টাকার রঙে ইতিহাস

টাকারও আছে ইতিহাস। ছবি: লেখক
টাকারও আছে ইতিহাস। ছবি: লেখক

সাদা রঙের বিশাল বাড়িটার ফাঁকে ফাঁকে সবুজের উঁকি। মেটে রঙের টবের ওপর দাঁড়িয়ে দুলছে কিছু লালচে থোকা ফুল। তাদের মাঝখানে রীতিমতো একটা টাকার গাছ! কোনো ভুল নেই! এত দিন সবাই টাকার গাছ কথাটা শুনলেও দেখতে পাবেন এবারই। নানা রকম মুদ্রা আর টাকা ডালপালা মেলে বেশ গ্যাট হয়ে দাঁড়িয়ে আছে! তবে সেদিকে লোভাতুর দৃষ্টি দিয়ে লাভ নেই। কারণ, সেগুলো সবই রেপ্লিকা। তাকে পাশ কাটিয়ে কয়েক ধাপ টপকে অবশেষে পৌঁছে যেতে হয় ইতিহাসের দোরগোড়ায়! যেখানে অপেক্ষায় ছিলেন কুশান বংশের রাজা থেকে শুরু করে আধুনিক বিশ্বের প্রতিনিধিরাও। তবে সশরীরে নয়! কেউ ছিলেন নানা রঙে, কেউ অচেনা মুদ্রায়। আবার কেউ ছাপা রঙিন কাগজে।
সোনালি আলোয় বিছিয়ে থাকা রুপা আর সোনার মুদ্রাগুলো এভাবেই মনে করিয়ে দেয় পুরোনো দিনের গল্প। বাংলাদেশের প্রথম টাকা জাদুঘরে মিলবে তাই একের মাঝে দুই। ইতিহাস যেমন জানা যাবে, তেমনি যাবে দেখাও।
ঢাকার মিরপুরে বাংলাদেশ ব্যাংক ট্রেনিং একাডেমির দ্বিতীয় তলায় দুটি গ্যালারি নিয়ে গড়ে তোলা এ জাদুঘরে ঢুকলে হারিয়ে যেতে হয় প্রাচীন জনপদে। খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতক থেকে তৃতীয় শতকে বাংলার বিভিন্ন স্থানে ছাপাঙ্কিত রৌপ্য মুদ্রার সারি। পাশেই প্রতীকচিহ্নযুক্ত মৌর্য যুগের মুদ্রা। আছে মহাস্থানগড় ও উয়ারী-বটেশ্বরে ছাপিত রৌপ্য মুদ্রা। কুশান রাজ্যে ঢুকলে রাজা কনিস্ক, হুবিস্ক, বাসুদেবের দেখা মিলবে। সেই সঙ্গে গুপ্ত যুগের প্রতীকের ছবি, হরিকেলের রৌপ্য মুদ্রা, কড়ির বাংলার সুলতানদের প্রতীক ও দোর্দণ্ড প্রতাপশালী মোগল সম্রাটদের সোনার মুদ্রার আমলও আছে। প্রাচীন মুদ্রায় তৈরি অলংকারও পাওয়া যাবে এখানে।
আর দুই লাইনের মুদ্রা বা নোট পরিচিতিতে যদি কারও মন না ভরে, তবে আছে মনিটরে আঙুলের স্পর্শে মুদ্রা বা নোট সম্পর্কে তথ্য জানার পদ্ধতি। ডিজিটাল কিয়স্ক তাই মুদ্রা সংগ্রাহক ও গবেষকদের জন্য সোনার খনি বইকি!
ঘুরতে ঘুরতেই হঠাৎ সবুজ এক গ্রামের সামনে থেমে যেতে হবে। মুদ্রার একাল-সেকালের গল্প উঠে এসেছে স্বল্প পরিসরে। হাশেম খান ও শ্যামল চৌধুরীর ছোঁয়ায় স্বচ্ছ কাচে বন্দী এ ত্রিমাত্রিক শিল্পকর্মে (ডিওরামা) মোটে তিনটি দৃশ্যে বোঝানো হয়েছে সবকিছু।

