গুপ্তধনের গুপ্তধাঁধা

ছবিটিতে একটি সাপ লুকিয়ে আছে। খুঁজে বের করতে বলেছে রুবাইয়্যাত হাসনাইন কেজি টু, পেডাগোজি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল, শ্যামলী, ঢাকা
ছবিটিতে একটি সাপ লুকিয়ে আছে। খুঁজে বের করতে বলেছে রুবাইয়্যাত হাসনাইন কেজি টু, পেডাগোজি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল, শ্যামলী, ঢাকা

গ্রীষ্মের দুপুর। যশোরের একটি গ্রাম, পাশেই তীরকাটি জঙ্গল। অপুদা আর আমি বসে আছি আমবাগানে, আমার মামার আমবাগান। দুদিন হলো আমরা এখানে এসেছি। পাশের বাড়ির বিজয় মামা এসে গল্প করছেন আমাদের সঙ্গে। তুমুল বাতাস বইছে। বিজয় মামা বললেন, ‘বুঝেছ অপু, আমি মহারাজ বিক্রমাদিত্যের উত্তরপুরুষ। আমার নাম বিজয়াদিত্য রায়, কিন্তু রাজার বংশধর হয়েও দেখো অবস্থা! এখন দিন আনি দিন খাই, ভীষণ কষ্টে আছি। কী আর করব!’

অপুদা বলল, ‘আপনি কিছুই পাননি?’

‘না ভাগনে, কিছু পাইনি বললে ঠিক হবে না। ওই ভাঙাচোরা পুরোনো দোতলা দালানটি পেয়েছি আর সোনার একখানা গোল চাকতি আছে। বাবা বলে গেছেন, এতে নাকি আমার ভাগ্য ফিরবে। কিন্তু কীভাবে তা বুঝতে পারছি না, এর সংকেতগুলো তো খুব বিদ্‌ঘুটে।’

অপুদা এবার একটু নড়েচড়ে বসল, বলল, ‘মামা, কেমন বলুন তো সংকেতটা।’

‘ভাগনে, ওই সোনার চাকতিতে খোদাই করা চার লাইনের একটা পদ্য আছে। বাবা বলতেন, ওতে নাকি কোনো গুপ্তধনের সংকেত আছে। কিন্তু সেটা বের করা খুব মুশকিল। আমার মুখস্থ ওটা, এই শোনো: জোড়া হয় হতে দিক জবাব,/ গোনে কর কার্তিকে দশ নবাব।/ বেতাল-পিপ্পল মাঝে ফোঁড় ভাই,/ অষ্টাপদার্থ খুঁজে ধন্দিয়ে যাই।’

অপুদা দারুণ কৌতূহলে পদ্যটা আবার আউড়ে নিল। তবে আর কিছু বলল না। বিজয় মামা বললেন, ‘ভাগনে, বুঝতে পারলে কিছু? এ ধাঁধা আমার বাবা-ঠাকুরদা কেউই বুঝতে পারেননি। থাক ওটা, যদি পেতাম, তবে হয়তো আমাদের অবস্থাটা একটু ভালো হতো। দুঃখ বলতে আমার এটাই।’

‘ওটা যদি আমি খুঁজে বের করতে পারি?’ অপুদাকে বেশ আত্মবিশ্বাসী দেখাল।

‘তাহলে আমি বাবা তোমার ওপর চিরকৃতজ্ঞ থাকব!’ বিজয়াদিত্যের চোখ ছলছল হয়ে উঠল।

অপুদা বলল, ‘মামা, আমি দেখছি।’

সারা বিকেল অপুদা আমবাগানটা ঘুরে এল। সন্ধ্যাবেলা ও আমাকে বলল, ‘এই বিল্টু, সরোজ মামার বাংলা ডিকশনারিটা নিয়ে আয় তো।’ আমি দৌড়ে গিয়ে ডিকশনারিটা নিয়ে এলাম। দেখলাম, অপুদা সাদা কাগজে কিছু লিখছে আর ডিকশনারির পাতা উল্টিয়ে কী কী যেন দেখছে। সারা রাত অপুদা ঘুমায়নি, কোনো কথাই বলেনি।

সকালবেলা বিজয় মামার বাড়ির দিকে হনহন করে হেঁটে গেল সে। আমিও গেলাম পেছন পেছন। অপুদার চোখের কোণ কালো হয়ে গেছে না ঘুমিয়ে। সত্যিই, বিজয় মামা খুব কষ্টে আছেন। বিজয় মামাকে অপুদা প্রশ্ন করল, ‘মামা, এখানে কি কোনো জোড়া ঘোড়ার মূর্তি আছে?’

‘হ্যাঁ আছে, তবে জঙ্গলের ভেতরে। কেন বলো তো ভাগনে?’

‘মামা, যদি জোড়া ঘোড়া থাকে, তবে বোধ হয় আমি ধাঁধাটা ধরে ফেলেছি।’ অপুদা বলল। বিজয় মামা কৃতজ্ঞের দৃষ্টিতে তাকালেন অপুদার দিকে। দেখলাম, উনি কাঁদছেন।

‘না মামা, কাঁদবেন না। আমি আপনাকে ধাঁধাটার উত্তর কিছুটা বলছি। যা হয়, তা আপনি মিলিয়ে নেবেন। ওই “জোড়া হয়” অর্থ জোড়া অশ্ব বা ঘোড়া, আর “দিক জবাব” মানে মনে হয় উত্তর দিক। জোড়া ঘোড়া থেকে উত্তর দিক। কার্তিক মানে ষড়ানন, ছয়সম্পর্কিত। এই ষট + দশ = ষোড়শ, মানে ১৬। কর মানে হাত। উত্তর দিকে ১৬ হাত যেতে হবে। আর জোড়া অশ্বত্থগাছ বলতে “বেতাল-পিপ্পল” বলা হয়েছে মনে হচ্ছে, এদের মাঝেই বোধ হয় “অষ্টাপদ” বা সোনা অথবা সোনার মোহরজাতীয় কিছু পোঁতা আছে। এসবই আমি বুঝেছি, ঠিক আছে কি, মামা?’ মৃদু হেসে বলল অপুদা।

সেদিন বিকেলবেলায়ই বিজয় মামা ওই তথ্যের ভিত্তিতে তীরকাটি জঙ্গলে গেলেন শাবল-গাঁইতি নিয়ে। দুটি বুড়ো অশ্বত্থগাছের মাঝখানে দুই কলসি সোনার মোহর মাটি খুঁড়ে বের করা হলো। বিজয় মামার আনন্দে চোখের জল বেরিয়ে এল, অপুদা পাশেই ছিল। তাকে জড়িয়ে ধরলেন। কাঁদো–কাঁদো হয়ে বললেন, ‘তোমার কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ।’

‘না না, আপনি কৃতজ্ঞ আপনার পূর্বপুরুষদের কাছে, যাঁরা এগুলো রেখে গেছেন। আমি তো কিছুটা আন্দাজ করে বলেছি মাত্র।’ অপুদা হাসিমুখে বলল, ‘আপনি সৎ বলে এই সততার পুরস্কার পেয়েছেন।’

 অষ্টম শ্রেণি, খুলনা জিলা স্কুল, খুলনা