আনন্দের ঈদ

.
.

ঈদ, ঈদের আনন্দ, খুশি ইত্যাদি নিয়ে একটি লেখা তৈরির অনুরোধ রক্ষার্থে এই লিখতে বসা। কী লিখব? এই আসমানসমান উঁচু বয়সে ঈদ নিয়ে তো কোনো ভাবাভাবি নেই। তাই তো আনন্দও কেমন হাতছাড়া-খাপছাড়া অবস্থায়। তাহলে কী নিয়ে লেখা এগোবে?
ভাবনার কথা বৈকি। কী আর করা। নিজের ছেলেবেলার দিকেই তাহলে একটু ভাবনাটাকে পিছিয়ে নিয়ে যাই বরং। তাতে কিছু রসদ পাওয়া গেলেও যেতে পারে। আসলে তো ঈদের যত আনন্দ, তার সবই ছোটদের দখলে। বড়রা আনন্দের ভাব দেন। অভিনয় অভিনয় মতন।
বড়রা বলতে প্রবীণদের কথাই শুধু নয়, যাঁরা ঈদে সবার জন্য ভাবেন, কেনাকাটা করেন, তাঁরাও এই দলভুক্ত। আসলে ঈদের আগেই এ-বাজার সে-বাজার ঘুরে, এটা-ওটা কিনতে পারার ব্যাপারে যে আনন্দিত হওয়ার ঘটনা, সবাইকে খুশি করার জন্য হাত খুলে খরচ করার যে আনন্দ, তা তো ঈদের আগেই শেষ। অতএব ঈদের দিন ঝিম মেরে যাওয়াই দস্তুর। দিনভর পাজামা-পাঞ্জাবি পরে এ-ঘর ও-ঘর করা ছাড়া কাজ থাকে না কোনো।
আমারও সেই দশা। তাই সেসব কথা, মানে বড়দের কথা পরে হোক। আগে ছেলেবেলার দেখা ঈদের কথা বলা যাক।
আসলে আমাদের ছোটকালটা এখনকার ছোটদের মতো হাজার রকম প্রাপ্তির ছিল না। এখনকার মতো চটপটে ভাবেরও ছিল না। ঈদে এটা চাই, ওটা চাই ধরনের মুখ ফুটে বলারও সাহস ছিল না। অন্তত আমার তো ছিলই না। মা-বাবা বা গুরুজনেরা যা দিতেন, তাতেই খুশি থাকার নিয়ম ছিল।
কী কেনা হতো ঈদে? প্যান্ট-শার্ট কিংবা পাজামা-পাঞ্জাবি-জুতো ইত্যাদি। এখন তো এসবের সঙ্গে বায়না করা থাকে মোবাইল সেট দাও, ক্যামেরা দাও অথবা ক্যামেরাসহ বড়সড় সেট দাও, বড় স্ক্রিনের টিভি দাও ইত্যাদি কত কিছু। আমাদের সময় তো এসব ছিলও না, চাওয়ারও বালাই ছিল না। অল্পতেই মহাখুশি থাকতাম।
যা পেতাম, তাতেই ঈদের দিন মহা ফুর্তি। মসজিদ থেকে গিয়ে শুধু খাওয়া আর খাওয়া সারা দিন ধরে। তবে আমাদের বাড়িতে ঈদে নতুন নতুন গানের রেকর্ড কেনা হতো। সেই গান শোনা হতো কলের গানে। এখন তো অনেক কিছু পাওয়ার আনন্দের সীমা থাকে না।
আসলে তো ঈদে সবচেয়ে আনন্দে থাকে কিশোর-কিশোরীরা। এমনিতেই তো তাদের জগৎটা চিরকালই বেশ আলাদা। ইদানীং টিভি-মোবাইল আর কম্পিউটারের যুগে তাদের ভাবসাব অন্য রকম। কথাবার্তায়ও বেশ স্মার্ট। আমাদের ছেলেবেলায় বড়রা কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে কতক্ষণে সামনে থেকে কেটে পড়া যায়, তার চিন্তা হতো। এখন সেসব নেই। আগের মতো ইনিয়ে-বিনিয়ে কথার উত্তর দেওয়ার চল আর এখন নেই। কাট কাট কথা, নতুন নতুন শব্দ ব্যবহার, ঝটপট উত্তর। এই রকমের সব অভ্যাস রপ্ত রয়েছে। ব্যাপারটা অবশ্যই ছেলেদের জন্য প্রযোজ্য। কথার ধরন যেমন, তার কিছু উদাহরণ দেওয়া যাক—

.