বিনিময়ের একাল-সেকালের গল্পও জাদুঘরে উঠে এসেছে
বিনিময়ের একাল-সেকালের গল্পও জাদুঘরে উঠে এসেছে

বাঁক ঘুরতেই চমক! কোচ রাজ্যের মুদ্রাগুলোতে বাংলা বর্ণের আদলে থাকা কিছু হরফ দুর্বোধ্য অর্থ দাঁড় করিয়েছে। ঘুরতে ঘুরতে ইংরেজ আমল থেকে চোখে পড়বে টাকার যুগ। কিছু বিচিত্র ও বাহারি নকশার মাঝারি আকারের কার্ডসদৃশ টাকা আর প্রাইজবন্ড কেমন জানি বিস্ময় তৈরি করে!
দেখতে দেখতে ছোট্ট করিডর পেরিয়ে দ্বিতীয় গ্যালারিতে প্রবেশ। ঘরে প্রবেশ করতেই বিশাল একটি শস্য রাখার মটকা। এরপর শুরু কাগুজে নোটের পালা। গোল্ড ফয়েলে নির্মিত আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ও থাইল্যান্ডের ১০০ থেকে ১০০০ ডলারের নোট। সেই সঙ্গে বিশ্বের প্রায় ১২০টি দেশের রংবেরঙের টাকা। এখানকার অন্যতম আকর্ষণ বিলুপ্ত দেশের নোটগুলোর মধ্যে তাদের ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে ধারণ! বারমুডার নোটের এক পিঠে যেমন আছে নীলচে সোনালি রঙের লম্বা লেজওয়ালা নাম না জানা পাখি আর অন্য পিঠে আছে নেপচুনের বিখ্যাত ভাস্কযের্র ছবি। এ ছাড়া রাশিয়া, চীন, অস্ট্রেলিয়ার দুষ্প্রাপ্য নোট, চেক ও বন্ড আছে। পাশাপাশি স্মারক মুদ্রা ও মেডেলও আছে।
বাংলাদেশের নোট ও মুদ্রাও স্থান পেয়েছে এখানে। সেই শুরু থেকে আজ অবধি চলা নোটগুলো অনেক সময় স্মৃতিকাতর করে তুলতে পারে।
এদিক-ওদিক ঘুরলেই পাওয়া যায় লাখ টাকা দামের ছবি। তা–ও আবার নিজের! গ্যালারির দুটি ফটো কিয়স্ক বুথে লাখ টাকার নোটে নিজের ছবি ছাপিয়ে স্যুভেনির হিসেবে নিতে পারবেন যে কেউ।
দিনাজপুর থেকে আসা দশম শ্রেণির ছাত্র মো. সোহেল রানা বলছিল তার নতুন কিছু জানার কথা। ‘অনেক দেশ সম্পর্কে শিখেছি, অনেক ঐতিহ্য জেনেছি। পরীক্ষার সময় হয়তো এগুলো কাজে লাগাতে পারব। বন্ধুদেরও জানাতে পারব। ওদের বলব এখানে আসতে।’
তাহসিন আর তাওসিফও গুটি গুটি পায়ে এসেছে বাবা-মায়ের হাত ধরে। নার্সারিতে পড়ুয়া এই দুই ভাইকে বাবা সুজাউদ্দিন নিয়ে এসেছেন প্রেরণা জাগানোর জন্য। ‘ওদের মধ্যে যেন কৌতূহলও তৈরি হয়, সে জন্যই নিয়ে আসা।’ বলছিলেন তিনি।
প্রায় সাড়ে চার হাজার মুদ্রা ও নোট দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে গেলে বিশ্রাম আর অল্পস্বল্প খাওয়াদাওয়ার জন্য চালু হয়েছে ‘কয়েন ক্যাফে’। ব্যস্ত জীবন থেকে ক্ষণিকের জন্য বেরিয়ে ইতিহাসের সঙ্গী হতে চাইলে ঢাকা জাদুঘর যে অনন্য তা বলার অপেক্ষা রাখে না।