প্রতিবন্ধী মানুষের বাসযোগ্য স্বদেশের খোঁজে!

ছবি: সৌরভ দাশ
ছবি: সৌরভ দাশ

সেই অনেক আগে... ঝিম ধরা একলা দুপুরগুলোতে ঝমঝম করে কী যেন বেজে উঠত মাথার ভেতর। একটানা বেজেই চলত। স্কুল থেকে একা একা ফিরতাম এ রকম সব দুপুরবেলায়। বন্দরের বড় রাস্তার ট্রাক-বাসের যন্ত্রণা এড়াতে মাঝে-সাঝে শর্টকাট ধরেছি। ওই রাস্তাটা একে বেশ নির্জনতায় আবার ছোট্ট এক নালা এক লাফে পেরোতে হতো। সবার মতো পারতাম না, তাই ভয় জমা হতো মনের কোণে। তবু প্রকৃতির কাছাকাছি হওয়ার এক অমোঘ টানে পা বাড়িয়েছি এই নির্জনতার দিকে। ছোট্ট নালার পাশে দুরু দুরু বুকে বসে ভাবছি, কষ্ট হলেও পেরোতেই হবে। ওপারে পা রেখে এপারে হাতে ভর করে এলোমেলোভাবে কিসের এক অজানা শক্তিতে যেন পেরিয়েও গিয়েছি ঠিক ঠিক। অথচ প্রতিবারই মনে হতো এবার বুঝি পারলাম না! তারপর নার্স কলোনির নির্জন দুপুরের গা ছমছমে এবড়োখেবড়ো রাস্তাটা পেরোলেই আমাদের বন্দর হাসপাতাল কলোনির সিমেন্টের পিচঢালা রাস্তা। আমাদের বিল্ডিং সামনে আসতে না আসতেই মাথার ওপরে মস্ত আকাশের এপার থেকে গড়িয়ে ধীরে ধীরে সূর্যিটা বড় রাস্তার ওপারে বটগাছের ঠিক মাথার কাছটায় তখন। আমি বিল্ডিংয়ের ছায়ায় ঢুকে টের পেতাম রোদ্দুর ঢুকে গেছে মাথার ভেতর। ঝমঝম বেজেই চলেছে ...বেজেই চলেছে ...
শুনেছি ছেলেবেলায় পৃথিবীর বুকে আমার আগমনী মুহূর্ত প্রভাতি রোদ্দুর তার নরম আভায় চারপাশ আলোকিত করে আমায় স্বাগত জানিয়েছিল। এর পরেই কোনো এক বিকেলে বাবা অফিস থেকে এসে পিচ্চি আমাকে কোলে নিয়ে মাকে বলেছিলেন, ‘আজ পোর্টে একটা আমেরিকান জাহাজ এসেছে। SABRINA! আমার মেয়ের নামও হবে সাবরিনা। এই নাম নিয়ে সে করবে বিশ্বজয়।’ মাঝে-সাঝে ভাবি, এত স্বপ্ন নিয়ে বাবা নামটি রাখার সময় ঘুণাক্ষরেও কি ভেবেছিলেন এই নামের শাব্দিক অর্থ তাঁর মেয়ের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে যেতে যাচ্ছে! জানা নেই, তবে বুঝতে শেখার বয়স হতেই কেবলই দেখেছি, যেদিকে হাত বাড়াই সেদিকেই ‘না’। বইখাতায় ব্যাগ ভরিয়ে স্কুলে যাব, শিক্ষকের বাধা। দুই বেণি ঝুলিয়ে দস্যিপনায় পাড়া মাতাব, সামাজিক বাধা। অবকাঠামোগত এবং যাতায়াত প্রধান সমস্যা, শারীরিক অক্ষমতা যেন অভিশাপ! কিন্তু ব্যাপারটা অন্য কোথাও, জানলাম আমি সবার চেয়ে আলাদা। ‘প্রতিবন্ধী’ সমাজের এই নতুন নামকরণ এবং কটাক্ষ চাহনিতে বাবা-মা খানিকটা বিব্রত। অনুভব করতে শুরু করলাম সমাজের অগুনতি প্রশ্নবোধক দৃষ্টির আড়ালে হারিয়ে যাচ্ছে বাবার স্বপ্নগুলো। চোখের সামনে বেড়ে ওঠা ভাইবোনের আনন্দ-উচ্ছ্বাস কলতানে নিজেকে হারিয়ে ফেলছি ধীরে ধীরে। তাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গঠনে পরিবার ও সমাজের সে কী বিশাল আয়োজন। সবার তত্ত্বাবধানে নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে ওদের এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং এগিয়ে চলা। আর আমি, একই পরিবারে হয়েও তাদের আর আমার মাঝেকার দূরত্বটুকু কী ভীষণ! কোনো লক্ষ্য নেই, সমুজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন নেই, চার দেয়ালের নিভৃতে গুমরে মরে আকুতিগুলো। আচমকা ঘর থেকে বেরোলেও হাজারো প্রতিবন্ধকতার মাঝে মানুষের নানাবিধ প্রশ্নের তোড়ে বাবা-মায়ের অসহায় চাহনি, আমার আনন্দ গুটিয়ে যায়।