.

গত ঈদের কথা। অটোগ্রাফ নিতে আসা সিক্স-সেভেনে পড়া এক পিচ্চিকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ঈদ কেমন হলো?’ উত্তর, ‘হেভবি।’ বললাম, ‘ঈদের খাওয়াদাওয়া কেমন হলো?’ বলল, ‘জোশ!’ জিজ্ঞেস করলাম, ‘বেড়ানো কেমন হলো?’ উত্তর দিল, ‘সেরম।’
চটপট উত্তর। সংক্ষেপে কথা। বেশ মজা পাচ্ছিলাম। তার কাগজে ছোট্ট একটা টোকাই এঁকে হাতে দিতেই কাগজটা হাতফসকে পড়ে গেল। আর সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল ইংরেজি কায়দায়, ‘ওহ শিট!’
এসব শব্দ জানাই ছিল না। আর কথায় কথায় দু-একটা ইংরেজি শব্দ বলারও চল ছিল না। এখন যেমন ছোটরাও বলে থাকে, ‘হাই’, ‘ওয়াও’, ‘গশ্’ ‘ওকে’—এসব তেমন ছিল না। ছিল না মানে জানাই ছিল না।
এসব তো এখন খুব চালু কথা। অনেকে একখানে জড়ো হলেই এসব বলে কথোপকথনের সময়। তো ঈদের দিন হলো মোক্ষম দিন। প্রায় সব বাড়িতেই ছোটদের ভিড় জমে দাওয়াত খেতে এসে। আর তা হলেই সমানে এসব চলে। আবার ঈদ উপলক্ষে ফেসবুকে কে কাকে কী লিখল, তাও আলোচনার বিষয় হয়।
আসলে এখনকার দিনকালই আলাদা, মজাদারও বটে। তো এসব থাক। এবার আমার ছেলেবেলায় ঈদ নিয়ে কী হতো, সেই কথায় যাই বরং। ঈদের আগের দিনের সন্ধ্যা নিয়ে শুরু করি। সন্ধ্যা নামার আগ মুহূর্তে ঈদের আগের দিন কী কাণ্ডই না ঘটত! ছাদে ছাদে পোলাপানের চাঁদ দেখার ভিড়। সবার মধ্যে দারুণ উদ্দীপনা! তা এমন যে মনে হয় জীবনে চাঁদ দেখেনি। এই প্রথম তেমনটা ঘটতে যাচ্ছে।
পাশের বাড়ির ছাদ থেকে হঠাৎ চিৎকার শোনা গেল, ‘ওই যে, ওই তো, আরে দেখতে পাইতাছস না কানা কুনহানকার! উইইই যে, সোজা তাকা ওই দিকে, একদম সোওজা...।’ এ কথা শুনে আমরাও তাকাতাম।
কিসের কী! আসলে পুরা ফলস, ভুয়া। একজন আরেকজনকে দিব্যি ‘ভুই’ দেখিয়ে দিল। এই খেলা বেশ জমে উঠত। তারপর হা-হা-হি-হি। চাঁদ দেখা নিয়ে কত রকমের যে মজা হতো তার ইয়ত্তা নেই। দু-একজন প্রবীণ থাকলে তো চাঁদ দেখার পর দোয়া পড়তেন মোনাজাতের মতো হাত তুলে।
এ ছাড়া অন্য ঘটনাও ঘটত। তাও একটু বলি। আমি যখনকার কথা বলছি, তা পঞ্চাশ দশকের মাঝামাঝির। তখন মেয়েদের অহেতুক চলাফেরায় বেশ রাখঢাক। স্কুল-কলেজে ঘোড়াগাড়ি, রিকশা ইত্যাদিতে যাওয়া-আসা চলত। কোনো কোনো স্কুল-কলেজের নিজস্ব বাসও ছিল। বাহন হিসেবে। হেঁটে গেলে দলেবলে

