করুণ করোনা থেকে ঘুরে দাঁড়ানো এক পরিবার

দুর্বিষহ সময়ের মুখোমুখি হলে মানুষ যেমন দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে, তেমনি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন আবদুল হাকিম হাওলাদার। এই যুবক মাদারীপুরের শিবচর উপজেলায় প্রথম করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তি। তাঁর মাধ্যমে সংক্রমিত হয়েছিলেন পরিবারের আরও অনেকে। ৭ মে বিকেলে কিছুদিন আগের করুণ দিনগুলোর কথা হাকিমের মুখেই শুনতে থাকি, শুনি ঘুরে দাঁড়ানোর কথাও।

‘আমি যখন প্রথম করোনায় আক্রান্ত হই, তখনো বুঝিনি রোগের ভয়াবহতা কতটা। আমার সংস্পর্শে এসে একে একে সাতজন আক্রান্ত হয়। আত্মীয়স্বজনকে আক্রান্ত হতে দেখে ভীষণ দুচিন্তায় পড়ে যাই।’ বলেন আবদুল হাকিম হাওলাদার।

ইতালিপ্রবাসী আবদুল হাকিম দেশে ফিরেছিলেন মার্চ মাসে। দেশে ফেরার দিন কয়েক পরই অসুস্থ হন। তাঁর মধ্যে করোনা উপসর্গ দেখা দিলে নমুনা পরীক্ষা করা হয়। গত ১৩ মার্চ জানা যায়, তিনি করোনায় আক্রান্ত। শিবচরে প্রথম করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তিটি তিনিই। 

নিজে আক্রান্ত হওয়ার খবরের মধ্যেই আবদুল হাকিম হাওলাদার পেতে থাকেন দুঃসংবাদ। এক দিন পরই করোনা শনাক্ত হয় তাঁর স্ত্রী ও দুই সন্তানের। ১৭ মার্চ শনাক্ত হয় তাঁর শাশুড়ি ও এক বন্ধুর। ১৮ মার্চ হাকিমের বাবাকে অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে তাঁরও করোনা শনাক্ত হয়। এরপর তাঁর শ্বশুর আক্রান্ত হন।
তখন সারা দেশে মোট করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১৭, যার মধ্যে হাকিমের পরিবারেরই আক্রান্ত ৭ জন। 

হাকিমসহ পরিবারের অন্য সদস্যরা পর্যায়ক্রমে ছাড়পত্র নিয়ে বাড়িতে ফিরলেও ফিরে আসেননি হাকিমের বাবা। ২২ মার্চ উপজেলায় প্রথম মৃত্যুটা হয় তাঁর বাবার। হাকিম বলেন, ‘বাবার বয়স বেশি থাকায় তিনি প্রথম থেকেই অসুস্থ ছিলেন। কিন্তু বাবাকে হারাতে হবে, তা কল্পনাও করতে পারিনি। হাসপাতালে আমার চোখের সামনে বাবা ছটফট করতে করতে মারা গেলেন। কী থেকে কী করব দিশেহারা হয়ে পড়েছিলাম।’

২৫ মার্চ হাকিম স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরেন। নির্দেশনা মেনে বাড়িতে ১৪ দিনের কোয়ারেন্টিনে থাকেন তাঁরা। সে সময়ের কথা শুনছিলাম হাকিমের স্ত্রী নাসরিনের কাছে। তিনি বলেন, ‘বাড়িতে আসার পর প্রতিবেশীরা আমাদের অন্য দৃষ্টিতে দেখা শুরু করে। মানুষ নানা কথা বলে। তবু সহ্য করে গেছি। পরিস্থিতির কারণে কিছুই বলার ছিল না আমাদের।’

আক্রান্ত হলেন দ্বিতীয়বার

অসুস্থতার ধকল তো ছিলই, ছিল স্বজন হারানোর শোক। তবু ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে চাচ্ছিল পরিবারটি। কিন্তু হাকিমের পরিবারে করোনা আঘাত হানল দ্বিতীয়বার। হাকিমের স্ত্রী, দুই সন্তান ও শ্বশুর ও শাশুড়ির শরীরে আবার করোনার উপসর্গ দেখা দেয়। নমুনা পরীক্ষা করলে হাকিম ছাড়া ৫ জনের পজিটিভ আসে। তাঁদের ৫ এপ্রিল মাদারীপুর সদর হাসপাতালের আইসোলেশন ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়। এরপর ১৯ এপ্রিল তাঁরা দ্বিতীয়বারের মতো হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়ে বাড়ি ফেরেন। নাসরিন বলেন, ‘মনের মধ্যে কিছু আক্ষেপ, হারানোর যন্ত্রণা আর কষ্টের দিনগুলোর পরও এখন সবাই ভালো আছি, এটাই অনেক।’