ভাস্কর্যের ভাগ্য

‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’। সারা পৃথিবী এখন উত্তাল এই স্লোগানে। যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশের হাতে জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর ঘটনার অগ্নিস্ফুলিঙ্গে পুরো বিশ্বে ক্ষোভের দাবানল ছড়িয়ে পড়েছে। এই আন্দোলনেরই অংশ হিসেবে বিশ্বব্যাপী বিক্ষোভকারীরা বছরের পর বছর ধরে দাঁড়িয়ে থাকা নানা ভাস্কর্য সরিয়ে ফেলার আওয়াজ তুলেছেন। গত কিছুদিনে বিভিন্ন দেশে কখনো ভাস্কর্য ভেঙে ফেলার ঘটনা ঘটেছে, কোথাও আবার আন্দোলনের মুখে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষই ভাস্কর্য সরিয়ে নিয়েছে বা বিক্ষোভ প্রশমিত করতে ঢেকে দিয়েছে। জেনে নেওয়া যাক এমনই কিছু ঘটনার কথা।

যুক্তরাষ্ট্রের টাওয়ার গ্রোভ পার্ক কর্তৃপক্ষ কলম্বাসের ভাস্কর্য সরিয়ে নিচ্ছে। ছবি: সংগৃহীত
যুক্তরাষ্ট্রের টাওয়ার গ্রোভ পার্ক কর্তৃপক্ষ কলম্বাসের ভাস্কর্য সরিয়ে নিচ্ছে। ছবি: সংগৃহীত

ক্রিস্টোফার কলম্বাস

আমেরিকা আবিষ্কারের জন্য কিংবদন্তি হয়েছেন কলম্বাস। নতুন স্থান যেমন তিনি আবিষ্কার করেছিলেন, তেমনি ওই সূত্রেই উপনিবেশ স্থাপনের পথ সুগম হয়েছিল। কারণ, বড় বড় সাম্রাজ্য নতুন অঞ্চল পেয়েই ঝাঁপিয়ে পড়েছে তা দখলে নিতে। সুতরাং উপনিবেশ ও বর্ণবাদবিরোধীরা যখন এসবের মূলে যাওয়ার চেষ্টা করেন, তখন ক্রিস্টোফার কলম্বাসের নাম এসেই যায়। 

‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলনের সূত্র ধরে কলম্বাসের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে। বিভিন্ন এলাকায় থাকা ক্রিস্টোফার কলম্বাসের ভাস্কর্যের ওপর কেউ কেউ হামলা করছেন, কোথাও বিক্ষোভকারীরা ভাস্কর্যের ওপর অন্য রঙে লিখে দিয়েছেন প্রতিবাদী বক্তব্য। আবার কোথাও টেনেহিঁচড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে সটান ভাস্কর্য। চলতি জুন মাসেই অনেক স্থানে থাকা কলম্বাসের ভাস্কর্য সরিয়ে ফেলা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটার সেন্ট পলে বিক্ষোভকারীরা কলম্বাসের ভাস্কর্য উপড়ে ফেলেছেন। মিয়ামিতে ক্রিস্টোফার কলম্বাসের ভাস্কর্যের গায়ে লাল রঙে লিখে দেওয়া হয়েছে জর্জ ফ্লয়েডের নাম। এ ঘটনায় পুলিশ প্রায় সাতজনকে গ্রেপ্তারও করেছে। বোস্টনে কলম্বাসের ভাস্কর্যের মাথা ভেঙে ফেলা হয়েছে। সম্প্রতি এ ঘটনার পর পুরো ভাস্কর্যই সরিয়ে নেয় সংশ্লিষ্ট শহর কর্তৃপক্ষ। ভার্জিনিয়ার রিচমন্ডে কলম্বাসের ভাস্কর্য ভেঙে ফেলা হয় এবং তাতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। শুধু এটুকুতেই ক্ষান্ত হননি বিক্ষোভকারীরা। পরে সেই ভাস্কর্য ফেলে দেওয়া হয় পাশের লেকে।

প্রতিবাদের মুখে সরানো হচ্ছে ক্যাপ্টেন জন হ্যামিল্টনের ভাস্কর্য
প্রতিবাদের মুখে সরানো হচ্ছে ক্যাপ্টেন জন হ্যামিল্টনের ভাস্কর্য

ক্যাপ্টেন জন হ্যামিল্টন

জন হ্যামিল্টন ছিলেন ব্রিটিশ নৌবাহিনীর একজন কর্মকর্তা। নিউজিল্যান্ডের মাওরি আদিবাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। নিউজিল্যান্ডে ইউরোপীয় কোনো জাতিগোষ্ঠীর পা পড়ার আগে থেকেই ওই অঞ্চলে ছিল মাওরি আদিবাসীরা। বর্তমানে নিউজিল্যান্ডের নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে মাওরি বৃহত্তম। মাওরিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য অনেক আগে থেকেই উপনিবেশবিরোধীদের ক্ষোভের মূলে ছিলেন জন হ্যামিল্টন। 