যাওয়ার নিয়ম ছিল। তবে এখনকার মতো হিজাব বা বোরকার চল ছিল না। হঠাৎ হঠাৎ বোরকা চোখে পড়ত, ধরে নিতাম ওরা পশ্চিমা মেয়ে।
যা-ই হোক, সবাই প্রায় বাড়িতেই থাকত বলে ছাদ ছিল একমাত্র বৈকালিক হাওয়া খাওয়ার স্থান। তো যুবককুলেরও সে জন্য ছাদে ছাদে দাঁড়ানোর অভ্যাস চালু ছিল। আমরা, মানে ছোটরা সেসব দেখতাম। খুব যে সবকিছু বুঝতাম তা নয়। তবে ঘুড়ি ওড়াতে ওড়াতে এ-ছাদে ও-ছাদে গোঁত্তা লাগিয়ে ঘুড়ি ফেলে দেওয়ার অর্থ না বুঝলেও বড়দের দুষ্টুমি বলে ধরে নিতাম।
তো ঈদের চাঁদ দেখা নিয়ে যা বলছিলাম। সেই কথায় আসি। ছাদে যাওয়ার অনুমতি থাকত বলে চাঁদ দেখা পার্টিতে মেয়েরাও থাকত। বিভিন্ন ছাদে কলেজপড়ুয়া বড় ভাইদের ভিড়ও তাই কম থাকত না। এমনও দেখতাম যে পূর্ব দিকের বাড়িগুলোর ছাদে মেয়ে বেশি থাকলে পশ্চিমের চাঁদ দেখায় ক্ষান্ত দিয়ে ভাইয়েরা পূর্বে তাকিয়ে থাকতেন।
চাঁদ খুঁজে পাওয়াটা কঠিনই ছিল বটে। পশ্চিম আকাশের দিকে একনাগাড়ে তাকিয়ে থাকলে অহেতুক চাঁদের মতো ক্ষীণ চিকচিকে রেখা দেখা যেত। আসলে ব্যাপারটা নেহাতই ধোঁকা। কল্পনার সঙ্গে মেশানো। এই দেখলাম আবার এই হাওয়া। নিমেষেই মুছে যেত। কিন্তু ফাইনালি কেউ না কেউ সত্যি সত্যিই সত্যিকারের চাঁদ আবিষ্কার করে ফেলে চিৎকার করে উঠলে হইচই পড়ে যেত। আবার এক বাড়িরই কেউ শুধু প্রথম চাঁদ দেখার হিরো বনে যেত তা নয়। পুরো পাড়ায় অনেকেই দেখে ফেলত প্রায় একই সময়ে আর সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে যেত পটকা ফাটিয়ে জানান দেওয়া।
বলা বাহুল্য, আজকালের মতো অঢেল বোমা-পটকার সাপ্লাই তখন ছিল না। কান ঝালাপালা করা বা বুককাঁপানো আওয়াজের বোমাও ছিল না, এখন যেমন থাকে। বিরক্তকারীও ছিল না।
যা কিছু বললাম, এসবই ঢাকা শহরকে নিয়ে। গ্রামের ব্যাপার ছিল অন্য রকম। মাঝেমধ্যে ঈদ উপলক্ষে দেশের বাড়িতে যাওয়া হতো মা-বাবার সঙ্গে।
গ্রামে উঁচু উঁচু গাছগাছালিতে ঢেকে থাকা পশ্চিম আকাশে চাঁদ খুঁজে বের করা সহজ ছিল না। তাই খুব ফাঁকা কোনো মাঠে গিয়ে দাঁড়াতে হতো বড়দের হাত ধরে। আর চাঁদ দেখামাত্র বন্দুকে গুড়ুম গুড়ুম আওয়াজ করে জানিয়ে দেওয়া হতো।
