো, দুই রবিনের মধ্যে পার্থক্য কী কী?’

রাজিন এবার হাত–পা নাড়িয়ে খুব উদাসীন ভঙ্গিতে বলল, ‘খুব বেশি পার্থক্য নাই। তবে একজন মোটা। আরেকজন পাতলা।’

‘আর কী পার্থক্য?’

‘একজনের চুল বেশি, আরেকজনের চুল কম। একজন লম্বা, আরেকজন বেঁটে। একজন কালো, আরেকজন ফরসা। আর একজন জোরে কথা বলে, আরেকজন আস্তে আস্তে কথা বলে।’

‘আর?’

‘একজন খায় বেশি, আরেকজন কম খায়।’ বলেই রাজিন হাসতে থাকে।

‘আর?’

‘তুমি খালি আর আর করছ! আর কোনো পার্থক্য নাই।’

‘আছে, ভেবে বলো।’

‘একজনের গোঁফ আছে, আরেকজনের নাই। একজন জোরে জোরে হাসে, আরেকজন আস্তে আস্তে হাসে।’

‘আর কোনো পার্থক্য?’

এবার ঘাড় চুলকাতে লাগল রাজিন। ও ছটফট করছে। অস্থিরতা প্রকাশ করে বলল, ‘কাক্কা, যাই একটু সাইকেল চালিয়ে আসি রাস্তায়।’

‘এখনই কেন?’

‘একটু পর ম্যাডাম আসবে পড়াতে। তারপর পড়তে বসব।’

‘কিন্তু আর কোনো পার্থক্য?’

‘তোমার মাথা আমার মুন্ডু। কোনো পার্থক্য নাই।’

‘কেন?’

রাজিন হাসতে হাসতে বলল, ‘ওরা তো মানুষ। মানুষে মানুষে পার্থক্য নাই। মানুষ আর পশুতে পার্থক্য আছে।’

‘ওরে বাবা! এত ভারি ভারি কথা জানলি কোথা থেকে?’

রাজিন টেলিভিশনের দিকে আঙুল তুলে দেখাল। তারপর একছুটে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।