জর্জ ফ্লয়েড হত্যার ঘটনার পর হ্যামিল্টনের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ আরও বাড়তে থাকে। নিউজিল্যান্ডের হ্যামিল্টনে তাঁর একটি ভাস্কর্য ছিল। এই ভাস্কর্য সরিয়ে নেওয়ার জন্য অনেক আগে থেকে দাবি জানিয়ে আসছিলেন বর্তমান মাওরি জনগোষ্ঠীর নেতারা। এমনকি তাঁরা এই ভাস্কর্য জোর করে সরিয়ে দিতেও চেয়েছিলেন। জন হ্যামিল্টনকে ‘খুনি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন তাঁরা। এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে হ্যামিল্টনের নগর কর্তৃপক্ষই সরিয়ে নিয়েছে জন হ্যামিল্টনের ভাস্কর্য।

এডওয়ার্ড কোলস্টনের ভাস্কর্য বোস্টনের পোতাশ্রয়ে ছুড়ে ফেলেছেন বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনকারীরা
এডওয়ার্ড কোলস্টনের ভাস্কর্য বোস্টনের পোতাশ্রয়ে ছুড়ে ফেলেছেন বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনকারীরা

এডওয়ার্ড কোলস্টন

এই ব্যক্তি ছিলেন একজন কুখ্যাত দাস ব্যবসায়ী। ইংল্যান্ডের ব্রিস্টলে তাঁর একটি ভাস্কর্য ছিল। ছিল বলতে হচ্ছে কারণ চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহের শেষ দিনে বিক্ষোভকারীরা এডওয়ার্ড কোলস্টনের ভাস্কর্য ভেঙে ফেলেছেন। কোলস্টনের বিরুদ্ধে অভিযোগ, সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীর দিকে দাস ব্যবসা করে বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হয়েছিলেন তিনি। ফলে বর্ণবাদ ও উপনিবেশবিরোধীদের চোখ তাঁর শত্রু বনে যাওয়াই স্বাভাবিক। শুধু ভাস্কর্যটি উপড়ে ফেলেই ক্ষান্ত হননি বিক্ষোভকারীরা। সেটিকে রাস্তা দিয়ে গড়িয়ে নিয়ে কাছের একটি পোতাশ্রয়ে ফেলে দেয়।

রাজা দ্বিতীয় লিওপোল্ডের ভাস্কর্যে রং মাখিয়ে দেন প্রতিবাদকারীরা
রাজা দ্বিতীয় লিওপোল্ডের ভাস্কর্যে রং মাখিয়ে দেন প্রতিবাদকারীরা

রাজা দ্বিতীয় লিওপোল্ড

বেলজিয়ামের বিভিন্ন জায়গায় রাজা দ্বিতীয় লিওপোল্ডের ভাস্কর্যের ওপর ক্ষোভ ঝেড়েছেন আন্দোলনকারীরা। দ্বিতীয় লিওপোল্ডের বিরুদ্ধে অভিযোগ বেশ পুরোনো। বলা হয়ে থাকে, ঊনবিংশ শতাব্দীতে ক্ষমতায় থাকার সময় কঙ্গোর সাধারণ মানুষের ওপর ব্যাপক নির্যাতন চালিয়েছিলেন দ্বিতীয় লিওপোল্ড। ওই সময় কঙ্গো ছিল বেলজিয়ামের উপনিবেশ। 

অভিযোগ আছে, রাজা দ্বিতীয় লিওপোল্ডের নির্দেশে কঙ্গোর প্রায় ১০ লাখ থেকে দেড় কোটি মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল। সম্প্রতি বিক্ষোভকারীরা বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে দ্বিতীয় লিওপোল্ডের ভাস্কর্য সরানোর দাবিতে কঙ্গোর জাতীয় পতাকা নিয়ে শহরব্যাপী বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছেন। এ সময় বিক্ষোভকারীরা দ্বিতীয় লিওপোল্ডকে ‘খুনি’ বলে সম্বোধন করছিলেন। ভাস্কর্য সরানোর জন্য ব্রাসেলসে একটি অনলাইন পিটিশনও চালু করা হয়েছে। অন্যদিকে এর কয়েক দিন পরেই বেলজিয়ামের এন্টেয়ার্পে একদল বিক্ষোভকারী রাজা দ্বিতীয় লিওপোল্ডের এক ভাস্কর্যে আগুন ধরিয়ে দেন। পরে ওই ভাস্কর্যে লাল রং মাখিয়ে দেওয়া হয়। এ ঘটনার পর বর্তমানে শহর কর্তৃপক্ষ নিরাপত্তার স্বার্থে ওই ভাস্কর্যটি সরিয়ে ফেলেছে।

তথ্যসূত্র: নিউইয়র্ক টাইমস, স্মিথসোনিয়ান ম্যাগ, বিবিসি, স্কাই নিউজ ও সিএনএন