সে আমলে হেলিকপ্টার করে উড়ে মেঘ ফুঁড়ে গিয়ে চাঁদ দেখা কমিটির চাঁদ দেখা না-দেখার ঘোষণা মতন কিছু ছিল বলে শুনিনি। ঈদ হবে শোনামাত্র আমাদের হুটোপুটি শুরু হয়ে যেত। আর শেষ ইফতার শেষে হাতে বানানো সেমাই আর তেলের পিঠা বানানোর হুলুস্থুল আরম্ভ হতো হেঁশেলে।
শহরের ঘটনাও ছিল প্রায় তেমনই। ঈদের কয়েক দিন আগে থেকেই হাতমেশিনে সেমাই বানানোর ধুম পড়ত। আমরাও মেশিনের হাতল ঘোরাতাম। কেনা সেমাইয়ের চল ছিল কি না জানা ছিল না। অন্তত আমাদের বাড়িতে তো ছিল না।
যা-ই হোক, মনে আছে চাঁদ খোঁজাখুঁজি নিয়ে আমার তেমন মাথাব্যথা থাকত না। আর সেটা ছিল শেষ ইফতারের লোভে। থরে থরে সাজানো বেগুনি-পেঁয়াজুসহ হরেক রকম আইটেমের লোভ সামলানো সহজ হতো না। তা ছাড়া মেইন রোড থেকে নিজের কিনে আনা বরফের টুকরা দিয়ে যে লাচ্ছি খাওয়ার নিয়ম, তাতে তর সওয়া চাট্টিখানি কথা ছিল না। ইফতারের সামনে তাই বসে থাকতাম। তখন চাঁদের ভাবনাটা মাথায়ই থাকত না। এসব কারণে তখন আমার ‘পেটুক’ টাইটেলপ্রাপ্তি ঘটেছিল।
ঈদ মানেই দারুণ খুশির দিন—এই কথা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। এমনকি গানও বাঁধা আছে, ‘রমজানেরই রোজার শেষে এল খুশির ঈদ।’ প্রায় সব কটা টিভি চ্যানেল আর রেডিওতে কতভাবে এবং কতশতবার যে গাওয়ানো হয় বা বাজানো হয়, তার হিসাব করা কঠিন।
তো আমি ভেবে দেখেছি যে ঈদের দিনে তেমন আনন্দের ঘটনা খুব বলার মতো কিছু নয়। যেটুকু আনন্দ বা খুশি হওয়া, তা ছোটদের মধ্যে। বিশেষ করে পিচ্চিদের মধ্যে। দূর-দূরান্ত থেকে বেড়াতে আসা আত্মীয়স্বজনের ছোট ছোট ছেলেমেয়েকে অনেক দিন পর একসঙ্গে দেখা হওয়ার যে আনন্দ, তা যেন সারা বছরের জমিয়ে রাখা কিছু। তো ঈদের খুশি ছোটদের দখলেই থাকে চিরকাল। এখনো তা-ই।
আমার মনে হয়, ঈদের দিনটি আসল আনন্দের নয়। আনন্দটা আসন্ন ঈদকে উপলক্ষ করে শুরু হয় রমজানের মাসটিতে। দারুণ আনন্দে থাকে সমাজ-সংসারের বিশেষ বিশেষ কয়েকটি অংশ। যেমন: জামা-জুতা-কাপড়চোপড়ের ব্যবসায়ীকুল, রিকশা-বাস, লঞ্চ-নৌকাসহ নানান পরিবহনের মালিককুল, বোনাসপ্রাপ্ত চাকুরেকুল, ঈদের লম্বা ছুটি পাওয়া ছাত্র-শিক্ষক, করণিককুল।
‘আহা কী আনন্দ আকাশে-বাতাসে’ বা ‘এল খুশির ঈদ’ ধরনের গানগুলো উপযোগী হয়ে ওঠে সবচেয়ে বেশি দোকানপাটওয়ালা এবং পরিবহনের মানুষদের জন্য বলে আমার মনে হয়।
