গণিত থেকেই স্বপ্ন বোনা

ছবি: খালেদ সরকার
ছবি: খালেদ সরকার

গণিত অলিম্পিয়াডের অভিজ্ঞতা কিংবা এ থেকে জানার বা শেখার কথা জানতে চাইলে আমি বাংলাদেশ গণিত দলের কোচ মাহবুব মজুমদার স্যারের একটি কথা সবসময় বলি, ‘তোমার থেকে সমস্যা সমাধানে যে ভালো, সে তোমার থেকে বড় কোনো মগজ নিয়ে জন্মায়নি—সে কেবল সমস্যার মুখে হাল ছেড়ে দিতে জানে না।’
এই অলিম্পিয়াডের কথা আমি যখন প্রথম আবিষ্কার করি, তখন ২০০৯ সাল, আমি অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি। গণিতে আগ্রহ ছোটবেলা থেকেই একটু বেশি, তাই নিবন্ধন কিংবা অংশগ্রহণেও দেরি হয়নি খুব। সেই আঞ্চলিক অলিম্পিয়াডে আমার অবস্থান ছিল ঢাকার জুনিয়র বিভাগের বিজয়ীদের মধ্যে সর্বশেষ। সেই ফলাফল নিয়েই জাতীয় পর্যায়ে অংশগ্রহণ করি, আর সেবার ফলাফল হয় ঠিক উল্টো, জুনিয়র পর্যায়ে চ্যাম্পিয়নদের মধ্যে প্রথম; কিন্তু তখনো জানতাম না, কী নতুন আর বিশাল জগৎ অপেক্ষা করছে সামনে।
যথাসময়ে জুনিয়র ক্যাটাগরির হয়ে ক্যাম্পের জন্য ডাক পাই, জানতে পারি ‘গণিত’ বলতে আমাদের পাঠ্যবইয়ের বাইরেও যে অনেক কিছুই থাকতে পারে। প্রথম ক্যাম্পের অভিজ্ঞতায় পরিবারের কাউকে ছাড়া এতগুলো দিন থাকা কিংবা নিজের মতো থাকা আর চলা থেকেও বড় হয়ে দাঁড়িয়েছিল আমার মতো একই আগ্রহ নিয়ে বাংলাদেশের একেকটি কোনা থেকে আসা সবার সাথে পরিচয়। সেবার সাতটি দিন কেটে যায় গণিত আর গণিতের পাশাপাশি সবার অন্যান্য যা আগ্রহ ছিল, তাই নিয়ে আলোচনায়। প্রথম ক্যাম্পে ক্লাসে যা যা করানো হয়েছিল, অনেক কিছুই বুঝিনি। তার জন্য অল্প বয়স তো দায়ী ছিলই, আর চোখেরও একটা সমস্যা ছিল, যার জন্য তখন দূরের লেখা দেখতে পেতাম না (ক্যাম্প থেকে এসে ডাক্তারকে দেখিয়ে আবিষ্কার করি, আমি আসলে ৪০ সেন্টিমিটারের বাইরে কিছুই পরিষ্কার দেখতে পাই না!)। প্রথম ক্যাম্পে গণিতে খুব বেশি না এগোলেও যেটা তৈরি হয়, সেটা হল আবারও ক্যাম্পে যাওয়ার কিংবা গণিত অলিম্পিয়াডে ভালো করার প্রবল ইচ্ছা। পরের এক বছর সেই প্রস্তুতিই নিই, অপেক্ষা করতে থাকি পরের অলিম্পিয়াডের জন্য।
২০১০ সালের জাতীয় অলিম্পিয়াডে জুনিয়র ক্যাটাগরি থেকে চ্যাম্পিয়ন অব দ্য চ্যাম্পিয়নস নির্বাচিত হই। সেই বছরের ক্যাম্প আমার পরবর্তী সময়ে আন্তর্জাতিক অলিম্পিয়াডে ভালো করার শক্ত ভিত্তি তৈরি করে দেয়; আর সে বছরেরই ডিসেম্বরে শীতকালীন ক্যাম্পে ঠিক করি, এবারই চেষ্টা করব আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করার।
২০১১ সালে আমি দশম শ্রেণির ছাত্র, আর তখন পর্যন্ত এত অল্প বয়সে কেবল দুজনই বাংলাদেশের হয়ে আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণ করেছেন (তারিক আদনান মুন ও নাজিয়া চৌধুরী, পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের হয়ে ব্রোঞ্জ পদক বিজয়ী)। কাজটা এত সহজ ছিল না, কারণ ক্যাম্পে তখন একজন বাদে বাকি সবাই আমার থেকে বয়সে বড়। এর ওপর বাংলাদেশ গণিত দলের নির্বাচনী পরীক্ষা যখন সামনেই, তখন জানতে পারি যে একই সময়ে আমার স্কুলেরও পরীক্ষা। তাই বাবা-মাকে রাজি করিয়ে দল নির্বাচনী ক্যাম্পে আসার সময়ই জানা হয়ে গিয়েছিল, পেছনে ফিরে তাকানোর সুযোগ নেই।
