বিভীষিকার ১৮ দিন!

লিবিয়ার আল–ঘানি তেলখনি থেকে অপহৃত হয়েছিলেন বাংলাদেশের দুই শ্রমিক। নোয়াখালীর আনোয়ার হোসেন ও জামালপুরের হেলাল উদ্দিন। মুক্তি পাওয়ার পর দেশে ফিরে তঁারা শুনিয়েছেন জিম্মিদশার সেই দুঃসহ অভিজ্ঞতা।

ছবি ও গ্রাফিকস: প্রথম আলো
ছবি ও গ্রাফিকস: প্রথম আলো

লিবিয়ার আলগাজি শহরে তখন দুপুরের কড়া রোদ। আল–ঘানি তেলখনিতে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের জন্য গত ৬ মার্চও ছিল অন্য দিনের মতোই। সারা দিনের খাটুনি শেষে বাড়ি ফিরে একটু বিশ্রাম। দূর দেশে তাঁদের অপেক্ষায় থাকা প্রিয় মুখগুলোর কথা ভেবে ভেবে ফেরা।
নোয়াখালীর আনোয়ার হোসেন আর জামালপুরের হেলাল উদ্দিন অন্য দশ-পাঁচজনের মতোই দিনটি শুরু করেছিলেন। নির্ধারিত দায়িত্ব পালন শেষে আনোয়ার হোসেন ভাবছিলেন, খানিক পরেই দেশে ফোন দেবেন। স্ত্রী আর বাচ্চাদের কণ্ঠ শোনার জন্য মনটা যে বড় আইঢাই করছে! আর হেলাল ভাবছিলেন, দুপুরের খাবারটা খেয়ে একটু গড়িয়ে নেবেন।
তখনো তাঁরা জানতেন না কয়েক মুহূর্ত পরেই কী বিভীষিকা তাঁদের জন্য অপেক্ষা করছে!

আনোয়ার হোসেন ভাবেননি আবার এমন খুশির দিন আসবে ,ছবি: হাসান রাজা
আনোয়ার হোসেন ভাবেননি আবার এমন খুশির দিন আসবে ,ছবি: হাসান রাজা

অনিশ্চিত যাত্রা
আনোয়ার-হেলালসহ বাকিরা যখন নিজেদের টুকটাক কাজগুলো সারছিলেন, তখন হঠাৎই দুটি বোমা ফাটার শব্দ আসে। ব্যাপার কী ভাবতে ভাবতেই নিজের কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসেন হেলাল। কিন্তু সামনে অন্ধকার ছাড়া কিছুই চোখে পড়ল না।
নিচে নেমে খুঁজে বের করলেন আনোয়ারকে। দুজনেই বুঝতে পারছিলেন অবস্থা সুবিধার নয়। কিছু ঠাহর করার আগেই সামরিক পোশাক পরা মুখোশধারী দুজনকে বন্দুক হাতে এগিয়ে আসতে দেখা গেল।
সে সময় আরও দুজন গেটের সামনে গাড়িতে অপেক্ষা করছিল। সেখান থেকেই চিত্কার করে তাঁদের সবাইকে বের হয়ে এসে দ্রুত গাড়িতে উঠতে বলা হচ্ছিল। কিছুক্ষণ পরেই ইসলামিক স্টেটের (আইএস) হাতে বন্দী হন তাঁরা দুজনসহ ১১ জন। আনোয়ার আর হেলাল ধরেই নিলেন আর কোনো দিন তাঁরা বেঁচে ফিরতে পারবেন না!
আতঙ্কের দিন, আতঙ্কের রাত
আনোয়ার বলছিলেন সেই দিনটির কথা—‘প্রথমে আমাদের মরুভূমিতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ওই লোকেরা সবার নাম, ঠিকানা ও পরিচয় জানতে চায়। পরে আমরা দুজন ও ঘানার অধিবাসী একজনকে দল থেকে আলাদা করে ফেলা হয়। খ্রিষ্টানদের তারা আলাদা করে নিয়ে চলে যায়। তারপর আমাদের তিনজনকে মরুভূমিতে ফেলে রাখে।’
দুদিন প্রায় অভুক্ত ও ঠান্ডায় কাটানোর পর তাঁদের নির্জন একটি স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে একতলার একটি নির্মাণাধীন ভবনের কক্ষে তাঁদের তালাবদ্ধ করে রাখা হয়। পাঁচ দিন ওই বদ্ধ ঘরে আটকে ছিলেন। ছোট একটা জানালা থাকলেও সেটা খোলার সাহস পাননি। এর মধ্যেই শুয়ে-বসে, কখনো টুকটাক গল্প আর বাকিটা সময় নামাজ পড়া। কোনো কিছু করার ফন্দি আঁটতে পারেননি এই ভয়ে যে চালাকি করলে হয়তো জীবনটাই শেষ হবে!
অপহরণকারীদের দেওয়া সামান্য নুডলস আর খেজুর খেয়ে দিন কাটাতে হয়েছে। কখনো এক বেলা আবার ভাগ্য ভালো হলে কখনো দুই বেলা খেতে পেয়েছেন। আর হু হু করে কেঁদেছেন পরিবারের জন্য। প্রিয় মুখগুলোকে আর কখনো দেখতে পারবেন কি না কে জানে!
মুক্তির আলোয়
এক সকালে জিম্মিদের বাইরে নিয়ে আসে ওরা। হেলাল মনে মনে চিন্তা করছিলেন, সময় বোধ হয় শেষ। এখনই সারি বেঁধে দাঁড় করিয়ে তাঁদের ওপর গুলি চালানো হবে। হাঁটতে হাঁটতে একমনে সৃষ্টিকর্তাকে ডাকতে শুরু করেছিলেন সবাই।
জঙ্গিরা তাঁদের আবারও মরুভূমিতে নিয়ে যায়।