কী অসাধারণ কাণ্ডই না করেন তাঁরা! ভাঙা অকেজো বাস-লঞ্চ ইত্যাদিকে দিব্যি মেরামত করে চালু করেন মহানন্দে। ঈদের ঘরমুখী মানুষের নাড়ি টেপা আছে তাঁদের। জানা আছে, পথে বা পানিতে নামালেই প্রাণবাজি রেখে হলেও যাত্রীরা চড়বেনই। কারণ, আনন্দ করতে যাঁর যাঁর দেশের বাড়িতে আত্মীয়স্বজনের কাছে যাওয়ার উদগ্র বাসনা তাঁদের মধ্যে ঈদ উপলক্ষে বক্ষে সঞ্চারিত থাকেই। প্রয়োজনে বেশি ভাড়া হলেও, বাদুড়ঝোলা হয়ে ভ্রমণ হলেও তাঁরা যাবেনই। খবরে দেখলাম, এবার রেলগাড়িরও বাতিল-অকেজো বগিগুলোকে মেরামত করে ঈদযাত্রীদের জন্য রেডি করা হচ্ছে। যাত্রীদের আনন্দের কথা ভেবেই তো এত সব। রেলের কামরায় আসন পাওয়া যাত্রী, বিনা টিকিটের ছাদের যাত্রী, মোটকথা সবার ঈদের আনন্দ যেন ব্যাহত না হয়, তার ব্যবস্থা করা হয় চিরকালই। বাস-লঞ্চের যাত্রীও রয়েছেন দুরকম। এক, রেলগাড়ি আর বাসের ছাদের ভ্রমণ-ইচ্ছুক ‘লাইফ রিস্ক’ যাত্রী; দুই, লঞ্চের পুরো গায়ে গাদ্দিচাপা হয়ে কোনোরকমে যাওয়া ‘ভেসে যাক তরী-ডুবে যাক প্রাণ’—কথাকে শিরোধার্য করেন আনন্দিত যাত্রী। বেশি দামে টিকিট কেটেও এই দুঃসাহসকে স্বীকার করে নেওয়া ঈদের খুশির কারণে। আনন্দের আতিশয্যই বটে।

.
.

দোকানপাটের কথায় আসা যাক। ঈদের আনন্দ তাদের অপরিসীম। কে কত লাভ করবে, তার প্রতিযোগিতায় নামে আনন্দিত চিত্তে। ঈদ এলেই ক্রেতাদের ‘হাতখোলা’ মন-মানসিকতার ভাবসাব দোকানিদের নখদর্পণে। ঠকে যাওয়ার ব্যাপারটা ক্রেতাদের জানাই থাকে, তবু ঈদ বলে কথা। বউ-বাচ্চাদের আনন্দ বাড়াতে এসব ঝক্কি হজম করতেই হয়।
তো এই রকমের সব দিগিবদিকের ব্যাপার-স্যাপার নিয়েই ঈদের খুশি। মানে বছরে দুবার দুই ঈদের খুশির হরেক কাণ্ড। এসবের দুর্বিপাককে জেনেশুনেই মেনে চলার নিয়ম। সবার ভাবনাটা থাকে হয়তো এ রকম যে, বছরে তো মাত্র দু-একবারই এমন সময় আসে জীবনে। অতএব ঝাঁপিয়ে পড়তে দ্বিধা কিসের। বিপদ-আপদের ব্যাপার তো ভাগ্যের ওপর নির্ভর। যা হওয়ার হবে।
যা-ই হোক, আবার একটু পুরোনো দিনের কথায় আসি। সত্তর দশকের শেষ নাগাদের কথা। পুরান ঢাকায় থাকি তখনো। তো একদিন রিকশা করে বাড়ি ফিরছি বিকেলে। ছোটখাটো একটা জ্যাম। রিকশা দাঁড়ানো। হঠাৎ দেখি হন্তদন্ত হয়ে ছুটছে এক মাঝবয়সী লোক। তার পরিচিত আরেকজন পথচারী জিজ্ঞেস করল, ‘কী ব্যাপার, ছুটতাছেন ক্যান?’ লোকটা প্রায় আতঙ্কিত হয়ে উত্তর দিল, ‘আগুন আগুন!’
