আজব চোর

স্কুল থেকে ফেরার পথে হঠাৎ তপুর চোখ পড়ল কড়ইগাছের মগডালে। শিয়ালের লেজের মতো বেগুনি রঙের ফুল ফুটে আছে। নারকেল, কড়ইগাছে পরগাছার মতো জড়িয়ে থাকা গাছটা সে আগেও দেখেছে। ফুল কখনো চোখে পড়েনি। ব্যাগ-জুতা নিচে রেখে তরতর করে গাছে উঠে শিকড়সুদ্ধ ফুলগাছটা নামিয়ে আনল তপু। নিচে দাঁড়িয়ে ওর কাণ্ডকারখানা দেখছে স্কুলফেরত অন্যরাও। সঙ্গে এসে জুটেছে হানু। হানু লোকটা অন্য রকম। মানে সে কারও ধার ধারে না। গাছপালা আর ফুল-পাখির সঙ্গে একা একা কথা বলে, হাসে। হানুর মুখে লম্বা দাড়ি-গোঁফ। ছেঁড়া জামা গায়ে পুরো এলাকায় টইটই করে ঘুরে বেড়ায়।

ফুলগুলো বাসায় এনে তপু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল। এক ছড়ায় অনেকগুলো ফুল। দূর থেকে দেখে নরম মনে হলেও ফুলগুলো প্লাস্টিকের ফুলের মতোই শক্ত। সাদা পাপড়িতে যেন কেউ বেগুনি রং ছিটিয়ে দিয়েছে। ছয়টি পাপড়ির একটি দেখতে স্যুপ খাওয়ার চামচের মতো। তপুর হাতে ফুলগুলো দেখেই মা চিনে ফেলল। রাস্না। অর্কিডজাতীয় ফুল। বারবার নিষেধ করার পরও তপু গাছে উঠেছে। মা রাগ করলেন। টবে মাটি ভরে গাছটা রোপণ করতে চাইল তপু। মা বললেন, ‘উঁহু, এটা মাটিতে বাঁচবে না।’ তারপর মা-ছেলে মিলে নারকেলের ছোবড়া ছিঁড়ে শিকড়সুদ্ধ ফুলগাছটা টবে লাগাল। প্লাস্টিকের টবের চারপাশে বাতাস চলাচলের জন্য ছিদ্রও করে দিল অনেকগুলো।পরদিন সকালে বাবার চিৎকার-চেঁচামেচিতে ঘুম ভেঙে গেল সবার। দুর্ধর্ষ চুরি হয়ে গেছে রাতে। চোর সুপারিগাছ বেয়ে ছাদে উঠেছে। চোরের বড় বড় পায়ের ছাপ পড়ে আছে মাটিতে। বাবার সঙ্গে বাসার চারপাশটা ঘুরে দেখল তপু। কী কী নিয়ে গেছে চোর? ছাদে শুকাতে দেওয়া টি-শার্টটা নেই। খুঁজতে খুঁজতে তপু দেখল, ব্যালকনিতে টবের মধ্যে লাগানো রাস্নাগাছটাও নেই। এ যে বড় আজব চোর! ফুলগাছও চুরি করতে হয়! ব্যালকনিতে অন্য ফুলগাছও ছিল। সেগুলো না ধরে শুধু রাস্নাগাছটাই–বা কেন নিল সে?
চোর ধরার অভিযানে নেমে পড়ল তপু। কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করতেই হদিস পাওয়া গেল। ভোররাতে বস্তা হাতে হানুকে বাসার আশপাশে ঘুরতে দেখেছে কয়েকজন। দেরি না করে হানুর আস্তানায় হানা দিল তপু। স্কুলের পেছনে বটগাছের নিচেই তার আস্তানা। আসলে কোনোরকমে মাথা গোঁজার ঠাঁই আরকি। তো সেই আস্তানায় গিয়ে তপু দেখল, ঘটনা সত্য। গত রাতে চুরির ঘটনা হানুই ঘটিয়েছে। ওর গায়ে তপুর টি-শার্ট। পায়ের কাছে পড়ে আছে ভাঙা টবটা। টবে ফুলগাছটা নেই। নিশ্চয়ই কোথাও উপড়ে ফেলে দিয়েছে। রাগে গজগজ করতে লাগল তপু। ওর রাগ দেখে ফ্যালফ্যাল করে হাসতে লাগল হানু।

হানুর ডেরা থেকে ফেরার পথে কড়ই আর নারকেলগাছগুলোতে বারবার তাকাল তপু। যদি কোনো রাস্না চোখ পড়ে, সেই আশায়। যে গাছটা থেকে গতকাল রাস্না নামিয়েছিল, তপু তার নিচে গিয়ে দাঁড়াল। কোনো জিনিস হারিয়ে যাওয়ার পরও মানুষ যেমন অনর্থক আরেকবার খুঁজে দেখে, ঠিক তেমন করেই কড়ইগাছের মগডালের দিকে তাকাল সে। অদ্ভুত ব্যাপার, তপু ঠিক যেখান থেকে রাস্নাটা নামিয়েছিল, ঠিক সেখানেই ঝুলে আছে গাছসহ ফুলগুলো! দড়ি দিয়ে শক্ত করে বাঁধা। প্রথমে একটু অবাক হলেও বুঝতে দেরি হলো না কে করেছে কাজটা। হাত গুটিয়ে গাছে ওঠার প্রস্তুতি নিতেই তপু দেখল, পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে হানু। গা থেকে তপুর টি-শার্টটা খুলে বিষণ্ন করুণ চোখে ফুলগাছটা না নামানোর অনুনয় করছে সে!