লিবিয়ার আল–ঘানি তেলক্ষেত্র। ছবি: এএফপি
লিবিয়ার আল–ঘানি তেলক্ষেত্র। ছবি: এএফপি

হেলাল আর আনোয়ার দুজনেই দেখেন, আশপাশে ৭০ থেকে ৮০ জনের মতো অস্ত্রধারী লোক। পরে তিনজনকে বালুতে ফেলে রাখে তারা। হেলাল বলছিলেন, ‘দিনটা কোনোরকমে পার হলেও রাত নামতেই তীব্র শীত। শরীরের হাড় ভেদ করে যেন ঠান্ডা ঢুকছে। বাধ্য হয়ে বালুতে গর্ত করলাম। তার মধ্যে বসে থাকলাম।’
এক দিন বাদে তাঁদের কম্বল দেওয়া হলো। পরে কোনো দিন সেই কম্বল পেতেন, কোনো দিন না। ওই কম্বলই তাঁরা তিনজন গায়ে জড়িয়ে রাখতেন। অনেক সময় ছোটখাটো গাছের পাতাসহ ডাল ভেঙে পায়ের ওপর দিয়ে রাখতেন। সারা দিনের খাবার হিসেবে পেতেন জয়তুনের তেল মেশানো এক মুঠো ছাতু। আর পানি বলতে কেরোসিন ঢালার মগে সামান্য পরিমাণ। তাও কেরোসিনের গন্ধ মিশে থাকায় মুখে তোলা কঠিন।
খাবার আর পানির অভাবে দিনে দিনে দুর্বল হয়ে পড়ছিলেন সবাই। আর দিনগুলোও যেন কাটতেই চায় না। যেন যুগ যুগ ধরে বন্দী হয়ে আছেন তাঁরা!
নয় দিন পর সেখান থেকে জঙ্গিরা তাঁদের সিরাতে একটি মাদ্রাসার সামনে রেখে চলে যায়। পরে তাঁরা ওই মাদ্রাসার এক ছাত্রের কাছ থেকে মুঠোফোন জোগাড় করে ফোন করেন তাঁদের কোম্পানিতে। ঘণ্টা খানেক পর লিবিয়ার সেনাসদস্যরা তাঁদের উদ্ধার করে। শুরু হয় তাঁদের বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া।

.
.

অবশেষে নিজ দেশে
আনোয়ার ও হেলাল অপহৃত হওয়ার পর থেকেই তাঁদের পরিবার কোম্পানি ও বাংলাদেশ দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছিল। হেলাল উদ্দিন মুঠোফোনে আনোয়ারের পরিবারকে জানিয়েছিলেন সবার খবর। আনোয়ারের স্ত্রী মারুফা খাতুন বলছিলেন, ‘২৩ মার্চ যখন খবর পেলাম উনি বেঁচে আছেন, তখন কেমন লেগেছিল বলে বোঝাতে পারব না। আমরা ভেবেছিলাম, আর কোনো দিন ওনাকে দেখতে পাব না।’
মুক্তি পাওয়ার ১০ দিন পর তাঁরা যাঁর যাঁর বাসায় ফোন করে পরিবারকে জানান তাঁরা শিগগিরই ফিরে আসছেন। পরে কোম্পানির সহযোগিতায় হেলাল উদ্দিন ও আনোয়ার হোসেন ৬ এপ্রিল দেশে ফিরে আসেন।
এখন সপরিবারে ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে আছেন আনোয়ার হোসেন। হেলাল ফিরে গেছেন জামালপুর। সেখান থেকে মুঠোফোনে বলেন, ‘দেশের মাটিতে পা দিতেই খুশিতে কী করব বুঝতে পারছিলাম না। আমি বেঁচে আছি। আমার পরিবার আমার সামনে। এর চেয়ে বেশি আর কী চাইতে পারি।’