তা শুনে চিন্তিত দ্বিতীয়জনের প্রশ্ন, ‘আগুন! কোথায়? কোনখানে?’ উত্তর এল, ‘আরে ভাই, বাজারে! ঢুকছিলাম ঈদের বাজার করতে। দৌড়াইয়া কাইটা পড়ছি। আরে বাপ রে বাপ! দোকানদাররা আগুন জ্বালাইয়া রাখছে সবকিছুর দামে-দুমে।’
আমি ভেবেছিলাম, সত্যি বুঝি কোনো বাজারে আগুন লেগেছে। পরক্ষণেই সব শুনে বুঝলাম যে রমজান আর ঈদের বাজার শুরু হয়ে গেছে। এখন যার সংগতি আছে, সে বাজারে থিতু হয়ে ঘুরবে, আর যে কেনাকাটায় অপারগ, সে ভীত হয়ে ওমুখী হবে না সহজে।
এই ঘটনাকে কিছুটা অতিরঞ্জন করে বিচিত্রায় ঈদের কার্টুন করেছিলাম। আরেকটি ঘটনা বলি। আরও কয়েক বছর পরের ঘটনা। গিন্নির সঙ্গে গিয়েছিলাম গাউছিয়া মার্কেটে। ঈদের বাজার। লোকে লোকারণ্য। ভিড় দেখে আমি আর ঢুকিনি। বাইরে অপেক্ষায় থাকলাম। প্রায় ঘণ্টা দেড়েকেও গিন্নির ফেরার নাম নেই। অবশেষে চিন্তিত হয়ে ঢুকলাম। অসংখ্য নারীর ভিড়। সেই ভিড় থেকে নিজ গিন্নিকে খুঁজে বের করা দুরূহ। শেষে যখন বিফল হয়ে ফিরে আসছি, তখন পাওয়া গেল। কেনাকাটা শেষে আমাকে না দেখে তিনি আমার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে। বললাম, ‘খুঁজতে গেছিলাম। এমন ভিড়। আগে জানলে আঁচলে সুতা বাইন্ধা দিতাম হাতে নাটাই রাইখা।’
সে সময় ঈদের কার্টুনের চাপ। বিষয় হাতড়ে বেড়াচ্ছি। শেষে এটিকেও কার্টুন করেছিলাম। মজা পেয়েছিলেন পাঠকেরা। বিষয় সাজিয়েছিলাম এভাবে: একজন নাটাই হাতে বাজারের ফুটপাতে বসা। আরেকজন তা দেখে কী করছে জিজ্ঞেস করায় উত্তর দিল, ‘গিন্নিকে ভিড়ে খুঁজে পাবার সুতলি বুদ্ধি রে ভাই!’
আরেকটা ঘটনা বলি। ঈদের আগের দিন এক পড়শিকে দেখলাম বেশ গাম্ভীর্য নিয়ে কোথায় যেন যাচ্ছেন। চোখাচোখি হয়ে যাওয়ায় কী আর বলি। জিজ্ঞেস করলাম কিছুটা রসিকতার ভঙ্গিতে, ‘কী ভাই, ঈদের কেনাকাটার জন্য বড় বাজারে যাইতাছেন বুঝি।’
এ কথা শুনে ভদ্রলোক বিরক্ত হলেন। বললেন, ‘আরে না! দেখতাছেন না, ছোট্ট ব্যাগ নিয়া যাইতাছি?’
