টোপনের হাত ধোয়া

অলংকরণ: আরাফাত করিম
অলংকরণ: আরাফাত করিম

টোপনের বাবা হঠাৎ বদলি হয়ে গেলেন। ঢাকা থেকে সবাইকে নিয়ে চলে এলেন মফস্বল শহরের নতুন কর্মস্থলে। প্রথম কিছুদিন টোপনের ভারি মন খারাপ হয়েছিল, কিন্তু বিশাল স্কুলটা দেখে মন খারাপ ভাব খানিকটা কেটেছে। স্কুলের সামনের বড় মাঠটায় ইচ্ছেমতো খেলাধুলা করে ভালোই সময় কেটে যাচ্ছিল ওর।

টোপনের মা–ও প্রথম দিকে ঢাকায় ফিরে যাওয়ার কথা বলছিলেন, কিন্তু যেদিন থেকে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার খবর শুনলেন, সেদিন থেকে মা আর ঢাকায় ফিরে যাওয়ার কথা মুখেও তুললেন না। একদিন খেতে খেতে বাবাকে বললেন, ‘জীবনে এই প্রথম মফস্বলে এসে একটা ভালো সিদ্ধান্ত নিলে।’

টোপনের বাবা মাথা নেড়ে এমন একটা ভাব করলেন, যেন তিনি সব আগে থেকেই জানতেন। টোপনের খুব হাসি পেয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু হাসলে কানমলা খেতে হতে পারে ভেবে হাসিটা চেপে গেল। টোপনের স্কুলের ক্লাস টিচার সাইদুর রহমান। নতুন জয়েন করেছেন। এটাই প্রথম চাকরি। ফলে সবকিছুতেই তার ভারি উৎসাহ। ‘বসন্ত উৎসব’ নাম দিয়ে তিনি একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজনও করে ফেলেছেন। সবাইকে কিছু না কিছু সেখানে করে দেখাতে হবে।

অনুষ্ঠানে টোপন কী করবে? কদিন ধরে অনেক ভেবেও সে কিছু বের করতে পারল না। মেডিকেল কলেজে পড়া বড় বোন সুমনার আশপাশে দুদিন ঘুরঘুর করল। তৃতীয় দিনের দিন সুমনা তার মেডিকেলের বই থেকে মাথা না তুলেই বলল, ‘তুই একটা হলুদ রঙের কোলা ব্যাঙ সাজ। মঞ্চের এক পাশ থেকে ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর করে লাফ দিয়ে মঞ্চের আরেক পাশে যাবি। ভারি মজা হবে।’

টোপন খুব অপমানিত বোধ করল। বোন হোস্টেলে থেকে মেডিকেল কলেজে পড়ে; অনেক দিন পর বাড়ি এসেছে, কিছু বললে খারাপ দেখায়—এসব সাতপাঁচ ভেবে টোপন কিছু না বলে বোনের সামনে থেকে সরে গেল।

নির্দিষ্ট দিনে মঞ্চে অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে। স্কুলের মাঠে প্যান্ডেল করা হয়েছে। বাড়িতে কিছু করার নেই দেখে সুমনাও টোপনের সঙ্গে স্কুলে চলে এসেছে। প্রধান শিক্ষক আর আমন্ত্রিত অতিথিদের বক্তৃতা শেষ হয়ে গেলে মূল অনুষ্ঠান শুরু হলো। অভিনয়, গান আর কবিতা আবৃত্তির পর সাইদুর রহমান স্যার ঘোষণা দিলেন, ‘এবার মঞ্চে আসবে ষষ্ঠ শ্রেণির টোপন।’

সুমনা দর্শকসারিতে বসে দেখল, টোপন একটা মগ, গামলাভর্তি পানি আর তোয়ালে নিয়ে মঞ্চে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। সুমনা প্রথমে ভাবল, একক অভিনয় হবে, কিন্তু টোপন মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আমি আপনাদের দেখাব কীভাবে হাত ধুতে হয়।’

দর্শকসারিতে হাসির রোল পড়ে গেল। সুমনা শুনল, আশপাশ থেকে অনেকেই মুখ টিপে হেসে বলছে, ‘হাত ধোয়া নাকি শিখতে হয়! হি হি হি! এরপর নিশ্চয়ই ভাত খাওয়াও শেখাবে!’

সুমনা একেবারে শক্ত হয়ে বসে ভাইয়ের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মঞ্চে কী করা যায়, এমন একটা বুদ্ধির জন্য ভাইটা কদিন ধরে ঘুরঘুর করেছিল। কিন্তু ও পাত্তা না দিয়ে হাসাহাসি করেছে। ভাবতেই নিজেতে কেমন অপরাধী মনে হচ্ছে। টোপন ততক্ষণে মুখে বলছে আর সাবান–পানি দিয়ে কাজটি করে দেখাচ্ছে। 

‘প্রথমে পানি দিয়ে হাত ভেজান।

তারপর হাতের তালু ভরে সাবান নিন।

এক হাতের তালু দিয়ে অরেক হাতের তালু ভালোভাবে ঘষুন।

এক হাতের তালু দিয়ে অন্য হাতের উল্টো পিঠে এবং আঙুলের ফাঁকে আঙুল গলিয়ে ঘষুন।

এবার এক হাতের তালু আরেক হাতের তালুতে রেখে আঙুলের ফাঁকে আঙুল গলিয়ে ঘষুন।

এক হাতের প্রতিটি আঙুল অন্য হাতের মুঠোয় নিয়ে ভালো করে ঘষুন।

এক হাতের তালুতে অন্য হাতের আঙুলগুলোর মাথা ঘষুন।

এবার পানি দিয়ে হাত ভালো করে ধুয়ে নিন।’

টোপনের কথা শুনে সাইদুর রহমান স্যার সত্যি সত্যিই হাতে পানি ঢেলে দিলেন। হাত ধোয়া হলে টোপন কাঁধে রাখা তোয়ালেটা দিয়ে হাত মুছে বলল, ‘কারোনাভাইরাসের সংক্রমণ এড়াতে এভাবেই হাত ধুতে হয়।’

নাচ–গান শেষে যেমন অনেক তালি পড়ে, এবার অবশ্য তেমনটা হলো না; কিন্তু মেডিকেল কলেজে পড়া সুমনা তো জানে, আজকের সেরা পরিবেশনা টোপনই করেছে। বন্ধুদের বাহবা না পেয়ে টোপন যখন মাথা নিচু করে মঞ্চ থেকে নেমে যাচ্ছিল, সে সময় একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। সারা স্কুল দেখল, তাদের সবচেয়ে রাগী হেড স্যার চেয়ার থেকে উঠে এসে টোপনকে জড়িয়ে ধরছেন।

সুমনা আবিষ্কার করল, তার নিজের চোখে পানি এসে গেছে।