ক্যাম্প শেষেই জানতাম দলে জায়গা পাব, কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয় আরও কিছুদিন পর। তখন থেকেই আন্তর্জাতিক পর্যায়ের জন্য প্রস্তুতি শুরু করি। সেই সময়ে প্রায় আড়াই মাস দিনে দশ-বারো ঘণ্টা করে কেবল গণিতচর্চা করতাম—আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডের আগের নানা প্রশ্ন, অন্যান্য দেশের অলিম্পিয়াডের প্রশ্ন—এসব, আর গুরুত্ব দিতাম জ্যামিতিতে। অবশেষে জুলাই মাসে বাংলাদেশ দলের সঙ্গে নেদারল্যান্ডসের আর্মস্টারডামে যাই, আরও ৯৯টি দেশের প্রতিযোগীদের সঙ্গে ৫২তম আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করতে। সেবার অলিম্পিয়াডে প্রশ্নের ধারা অন্যান্য বছর থেকে অনেকটাই আলাদা (এবং অপ্রত্যাশিত) হওয়ায় আমাদের দলের ফলাফল স্বাভাবিক থেকে খারাপ হয়। আমি নিজে তিনটি সমস্যা থেকে আংশিক নম্বর পেলেও কোনোটারই পূর্ণ সমাধান করতে পারিনি।
এ কারণেই ২০১২ সালের জন্য অনুশীলনে গণিতের ভিন্ন ভিন্ন বিষয় একসঙ্গে আয়ত্ত করার চেষ্টা চালাতে থাকি। জাতীয় অলিম্পিয়াডে সেকেন্ডারি পর্যায় থেকে সেবার চ্যাম্পিয়ন অব দ্য চ্যাম্পিয়ন হই, আবার জাতীয় ক্যাম্প বা দল নির্বাচনী ক্যাম্প পার করে নির্বাচিত হই বাংলাদেশ দলের সদস্য হিসেবে। সেবার আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াড ছিল আর্জেন্টিনার মার ডেল প্লাটায়। এবার অবস্থা আমাদের অনুকূলে হওয়ায় বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো রৌপ্যপদক জয় করে আনে, আর তখন পর্যন্ত বাংলাদেশের হয়ে সবচেয়ে কম বয়সে আমি ব্রোঞ্জপদক জয় করি। সেবার এমন একটি সমস্যায় পূর্ণ সমাধান করি, যেটাতে অনেক দক্ষ প্রতিযোগীও অসাবধানতার জন্য কিছু না কিছু ভুল করেছিল।
সে বছরই আবার আমি নির্বাচিত হই আন্তর্জাতিক ইনফরমেটিকস অলিম্পিয়াডের বাংলাদেশ দলেও, যেটা স্কুল-কলেজ পর্যায়ে বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতা। সেপ্টেম্বর মাসে একই সঙ্গে দুটি ভিন্ন আন্তর্জাতিক অলিম্পিয়াডে বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করা সর্বকনিষ্ঠ প্রতিযোগী হিসেবে সেখানে অংশগ্রহণ করতে যাই ইতালির সিরমিওন শহরে।
তুলনামূলকভাবে আমার জন্য ২০১৩ সাল ছিল অনেক বেশি সাদাকালো, এবারও জাতীয় অলিম্পিয়াড, জাতীয় ক্যাম্প, বর্ধিত ক্যাম্প পার করে দলের জন্য নির্বাচিত হই, কিন্তু দলের আকৃতি কমে দাঁড়ায় চারজনে, যেখানে একটি দেশ থেকে স্বাভাবিকভাবে অংশগ্রহণ করে ছয়জন। কলম্বিয়ার সান্তা মার্তা শহরের সেই অলিম্পিয়াডে শতাধিক দেশের মধ্যে অল্প প্রতিযোগী নিয়েও আমরা দেশভিত্তিক র্যাঙ্কিংয়ে শক্ত অবস্থান ধরে রাখি, কিন্তু প্রশ্নের ধরনে একটি অঘোষিত পরিবর্তন আমাদের ব্যক্তিগত ফলাফলে প্রভাব ফেলে। মাত্র ৩ নম্বরের জন্য আমার রৌপ্যপদক হাতছাড়া হয়ে যায়, আরও একটি ব্রোঞ্জ নিয়ে দেশে ফিরে আসতে হয়।
সেবার দেশে ফেরার পর থেকেই নানা দিক থেকে আসা সমস্যায় পড়তে হয়; যেমন এত দিন গণিত অলিম্পিয়াডের পেছনে সময় দেওয়ার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনায় যে অবহেলা হয়েছে, তার ক্ষতিপূরণ। এমনকি ২০১৩ সালে দল নির্বাচনী পরীক্ষার জন্য ঢাকা কলেজের প্রথম বার্ষিক পরীক্ষায় একটি বিষয় দিতে পারিনি, যদিও কলেজের অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষের সহযোগিতায় সেবার কোনো সমস্যা হয়নি। সে জন্য গণিতের বাইরেও অনেক সময় ব্যয় করতে হয় একাডেমিক পড়াশোনার পেছনে। মাঝে জাতীয় অলিম্পিয়াডে সেকেন্ডারি, হায়ার সেকেন্ডারি ক্যাটাগরিতে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে চ্যাম্পিয়ন অব দ্য চ্যাম্পিয়ন হই। সামনে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা, আবার এর পরপরই আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াড, এমন দোটানার মাঝে চলতে থাকে দিন। এইচএসসি যখন শেষ হয়, তখন অলিম্পিয়াডের আগে বাকি ছিল মাত্র এক মাস। এই অল্প প্রস্তুতিতে কীভাবে দেশের জন্য ভালো কিছু করব, সেই চিন্তা থেকেই দিনে ১২-১৪ ঘণ্টা গণিত চর্চা চালাতে থাকি; এমনকি ফ্লাইটের সাত দিন আগে অসুস্থ হয়ে পড়ি। কিন্তু যেহেতু এবারের পর আর এই প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারব না, তাই কিছু করার চেষ্টায় হাল ছাড়িনি।
দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ টাউনে অনুষ্ঠিত হয় ২০১৪ সালের ৫৫তম আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াড। দক্ষিণ গোলার্ধে অবস্থান, তাই পরীক্ষার হলে এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছিল, যেন হাতমোজা খুললেই হাত জমে যায়, লিখতে পর্যন্ত পারা যায় না। তার মধ্যে আবার প্রশ্ন ছিল কম্বিনেটরিকস প্রধান, যা আমাদের অনুকূলে ছিল না। তবু এর মধ্যে দলের সবাই আমাদের সর্বোচ্চটুকু দিয়ে আসি। এর পরই যখন আমাদের দলের পর্যবেক্ষকের কথায় জানতে পারি আমি রৌপ্যপদক জয় করেছি, তখন মনে হয়েছিল এই দীর্ঘ যাত্রা অবশেষে সাফল্য দিয়েই শেষ হলো।
এখানেই অবশ্য শেষ নয়। আমার প্রথম ক্যাম্পে আমাদের উপদলনেতা ও গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির সাধারণ সম্পাদক মুনির হাসান স্যারের একটা কথা এখনো কানে বাজে—আমরা আগে বলতাম ‘জ্ঞানই শক্তি’, কিন্তু আজকের দুনিয়ায় সবচেয়ে বড় শক্তি হল জ্ঞান ছড়িয়ে দেওয়া। সে জন্যই ২০১১ সাল থেকেই ক্যাম্পে ক্লাস করার পাশাপাশি ক্লাস নিচ্ছি এবং ভবিষ্যতেও নেব, পরবর্তী সময়ে যারা দেশের পতাকা তুলে ধরবে, তাদের তৈরি করার জন্য।
গণিত অলিম্পিয়াডে আমরা বলি ‘গণিত শেখো, স্বপ্ন দেখো’। এই ছোট্ট দেশের মানুষের বড় বড় স্বপ্নগুলো পূরণ করতে তাই আমরা লেগে থাকি দিনরাত, নিজেরা স্বপ্ন দেখি, অন্যদের মধ্যে স্বপ্নের গল্প ছড়িয়ে দিই, আর চেষ্টা চালিয়ে যাই, যেন আজকের বাংলাদেশ গতকালের থেকে একটু বেশি সুখী আর সুন্দর হয়।
নূর মোহাম্মদ শফিউল্লাহ: আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে রৌপ্য ও ব্রোঞ্জ পদক বিজয়ী।