আলোকচিত্র আমার ভাষা ও হাতিয়ার

ছবি: হাসান রাজা
ছবি: হাসান রাজা

আলোকচিত্রের পৃথিবীতে পা রেখেছি খুব বেশি দিন হয়নি। সাত বছর মাত্র। ২০০৭-এর মাঝামাঝি, আনুষ্ঠানিকভাবে আলোকচিত্রের হাতেখড়ি নিই ‘পাঠশালা, সাউথ এশিয়ান মিডিয়া ইনস্টিটিউট’-এ। শিখি আলোকচিত্রের অ-আ-ক-খ, এক্সপোজার, শাটার স্পিড, আইএসও, লাইট, কম্পোজিশন, ছবির সমাজ, রাজনীতি আরও অনেক কিছু। তখনো জানি না, এই জগতে আমারও কিছু করার আছে। কলেজ পাড়ি দিতে দিতে আমি যখন আলোকচিত্রের এত সব বর্ণমালা, শব্দ, ব্যাকরণের সঙ্গে পরিচিত হয়ে উঠিনি, তখনই কম্প্যাক্ট ক্যামেরায় ছবি তোলার সুযোগ হয়। রক্ষণশীল পরিবারে অনেক ভয়ে ভয়ে বাবার কাছ থেকে আবদার করে ক্যামেরাটা পেয়ে যাই। যদিও ছবি তোলার প্রতি এই আগ্রহের পেছনের যথাযথ কারণটা তখনো নিজের কাছে স্পষ্ট নয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরো সময়জুড়ে ক্যামেরা ছিল আমার সঙ্গী। ছাত্রসংগঠনের কর্মী হওয়ার বদৌলতে সভা-সমিতির ছবি তোলা ছিল অভ্যাস। কোথাও ঘুরতে গেলে সেখানেও ক্যামেরা থাকত সঙ্গে। যদিও তখন টাকা দিয়ে এত এত ফিল্ম কেনার সুযোগ সব সময় ছিল না। ওই সময়েই নিজের ভালো লাগা-মন্দ লাগার কারণগুলো খুঁজতে শুরু করি। মাঝেমধ্যে মনে হতো নিজেকেই চিনছি না। কেন কী করি সব যেন ধোঁয়াশে। সমাজের নানা টানাপোড়েনে নিজের মধ্যে জমাট বিচ্ছিন্নতা কিংবা অসম্মানের পীড়া বাসা বাঁধত। ক্রমে রাজনৈতিক বোঝাপড়া নিজেকে চিনতে, চারপাশকে বুঝতে, প্রশ্ন করতে শেখায়। আস্তে আস্তে নিজের ভালো লাগার কারণগুলো আবিষ্কার করতে থাকি। বুঝতে পারি, আমার কাজ আমার ছবি যদি সমাজজীবনের অসংগতি, বৈষম্য বদলে কোনো ভূমিকা রাখতে না পারে, তাহলে এসব ইতিহাসের গহ্বরেই হারিয়ে যাবে।
তখনো বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের কর্মী, ছবি তুলি ছোট শিশুদের, যাদের সঙ্গে হাকিম চত্বরে কিংবা মধুর ক্যানটিনে প্রায় প্রতিদিন দেখা হতো। প্রাণবন্ত-পরিশ্রমী ওই শিশুরা কেউ চকলেট বিক্রি করত, কেউ ফুল। জানি না, সেই প্রাণবন্ত শিশুরা এখন কোথায় প্রাণ রক্ষায় সংগ্রাম করছে। ছবির ভাষা না বুঝেই ২০০৭-এর জরুরি অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০-২২ আগস্ট ছাত্র আন্দোলনের ছবি তুলি। ছবি তুলি প্রিয় মানুষদের। এভাবেই শুরু, তখনো জানি না আমার সামনে মস্ত বড় ময়দান, যেখানে আমি এখনো পা-ই ফেলিনি।
