শুনতে কি পাও!

ছবি: খালেদ সরকার
ছবি: খালেদ সরকার

হোটেলে ব্যাগ গোছাচ্ছি, পরদিন সকালে ফ্লাইট। এর মধ্যে স্বয়ং উৎসব পরিচালকের ফোন, ‘তুমি কোথায়?’ রিচার্ড রজাস আর রেনজো পিয়ানোর মতো স্থপতিদের ঝকমারি ডিজাইনে জগৎখ্যাত পম্পিদ্যু সেন্টার, প্যারিসের শিল্পী-বোদ্ধাদের অন্যতম মিলনকেন্দ্র। ২১ থেকে সেখানেই শুরু হয়েছে ‘সিনেমা দ্য রিলে’, বিশ্বের অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ প্রামাণ্য চলচ্চিত্র উৎসব। আমি এসেছি ২৬শে আর আজকে ৩০, উৎসবের শেষ দিন। গত পাঁচ দিনে বাংলাদেশ থেকে এসেছি শুনে খুব একটা উৎসাহ দেখায়নি কেউ। আর আজকে সরাসরি পরিচালকের ফোন! তাড়া করে বের হলাম, ওভারকোট, পাঞ্জাবি, ফতুয়া, গেঞ্জি পার করে খোঁচা দিচ্ছে এপ্রিলের কনকনে বাতাস, মাথায় ঘুরছে ভদ্রা নদী, সুতাখালী গ্রাম। 
ভদ্রা নামটার মানে কী, ভেবেছি অনেক দিন। চায়ের দোকানে বসে জিজ্ঞাসা করেছি মান্নান ভাইকে। সারা গ্রামের মানুষ মান্নি করে মান্নান ভাইকে। দশাসই চেহারা, বিশাল শরীর। বাঘ পড়লে মান্নান, মারামারি লাগলেও মান্নান, পূজার মৌসুমে পাঁচ গ্রামের মানুষ বায়না করে নিয়ে যায় তাকে কাবাডি খেলার জন্য। মান্নান ভাই বললেন, ‘আমাগের এ নামের কুনো মানে নাই দাদা।’ আমি নদীর পাড়ে চুপ করে বসে থাকি, দেখতে পাই অদ্বৈত মল্লবর্মণের তিতাস-নামা, ‘পুঁথির পাতা পড়িয়া গর্বে ফুলিবার উপাদান এর ইতিহাসে নাই সত্য, কিন্তু মায়ের স্নেহ, ভাইয়ের প্রেম, বৌ-ঝিয়েদের দরদের অনেক ইতিহাস এর তীরে তীরে আঁকা রহিয়াছে, কে বলে তিতাসের তীরে ইতিহাস নাই!’
‘ক্যামেরার একটা ল্যাঙ্গুয়েজ আছে, শট-ডিভিশন আছে, ফ্রেমিং আছে, আপনি সেটাকে ডিনাই করছেন।’ সুহৃদ ক্যামেরাম্যানকে বোঝানোর চেষ্টা করি, ‘আমি ডিনাই করছি না। আমি বলছি, কেউ না কেউ ল্যাঙ্গুয়েজটা তৈরি করে। বাকিরা যখন সেটা বুঝতে পারে, ব্যবহার করে। তখন সেটাই নতুন ল্যাঙ্গুয়েজ হয়ে দাড়ায়।’ বাণিজ্য-বিজ্ঞাপন আসক্ত বন্ধু ক্যামেরাম্যান মানতে নারাজ, ‘ওয়াইড’ শট বললেও সে দূরে গিয়ে ‘টেলি’তে ফ্রেম করে। অগত্যা আরেক ক্যামেরাম্যান বন্ধুকে ধরে নিয়ে যাই। একদিন বাদে ফ্রাস্ট্রেট্রেড হয়ে সে প্রশ্ন করে, ‘আপনার স্পেসিফিক গল্পটা কী?’ আমি বিপদের গন্ধ পাই, বলি ‘আমার তো কোনো স্পেসিফিক গল্প নাই, আমি একটা গ্র্যান্ড ন্যারেটিভ খুঁজছি।’ ক্যামেরাম্যানের পাল্টা জবাব, ‘সে তো বুঝলাম, কিন্তু সেই গ্র্যান্ড ন্যারেটিভের নায়ক-নায়িকা কারা?’ বললাম, ‘নায়ক-নায়িকা, প্রেম-ভালোবাসা ছাড়া কি ছবি হয় না? এই যে জনপদ, সহজ মানুষ, তাদের সহজতর যাপিত জীবন, সেটা কি ছবির বিষয় হতে পারে না?’ সহকারী বোঝায়, ‘এভাবে শুটিং হয় না।’ কেউ কেউ আবার কিছু না বলেই চলে যায়। আমি কারও দোষ দিতে পারি না। শুটিং বলতে যা বোঝায়, এ তো আর তা না! নদীর পাড়ে প্রাতঃকৃত্য, খাবার বলতে ল্যাটকা খিচুড়ি আর ঘুম হয় নৌকার চালে নয় পাড়ের টঙে। তবু চেষ্টা করি, বলি, ‘এই ছবি এইভাবেই বানাতে হবে, এর অন্য সহজ উপায় নাই।’ আমার উত্তর তাদের পছন্দ হয় না। অগত্যা ক্যামেরা নিজ হাতে তুলে নেই। হাতে একগাছা দড়ি মনে হয়, আমি ছুটে ছুটে যাই ফড়িং আর দোয়েলের খোঁজে।
‘কত ঘণ্টা রাশ?’ ভীতভাবে উত্তর দিই, ‘১৭০ ঘণ্টা।’ অস্থিরতা টের পাই ফোনের স্পিকারে, মানে? আমি বোঝাবার চেষ্টা করি, ‘আমার শুটিং রাশ হলো ১৭০ ঘণ্টার।’ অবিশ্বাসের সুরে সম্পাদক বন্ধুর প্রশ্ন, ‘আপনার সাথে বসে ১৭০ ঘণ্টার রাশ দেখতে হবে?’ পেশাদার সম্পাদক, আমি অস্বস্তি নিয়ে বলি, ‘মানে, পারিশ্রমিকের বিনিময়েই।’ সামনেই ঈদ, নাটকের মৌসুম। বিরক্তি চেপে সম্পাদক উত্তর দেন, ‘পরে কথা বলছি।’ বুঝলাম, এখানে হবে না। আমস্টারডামে দেখা হোল শান্তিদার (নীলোৎপল মজুমদার, সত্যজিৎ রায় ফিল্ম এবং টেলিভিশন ইনস্টিটিউট/ এসআরএফটিআইয়ের সম্পাদনা বিভাগের সাবেক প্রধান এবং বর্তমান ডিন) সাথে। ইডফার (ইন্টারন্যাশনাল ডকুমেন্টারি ফেস্টিভ্যাল অব আমস্টারডাম) সান্ধ্য-আড্ডায় বুঝিয়ে বললাম আমার আইডিয়াটা, আমি চাই সম্পাদনা যেই করুক, আমার সাথে বসে গোটা রাশটা দেখতে হবে। আমি যে ল্যাঙ্গুয়েজটা করে দেখতে চাইছি সেটা, তা নইলে বোঝাতে পারব না।’ বিশ্বের বৃহত্তম প্রামাণ্য উৎসব ইডফা, জাঁকজমকপূর্ণ জলসায় অবারিত আপ্যায়ন, কমবেশি সবাই তরল। শান্তিদা আবেগে আক্রান্ত হয়ে পড়লেন। জানলাম, তাঁর আদি বাড়ি নোয়াখালী। ১৯৫০-এর দাঙ্গায় পরিবারের প্রায় সবাইকে হারিয়ে দেশছাড়া। স্নেহভরে বললেন, ‘এভাবে ভাবিস তোরা বাংলাদেশে!’ শান্তিদার কাছে খোঁজ পেলাম তার প্রিয় ছাত্র সৈকতের (সৈকত শেখরেশ্বর রায়, সহকারী অধ্যাপক, এসআরএফটিআই)। যোগাযোগ করতে সৈকত উত্তর দিল, ‘আমার হাতের ছবিটা শেষ হতে তিন মাস লাগবে। তা ছাড়া আমি আসলে তোমার সাথে বসে গোটা রাশটা দু-একবার না দেখলে শুরুও করতে পারব না। তোমার দেরি হয়ে যাবে, তুমি বরং অন্য কাউকে দেখ।’ আমি পাল্টা লিখলাম, ‘ছয় মাস অপেক্ষা করব, কিন্তু সম্পাদনা আমি তোমার সাথেই করব।’
‘এবার শেষ কর।’ প্রযোজক সারা আফরীনের আকুতি, ‘ক্লাস ড্যানিয়লসনকে একটা উত্তর দিতে হবে।’ ক্লাস ডক-লাইপজিগের পরিচালক, অদ্ভুত যোগাযোগে পরিচয় ওর সাথে। এসআরএফটিআইতে চলছে আইডিয়া পিচিং-ফোরাম ডকএজ-কলকাতা, ক্লাস সেখানে এসেছে মেন্টর হয়ে আর আমি গিয়েছি শুনতে কি পাও!-এর গল্প বলতে। ছবি তখনো শুরুই হয়নি, গ্রুপ ডিসকাশনেই আমি নাস্তানাবুদ। পিচিংয়ের আগের দিন মন খারাপ করে বসে আছি লাইব্রেরিতে, সারাকে বলে দিয়েছি, ‘পিচিং আমি করব না।’ লাঞ্চের পর ব্রেকে ক্লাস যাচ্ছিল অন্য মেন্টরদের সাথে কলকাতা ঘুরতে। আমাকে দেখে এসে বসল টেবিলে। কথা বলল। কথা বলাল, ওর নিজের গল্প, আমার গল্প, শুনতে কি পাও!-এর গল্প, ঝাড়া তিন ঘণ্টা! লাইব্রেরিয়ান তাড়া দিল বন্ধ করবে বলে। ক্লাস বলল, ‘দেখো, পিচ করা না-করাটা তোমার সিদ্ধান্ত। কিন্তু তুমি যদি ছবিটা না বানাতে পারো, তাহলে তার ব্যর্থতা কিন্তু তোমারই। আমি তোমার ছবির অপেক্ষায় থাকব।’ সেই ক্লাস প্রায় তিন বছর পর চিঠি লিখেছেন ছবির রাশ-লাইন-আপ দেখে, ‘তুমি হয়তো ইডফার আমন্ত্রণও পেয়েছ, তোমার ছবির অভিষেক তুমি বৃহত্তম প্রামাণ্য উৎসবে চাইতেই পারো। কিন্তু এটা তোমার প্রথম ছবি, শত শত বাঘা নির্মাতার দৌড়ে ওখানে সেটা হারিয়ে যাবে। তুমি যদি ছবিটা আমাকে দাও, আমি তাহলে প্রামাণ্য প্রাচীনতম উৎসবের (ডক লাইপজিগের) উদ্বোধনী রাতের ছবি বানাব এটাকে।’
‘তুমি সমাপনীতে থাকছ তো?’ মুম্বাই আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে পরিচালকের প্রশ্নে প্যারিসের কথা মনে পরে গেল। সেবারও পরিচালক নিশ্চিত হতে চাইছিল। কারণ সে জানত, শুনতে কি পাও!কে উৎসবের সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘গ্রাপ্রি’ দেওয়া হচ্ছে। ভারত সরকারের উদ্যোগে এশিয়ার অন্যতম প্রাচীন মর্যাদাপূর্ণ প্রামাণ্য উৎসবের পরিচালক, জাঁদরেল আইসিএস অফিসারের অমায়িক প্রস্তাব, ‘টিকিট চেঞ্জ করে দিচ্ছি, সমাপনী পর্যন্ত থেকে যাও।’ নয় দিনের উৎসবে ছয় দিন ফ্যা ফ্যা ঘুরে বেরিয়েছি, বাংলাদেশ শুনে অনেকেই মুখ ঘুরিয়ে হাঁটা দিয়েছে। তাই বেলা শেষে পরিচালকের এই আদরে মজা পেলাম, বুঝলাম কিছু একটা আছে। টেকনিক্যাল ক্যাটাগরিতে ‘বেস্ট সিনেমাটোগ্রাফি’ পুরস্কার ঘোষণা করল, অবাক হলাম না, স্টেজে গিয়ে পুরস্কার নিয়ে এলাম। কিন্তু শেষে যখন উৎসবের সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘স্বর্ণশঙ্খ’-এর জন্য শুনতে কি পাও!-এর নাম ঘোষণা করল, আমি নির্বাক হয়ে গেলাম। দেখি, হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছেন শ্যাম বেনেগাল, আদুর গোপাল কৃষ্ণাণ। মনে পড়ে গেল কপিলাকে। ঢাকা শহরে জন্ম আমার, বুড়িগঙ্গাকে আমি জীবিত দেখি নাই। নদী বলতে ভদ্রাই আমার প্রথম প্রেম। সেই কোনকালে মাথাটা খারাপ করেছিল সুলতানের আদম সুরত, ছেলেবেলার বন্ধু জীবনানন্দ শিখিয়েছিল পাকা বেতফল,
সোনালী ডানার চিল, ইলিশ ধরতে পদ্মায় নিয়ে গিয়েছিল কুবের, নেশা ধরে গিয়েছিল বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে। এদের খুঁজতেই গিয়েছিলাম সুতারখালীতে, আজ এত দিন পরে উৎসবের ডাকে তাই মনে ভয় পাই, মনে হয় কপিলাদের হারাই!
কামার আহমাদ সাইমন: চলচ্চিত্রকার।