মন বিদ্রোহী হয়ে উঠতে লাগল। ছেলেবেলা থেকেই যেখানে বাধা, সেদিকেই পা বাড়ানোর প্রবল স্পৃহা আমায় শক্তি জোগাল নতুন করে ভাবার-জানার। যা জানলাম কিছুটা হতবাক, এ দেশে আমি একা নই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান বলছে, প্রায় ১৫ ভাগ মানুষ বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধিতার সম্মুখীন হয়ে মৌলিক অধিকারবঞ্চিত। বেশির ভাগ আমার মতোই শিক্ষা, চাকরি, বিনোদন, যাতায়াত ও সর্বত্র প্রবেশাধিকারবঞ্চিত হয়েও সমাজের মূলধারায় অংশ নেওয়ার তীব্র আগ্রহে দিন কাটাচ্ছে, যাদের জন্য জাতিসংঘের কনভেনশন অন দ্য রাইটস অব পারসনস উইথ ডিজঅ্যাবিলিটিস (সিআরপিডি) সনদ অনুযায়ী সারা বিশ্বে আজ স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে পারসনস উইথ ডিজঅ্যাবিলিটিস সম্বোধনটি। এর বাংলা করে বাংলাদেশে প্রতিবন্ধী মানুষ/ব্যক্তি ব্যবহৃত হলেও নাম নিয়ে রয়েছে নানা দ্বিমত। ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তি’ সম্বোধন করতে চান না অনেকেই। যদিও নিজের প্রতিবন্ধিতা নিয়ে আমি একেবারেই লজ্জিত নই। প্রতিবন্ধিতার সম্মুখীন হওয়া মানেই অসুস্থ/অক্ষম বা রোগী নই আমরা, বরং সামাজিক ও অবকাঠামোগত প্রতিবন্ধকতাই আমাদের স্বাধীনতায় প্রধান বাধা। সামান্য সম্বোধনে বৃথা তর্কে সময় নষ্ট না করে এই জনগোষ্ঠীর সামাজিক উন্নয়ন ও অধিকারের বিষয়গুলো সুনিশ্চিতের লক্ষ্যে মাথা ঘামানো দরকার। একটি মানুষের সমাজে মাথা উঁচু করে বাঁচতে শিক্ষার বিকল্প নেই। উন্মুক্ত চলাচলে যেখানে আপনাদের সিঁড়ি প্রয়োজন, আমাদের সেখানে র্যামপ, ব্রেইল ব্লক, টেকটাইল দিকনির্দেশনা ইত্যাদি। সবার পড়ালেখার পদ্ধতিতে না মিললেও একই শিক্ষালয়ে একত্রেই তা সম্ভব। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের ব্রেইল পদ্ধতি, শ্রবণ ও বাক্প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের ইশারা ভাষার ব্যবস্থা এবং অন্য সবার চাহিদা অনুযায়ী সব ধরনের অবকাঠামোগত ব্যবস্থার পাশাপাশি উপযুক্ত প্রশিক্ষিত শিক্ষক নিযুক্ত থাকলে সব প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর সঙ্গেই অপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের একত্রে পড়ালেখা, অর্থাৎ একীভূত শিক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিত হতে পারে। যা ২০১০ সালে জাতীয় শিক্ষানীতিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল কাগজে-কলমে। অন্যদিকে সিআরপিডির ৯ নম্বর ধারায় প্রবেশগম্যতাকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে সিআরপিডির ২৪ নম্বর ধারায় এবং সদ্য পাসকৃত প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন ২০১৩-তেও বলা হয়েছে, প্রতিবন্ধী মানুষের শিক্ষাকে নিশ্চিত করতে ভর্তির ক্ষেত্রে বৈষম্যে করা তো যাবেই না, উপরন্তু রিজনেবল অ্যাকোমোডেশন বা সর্বক্ষেত্রে সংগতিপূর্ণ বন্দোবস্ত রাখতে হবে। যদিও থমকে রয়েছে এই নতুন আইনের বিধি প্রণয়নের কাজ। আবার জাতীয় ইমারত নির্মাণ বিধিমালায় সর্বজনীন প্রবেশগম্যতার অংশে প্রতিবন্ধী মানুষের এই অবকাঠামো ব্যবস্থা মেনে চলতে তাগিদ দেওয়া হলেও আমরা কজনে মেনে চলি তা!
সমস্যাগুলোর শেষ নেই যেন! নারী সংগঠনগুলোর জন্য স্বতন্ত্র নারী অধিদপ্তর নারীর চাহিদা নিশ্চিতের আন্দোলনে নারীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করেছে। তারা নিজেদের ক্ষমতায়নে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পেরেছে। প্রতিবন্ধী মানুষের জীবনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ-প্রক্রিয়ায় প্রতিনিধিত্বের চর্চা বা সংস্কৃতি এ দেশে শুরু হয়নি, কিন্তু প্রতিবন্ধী মানুষের অধিকার ও প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে সর্বস্তরে তাদের প্রতিনিধিত্ব এবং ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা জরুরি। রাষ্ট্রব্যবস্থার সিদ্ধান্ত গ্রহণ-প্রক্রিয়ায় তাদের অংশগ্রহণের অধিকার রয়েছে। প্রতিবন্ধী মানুষের দ্বারা পরিচালিত সংগঠনগুলোকে আমরা প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সংগঠন বা ডিপিও বলি, অগ্রগতির চিন্তা থেকেই তাদের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন আলাদা অধিদপ্তরের। প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনকে অধিদপ্তরে রূপান্তরিত করতে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা আমাদের জন্য যেমন আনন্দদায়ক, তার চেয়ে বেশি দুঃখজনক বছর গড়াতে চললেও ফাউন্ডেশন বিলুপ্তির উদ্যোগ না নেওয়া। ইতিবাচক পরিবর্তনের জন্যই আলাদা অধিদপ্তর বাস্তবায়ন ও পরিচালনায় প্রতিবন্ধী মানুষের অন্তর্ভুক্তি প্রয়োজন। নতুবা প্রতিবন্ধিতাবিষয়ক কার্যক্রমগুলো যেভাবে দীর্ঘসূত্রতার জালে আবদ্ধ হয়ে থাকে, অপ্রতিবন্ধী নেতাদের অধীনে পূর্বাবস্থাতেই দাঁড়াবে অধিদপ্তরের কার্যক্রমও। প্রতিবন্ধী মানুষের উন্নয়নে গৃহীত প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি ও তাদের অধিকারবিষয়ক নীতি সংশ্লিষ্ট কমিটিগুলোতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে এবং নতুন আইনে এই বিষয়টি সংশোধন এবং আইনের বিধিমালায় এর সুস্পষ্ট উল্লেখ থাকা অত্যন্ত জরুরি বলেই মনে হচ্ছে।
তার জন্য প্রতিবন্ধী মানুষকে এবং তার পরিবারকেও নিজ নিজ অধিকার সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। প্রতিবন্ধিতা মানেই জীবন শেষ হয়ে যাওয়া নয়, তাকে শুধু এই মানসিক শক্তিটুকু দেওয়া প্রয়োজন; এ অবস্থা নিয়েই স্বাভাবিক জীবনযাপন সম্ভব। আমাদের বিশ্বাস, সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টাতেই গড়ে উঠবে আমাদের স্বপ্নের বাংলাদেশ। অপ্রতিবন্ধী এবং প্রতিবন্ধী মানুষ-নির্বিশেষে সবার সহায়ক ব্যবস্থাসংবলিত বাসযোগ্য একটি দেশ।
সাবরিনা সুলতানা: প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, বাংলাদেশ সোসাইটি ফর দ্য চেঞ্জ অ্যান্ড অ্যাডভোকেসি নেক্সাস (বি-স্ক্যান)।