তখন বড় বড় দোকানে কিছু ছবির বইয়ের সঙ্গে পরিচয় ঘটে। বইগুলোর পাতায় নদীমাতৃক শস্য-শ্যামলা বাংলাদেশ, লাল-সবুজ পতাকায় স্বাধীনতা দিবস, কিংবা পাহাড়ে আদিবাসী নারীদের নৃত্যের রঙিন ছবি দেখি। একই সময়ে ছবি নির্মাণের কারিগরি দক্ষতা এবং একাডেমিক জ্ঞান কোথায় রপ্ত করা যায়, তার খোঁজ চালাই।
অবশেষে ২০০৭ সালের মাঝামাঝি ‘পাঠশালা’র খবর পাই। প্রথমে ভর্তি হলাম এক মাসের বেসিক কোর্সে। তখন সদ্য ছাত্ররাজনীতি শেষ করে, নারী ও শ্রমিকদের মধ্য কাজ করছি। ইতিমধ্যেই দেশে জরুরি অবস্থা, মিছিল-মিটিং নিষিদ্ধ। এই সুযোগে নিজের আগ্রহের দৌড় দেখতে গিয়ে শেষে পাঠশালায় তিন বছরের কোর্সই শেষ করে ফেলি। প্রতিবছরই সহপাঠীদের বলি, ‘দেশে অনেক আলোকচিত্রী আছে, আমি পালালাম’। কিন্তু যখন টের পেলাম এই ভাষায়ও আমি মনের কথা, রাগ- ক্ষোভ শক্তি নিয়ে প্রকাশ করতে পারি, তখন ক্যামেরাও আমার নতুন আরেকটি হাতিয়ার হয়ে পড়ল।
ধীরে ধীরে বুঝতে পারলাম, আলোকচিত্র দৃশ্যমাধ্যমের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। একটি আলোকচিত্র প্রায়ই অনেক শক্তি নিয়ে পাঠকের সঙ্গে যোগাযোগের সেতু তৈরি করতে পারে। পাঠক-দর্শকের মনে গেঁথে গিয়ে তাকে নড়েচড়ে বসতে বাধ্য করতে পারে। আলোকচিত্রের সেই শক্তি আঁচ করতে পেরে এই মাধ্যমের বিষয়ে নতুন করে আগ্রহী হই। উপলব্ধি করি ছবি নির্মাণের কাজ আমার বিস্তৃত রাজনৈতিক কাজেরই অংশ। এভাবেই আলোকচিত্রের সঙ্গে ক্রমে ভালো লাগা-ভালোবাসা এবং বোঝাপড়ায় নানা দোলাচলেও এই মাধ্যমকে আর ছেড়ে যেতে পারিনি।
পাঠশালায় প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে বছরজুড়ে একটা বিষয়ের ওপর কাজ করতে হতো। আমি বেছে নিই বাংলাদেশের পোশাকশ্রমিকদের জীবন ও সংগ্রাম। পরিচিত হই অনেক তরুণ শ্রমিকের সঙ্গে। প্রতিদিন যাঁরা সাহসী করেছে আমাকে। পাঠশালায় দ্বিতীয় বর্ষে গিয়ে আমি প্রথম হাতে পাই এসএলআর ক্যামেরা। তাও মা-বাবার বদৌলতে। কাছাকাছি সময় যুক্ত হই শ্রমিক সংগঠনের সঙ্গে। বাংলাদেশ গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতির সমন্বয়কের দায়িত্বের পাশাপাশি আলোকচিত্রী হিসেবে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে ছবি তোলার কাজও চালিয়ে যাই। ২০১০-এর মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলনের সমর্থনে দৃকে কয়েকটি ছবি নিয়ে অনুষ্ঠিত হয় আমার প্রথম একক প্রদর্শনী। ২০১১ সালে পাঠশালার পাঠ চুকিয়ে ম্যাগনাম এবং নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ বৃত্তি নিয়ে ‘হিউম্যান রাইটস ও ফটোগ্রাফি’ বিষয়ে ছোট একটি গ্রীষ্মকালীন কোর্স করতে নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে খুব অল্প সময়ের জন্য ছাত্র হওয়ার সুযোগ হয়। এর পরের বছর ম্যাগনাম ফটোস প্রতিষ্ঠানের যুক্তরাজ্য শাখায় এক মাস ইন্টার্নি হিসেবে কাজ করার সুযোগ হয়। এভাবে দেশের বাইরে অন্য মাটিতে, অন্য ভাষা-সংস্কৃতির মানুষের সঙ্গে কাজের নতুন অভিজ্ঞতা হয়। এভাবে নানা চড়াই-উতরাই। এসব পথজুড়ে নারী হওয়ার কারণে নানা চাপ। আশপাশের অনেকে আমার যেকোনো যোগ্যতা, দক্ষতা, অর্জন কিংবা ব্যর্থতা—সবকিছুর মধ্যে নারী হওয়ার ‘দুর্বলতাকে’ কারণ হিসেবে খুঁজে পেতেন। এসবের জবাব কাজের মধ্য দিয়েই দিতে হবে—এমনটাই ভেবে মিছে কূটতর্কে না জড়িয়ে কাজে মনোযোগ দিই। পাঠশালার তিন বছরের কোর্স শেষ করে ওইখানেই শিক্ষকতা শুরু করি।
২০০৭ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত কাজ করি লালনসাধকদের জীবন, ঢাকা শহর, তেল-গ্যাস-কয়লা রক্ষার আন্দোলন ও পশ্চিম বাংলার নন্দীগ্রামের সংগ্রাম এবং পেশাজীবী নারীদের নিয়ে। একই সঙ্গে আমার প্রায় ছয় বছরের লম্বা সময়ের কাজ চলতে থাকে পোশাকশ্রমিকের জীবন এবং নিরাপত্তার বিষয়ে। তাজরীন এবং রানা প্লাজার ছবিগুলো তারই ধারাবাহিকতা। এই ছবিগুলো নানা জায়গায় প্রদর্শিত এবং ছাপা হয়েছে। এ কাজ করতে গিয়ে শ্রমিকদের অনেক কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ হয়। আমি বরাবর বিশ্বাস করতাম, যাঁদের নিয়ে আলোকচিত্র চর্চা করছি, তাঁদের দূরের মানুষ করে কাজ এগোনো অসম্ভব। তাই প্রতিনিয়ত চেষ্টা করেছি তাঁদের জীবনের সঙ্গে, সংগ্রামের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ার।
সেই চেষ্টাতেই তাঁদের এবং তাঁদের পরিবারের সদস্যদের কিছুটা হলেও নির্ভরতা আর ভালোবাসা পাওয়ার সৌভাগ্য হয়। সেই নির্ভরতা-ভালোবাসা যেকোনো পুরস্কার ও স্বীকৃতির চেয়ে আমার জীবনে অনেক বড় পাওয়া।
আলোকচিত্র আমার নিজের আগ্রহের জায়গা ঠিকই। কিন্তু সমাজবদলের আগ্রহই আমাকে আলোকচিত্র নিয়ে চর্চা করার অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। চারপাশের যে হাজারো বাস্তব সংকটে আমাদের বসবাস, তার পরিবর্তনের তাগিদ ছাড়া কি আসলে কোনো সৃজনশীল চর্চা সম্ভব? এই প্রশ্ন নিজের জীবনে জারি রেখেই পথ পেরোচ্ছি। আমাদের দেশের বিরাট অংশ তরুণ। তারুণ্যই আমাদের ভরসার জায়গা। আমাদের সেই তরুণেরাও নিশ্চয় তাঁদের সৃজনশীল চর্চায় অন্যের কী আসে যায়, তাতে মাথা ঘামাবেন।
তাসলিমা আখতার: আলোকচিত্রী ও প্রধান সমন্বয়কারী, বাংলাদেশ গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতি