বৃষ্টি, তুমি কি আমার বন্ধু হবে?

আঁকা: ঐশিকদীপ্র কানুনগোয়
আঁকা: ঐশিকদীপ্র কানুনগোয়

যখন অঝোরে বৃষ্টি ঝরে, আকাশ কালো করে আসে ঘন কালো মেঘ, তারপর শুরু হয় টুপটাপ শব্দ—তখন আমার মন ভীষণ খারাপ হয়ে যায়। বারবার শুধু মনে পড়ে আমার মায়ের মুখ।

মা বৃষ্টি খুব ভালোবাসতেন। আমিও আকুল বৃষ্টিধারা খুব পছন্দ করি। বৃষ্টির দিনে আমি তিনতলার ছাদে উঠে পড়ি। ছোট্ট এতটুকুন ছাদ। একটা চিলেকোঠা আছে। সেই চিলেকোঠায় ভাঙাচোরা আসবাবপত্র। ফেলে দেওয়া জিনিসপাতি। চিলেকোঠাটা আমার ভারি প্রিয় জায়গা! ওখানে আমি ঘাপটি মেরে চুপচাপ বসে থাকি। কী যে ভালো লাগে আমার!

যখন বৃষ্টি ঝরে, তখন আমি হাত–পা ছড়িয়ে ছাদে ভিজতে থাকি। একটা-দুটো নয়, অসংখ্য বৃষ্টিফোঁটা আমাকে আদর করতে থাকে। অবিরল জলধারায় স্নিগ্ধ, সতেজ, প্রাণবন্ত হতে থাকি। বৃষ্টি যেন মায়ের মতো। কোমল, আদুরে, স্বপ্নমাখা, লাবণ্যময়ী মা আমার। মায়ের মতো কেউ নেই।

খুব ছোটবেলায়, যখন দুপুরবেলা আকাশ ভেঙে বৃষ্টি আসত, তখন আমি চুপটি করে মায়ের কোলে মুখ লুকাতাম। মা আমাদের জানালা খুলে দূরের আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতেন উদাস হয়ে।

বৃষ্টির ঘরবাড়ি কোথায়?

বৃষ্টিরা খায় কী?

বৃষ্টিরা কেন হঠাৎ হঠাৎ বেড়াতে আসে?

এসব প্রশ্ন করতাম মাকে।

মা হাসতেন। জবাব দিতেন না কোনো।

একটু একটু বেড়ে উঠতে লাগলাম। বুঝতে পারলাম, বৃষ্টি আসলে খুব সুন্দর, যেন মিষ্টি একটা মেয়ে। বৃষ্টি শুরু হলেই মনটা আমার আঁকুপাঁকু হয়ে ওঠে। ঘরে থাকতে মন চায় না। কোথাও হারিয়ে যেতে ইচ্ছে হয়। কোথায়? বৃষ্টিরা যেখানে থাকে।

কিন্তু আমি তো বৃষ্টিদের ঠিকানা জানি না। বৃষ্টিতে ভিজতে আমার দারুণ ভালো লাগে। কত দিন আমি বৃষ্টিতে ভিজেছি! মায়ের বকুনি খেয়েছি। রাতে আমার শিরশির করে জ্বর এসেছে। কাঁথা টেনে নিয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়েছি।

অমনি শুয়ে শুয়ে কানে এসেছে গানের সুর—বৃষ্টি ঝরছে, বৃষ্টি ঝরছে। একটানা রিমঝিম রিমঝিম। সে কী অলৌকিক সুর! আমার সমস্ত শরীর–মন যেন আচ্ছন্ন হয়ে যেতে লাগল। ঘন বৃষ্টির মধ্যে গভীর ঘুমে আমি যেন তলিয়ে যেতে লাগলাম। মায়ের পাশে শুয়ে আছি। মায়ের আদর আর বৃষ্টির সুর—সব মিলে জ্বরে কাঁপতে থাকি আমি।

বৃষ্টি কোথা থেকে আসে?

বৃষ্টি আসে সুদূর শৈশব থেকে।

বৃষ্টির গান শুনি আমরা কোথা থেকে?

সেই শৈশব থেকে।

বৃষ্টি আমার মায়ের মতোই। এখন আমার মা নেই। হঠাৎ করে মা কাউকে না বলে এক বৃষ্টিভেজা ভোরবেলায় সবাইকে কাঁদিয়ে চলে গেলেন।

মা কি তবে বৃষ্টির দেশে গিয়েছেন?

জানি না।

যাদের মা নেই তাদের অনেক দুঃখ। আমি সেই দুখি ছেলে। মা নেই আমার, তবে এখনো বৃষ্টি আছে। বৃষ্টি, তুমি কি আমার বন্ধু হবে?

আমীরুল ইসলাম: বাংলাদেশি শিশুসাহিত্যিক (জন্ম: ১৯৬৪)