অফিসের সেকাল-একাল

অফিসের ইতিহাসে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত ধরেই একসময় শুরু হয় বিস্তৃত ও জটিল আমলাতন্ত্র
অফিসের ইতিহাসে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত ধরেই একসময় শুরু হয় বিস্তৃত ও জটিল আমলাতন্ত্র

কর্মব্যস্ত নাগরিক জীবনে এখন পরিবার-পরিজন বা প্রতিবেশীদের সঙ্গে আমরা যতটা সময় কাটাই, তার চেয়ে ঢের বেশি কাটাই অফিসে, সহকর্মী ও ঊর্ধ্বতন নির্বাহীদের সান্নিধ্যে। আমাদের জীবনের লক্ষ্য, আঙ্গিক আর তাৎপর্য—সবকিছুই যেন এখন অফিসকে ঘিরেই আবর্তিত হয়।
মধ্যযুগে লন্ডনে সার্বিক জীবনযাত্রার ওপর গির্জার কঠোর নিয়ন্ত্রণ ছিল। আর আজকের যুগে সারা বিশ্বে নাগরিক জীবনের নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড়িয়েছে মানুষের নিজ নিজ কর্মস্থল বা অফিস।
ইংল্যান্ড তথা ইউরোপে শিল্পবিপ্লব শুরুর আগেই বিভিন্ন অফিসের কার্যক্রম শুরু হয়েছিল। অফিস গত ২০০ বছরে প্রায় সবকিছু বদলে দিয়েছে। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উদ্ভব ও বিকাশের নেপথ্যে অফিসের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। অফিস পাল্টে দিয়েছে বিপুলসংখ্যক নারীর জীবনধারা।
এখন প্রযুক্তির কল্যাণে প্রায় সব কাজ অফিসে না গিয়েই সেরে ফেলা যায়। তাই প্রশ্ন তোলা যায়, অফিসে আমাদের শারীরিক উপস্থিতির প্রয়োজন কেন? কর্মীদের প্রায় সবাই অধিক কাজের চাপ ও ব্যস্ততা নিয়ে আক্ষেপ করেন, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিয়ে অভিযোগ করেন, কিন্তু চাকরি ছাড়তেও পারেন না।
অফিস আসলে কী? সহজ ভাবনায়, প্রশাসকদের নির্দেশ বাস্তবায়নের স্থানই হচ্ছে অফিস, তা সেটা আকাশছোঁয়া ভবনই হোক আর মুঠোফোনের নিয়ন্ত্রণেই হোক। তবে এই সংজ্ঞায় অবশ্য কফিশপ আর মানুষের ঘর-সংসারও অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ে। আর আঠারো শতকের ইংল্যান্ডে এই দুটি স্থানেই বেশির ভাগ দাপ্তরিক কাজ সম্পন্ন হতো। মালিকেরা সাধারণত দোকানের ওপরতলায় বসবাস করতেন। আর কেরানিরাও ওই দোকানেই থাকতেন এবং তাঁদের অনেকটা ঘরের চাকরের মতো মনে করা হতো।
অফিসের ইতিহাসে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির তাৎপর্য অনেক। এই প্রতিষ্ঠানের হাত ধরেই একসময় শুরু হয়েছিল অত্যন্ত বিস্তৃত ও জটিল আমলাতন্ত্র। এশিয়া অঞ্চলের সঙ্গে দীর্ঘ দূরত্বে বাণিজ্য-ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নিয়ে ১৬৬০ সালে একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান হিসেবে যাত্রা শুরু করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। কিন্তু এটি একসময় ভারতে সাম্রাজ্য দখলে সমর্থ হয়। লন্ডনে কোম্পানির সদর দপ্তরে রক্ষণাবেক্ষণ করা হতো প্রয়োজনীয় যাবতীয় তথ্য। আর সেখান থেকেই প্রতিষ্ঠানটির সব আমলাতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত হতো।
ইস্ট ইন্ডিয়া হাউসে পদোন্নতি নিয়ে মন-কষাকষি হতো বিস্তর। এমনকি আত্মহত্যার নজিরও রয়েছে। রিচার্ড বারফোর্ড নামের একজন কর্মী ১৭৯০-এর দশকে একটি ভবনের জানালা দিয়ে লাফিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন। সেই ইস্ট ইন্ডিয়া হাউসে ১৭৯২ সালে কাজে যোগ দেন চার্লস ল্যাম্ব (১৭৭৫-১৮৩৪)। টেলস ফ্রম শেক্সপিয়ার বইয়ের জন্য খ্যাত এই লেখকের ভাষ্য, ‘শুক্রবার আমি অফিসে সকাল ১০টা থেকে (দুই ঘণ্টার বিরতি বাদে) রাত ১১টা পর্যন্ত কাজ করি।’
কাজের চাপ এড়াতে ল্যাম্বের মতো কেউ কেউ সৃজনশীলতার চর্চায় ঝুঁকলেও অফিসকর্মীদের অধিকাংশই ছিলেন নির্দেশ পালনের যন্ত্রমাত্র। পদোন্নতির কোনো সম্ভাবনা ছাড়াই টানা ৪০ বছর ধরে প্রতি সপ্তাহে ছয় দিন একই নিয়মে অফিসে যাওয়াই ছিল তাঁদের নিয়তি। এই সময়ের মধ্যে মারা গেলেই কেবল রেহাই পাওয়া যেত সেই ছকে বাঁধা জীবন থেকে।
৫০ বছর বয়সে চাকরি থেকে কৌশলে অবসর নেন ল্যাম্ব। তিনি লিখেছেন, ‘অবসরের প্রথম দু-এক দিন আমি স্থবির জীবন কাটাই, অযথা ঘোরাঘুরি করি, অলস সময় কাটাই আর নিজেকে সুখী ভাবতে শুরু করি; যদিও আমি জানতাম সুখ ব্যাপারটা আসলে এ রকম নয়। আমার অবস্থাটা ছিল বাস্তিল দুর্গের সেই পুরোনো কয়েদির মতো, যে কিনা টানা ৪০ বছর কারাবাসের পর আকস্মিক মুক্তি পেয়েছিল।’
পুরোনো অফিসে পরে আবার ঘুরতে যাওয়ার প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, ‘নিজের বহুদিনের ব্যবহূত চেয়ার-টেবিল ও অন্যান্য জিনিসপত্র অন্য কাউকে ব্যবহার করতে দেখার ব্যাপারটি অবধারিত হলেও মেনে নেওয়া সত্যিই কঠিন।’
প্রায় সব অফিসকর্মীর জন্যই ব্যাপারটা গড়পড়তা একই রকম। সারা জীবন তাঁরা অফিসের কর্মচক্র থেকে বেরিয়ে মুক্তিলাভের স্বপ্ন দেখেন। এ জন্য দীর্ঘ অপেক্ষা চলতে থাকে বছরের পর বছর। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত অবসর নেওয়ার পর মনে হয়, অফিসে কী যেন ফেলে এসেছেন। সেটা হয়তো তাঁদের নিজেরই একটা অংশ! অথচ সেই অবিচ্ছেদ্য অংশটির অস্তিত্বের কথা কেমন করে এতগুলো বছর অজানা ছিল!
 আশিস আচার্য, তথ্যসূত্র: বিবিসি অনলাইন ও ইন্টারনেট