এগুলো উল্লেখ করলাম এই জন্য যে ঈদ আসি আসি অবস্থায় আমার সব আনন্দ উবে যেত ঈদসংখ্যার কার্টুন করা নিয়ে। বিষয় খুঁজতে গলদঘর্ম থাকতাম। অতএব চলমান জীবন থেকে বিষয় নেওয়ার চেষ্টা করতাম। তবে কোনো কার্টুন প্রশংসা পেলে আনন্দিতও হতাম। আবার ঈদের বিশেষ সংখ্যার কার্টুন আর ইলাস্ট্রেশন করে টু পাইস এক্সট্রা আসত। ঈদের কেনাকাটায় তা সহায়ক হতো। এই ব্যাপারও আনন্দের ছিল।
যা-ই হোক, বড়দের ঈদের দিনে তেমন কিছু করার থাকে না। আর ঈদ উপলক্ষে কেনাকাটায় খরচা জোগান দিয়ে প্রায় ফতুর হওয়া গৃহকর্তাদের সারা দিন হাই তুলে আর ঘুমিয়েই কাটে। ঈদ-পরবর্তী মাসটি কেমনে কাটবে আর যদি ধারকর্জের ব্যাপার থেকে থাকে তো তা ভেবে ঈদের দিন ক্ষণে ক্ষণে বুকটা ছ্যাঁৎ করে যে উঠবেই, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
এত সবের মধ্যেও সবকিছু মিলিয়ে ঈদের দিনটি আর সব দিনের চেয়ে যে আলাদা, তা স্বীকার করতেই হবে। ঢাকায় এই দিন তো বটেই, পরবর্তী দিন দুয়েক ঘুরে বেড়ানোর জন্যও দারুণ! শহরের লোক বেশির ভাগই হাওয়া হয়ে যায়। রাস্তা ফাঁকা, গাড়ি-ঘোড়াহীন। দেখলে অপরিচিত মনে হয়। ভিড়ভাড়ের গ্যাঞ্জাম নেই, ট্রাফিক লাইটের কাছে ভিখারি নেই ধরনের অন্য রকম চেহারা হয়ে যায়।
ভিখারির কথা যখন এলই, তো একটা ঘটনার কথা বলি। এটি অবশ্য আমার কার্টুনে আনা হয়নি কখনো।
ঘটনাটি গল্পাকারে বলেছিলেন আমার এক সহকর্মী। তিনি বনানীতে থাকেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের গাড়িতে আরও কয়েকজন শিক্ষকের সঙ্গে যাতায়াত করতেন। এটি বছর সাতেক আগের ঘটনা। সময়টা ছিল রমজান মাস। তো একদিন বিকেলে গাড়ি কামাল আতাতুর্কের ট্রাফিক লাইটে থামলে এক বৃদ্ধ ভিখারি ভিক্ষা চাইলে গাড়ির একজন বৃদ্ধকে চেনা চেনা মনে হওয়ায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘ও মিয়া, তুমি না শেরাটনের সামনে দাঁড়াইতা?’
বৃদ্ধ খুশি হয়ে বলল, ‘জি স্যার। অহন এইহানে আছি।’
শিক্ষক মহোদয় আবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘তা বদলাইলা ক্যান?’
ঈদের বাজার শুরুর আগে বৃদ্ধ ভিখারি একগাল হেসে বলল, ‘কয়েক দিন আগে মাইয়াডার বিয়া দিয়া দিছি। শেরাটন জামাইরে যৌতুক দিতে হইল, অহন আমি এইহানে...’
যৌতুক হিসেবে ভিক্ষার জায়গা জামাইকে দেওয়ার এই অভিনব গল্প শুনে খুব হেসেছিলাম।